সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৯




এক বিশাল মহাদেশ। তার ৫৪টা দেশ। পৃথিবীর সবথেকে বড় নদ নীলনদ এই মহাদেশেই বইছে। কিন্তু আর্ট ও কালচারে এখনো অব্ধি সেই অর্থে তারা দারু কিছু অগ্রগতি করে দেখাতে পারে নি। কারণ রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে তাদের দারিদ্র, রোজকার জীবনসংগ্রাম, কুসংস্কার, মাফিয়ারাজ, সভ্যতার আলো না পৌঁছনো, ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে জেরবার হয়ে যাওয়া, ক্রীতদাস প্রথা এবং সবার ওপরে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা রক্তক্ষয়ী  গৃহযুদ্ধ। আফ্রিকা।

আজ আমরা আফ্রিকার সিনেমা নিয়েই কাটাছেঁড়া করব। যেহেতু এই মহাদেশের ৫৪টা দেশ, তাই এখানকার সিনেমা নিয়ে আলোচনা একটু দীর্ঘ হবে। এই পর্ব এবং আগামী পর্ব। চেষ্টা করব এই দু’পর্বে আমার জানা সিনেমা জগতের  আফ্রিকা যতদূর সম্ভব তুলে ধরার। তবে শুরুতেই মাথা নামিয়ে স্বীকার করে নিই যে, এশিয়া-ইউরোপ-লাতিন  আমেরিকা-হলিউডের সিনেমা আমি যতটা জানি বা দেখেছি, তার ১০%ও আমি আফ্রিকার সিনেমা সম্বন্ধে জানি না। এটা আমার জ্ঞানের ও সিনেমা দেখার সীমাবদ্ধতা। তো, যতটুকু জানি, তার ভেতর থেকেই একটা সামগ্রিক ছবি আপনাদের দেবার চেষ্টা করব।

আমার দেখা আফ্রিকান সিনেমাগুলোর ভেতর যেগুলো বেশ সিরিয়াস কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে, তার ভেতর আটটা উল্লেখযোগ্য ছবি হল: ‘কাম ব্যাক, আফ্রিকা’ (১৯৫৯), ‘ব্ল্যাক গার্ল’ (১৯৬৬), ‘তুকি বুকি’ (১৯৭৩), ‘ক্রনিকল অব দ্য ইয়ার্স অব ফায়ার’ (১৯৭৫), ‘ইয়েলেন’ (১৯৮৭), ‘বুদ য়াম’ (১৯৯৭), ‘আদাঙ্গামান’ (২০০০) ও ‘সোৎসি’ (২০০৫)

‘কাম ব্যাক, আফ্রিকা’ (১৯৫৯) তৈরি হয়েছে সাউথ আফ্রিকা থেকেপরিচালক লায়োনেল রোগোসিন রোগোসিন একজন আমেরিকান, কিন্তু এই সিনেমা করার জন্য উনি ১৯৫৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করেন ও কাজ করার পারমিট জোগাড় করেন। তারপর এক মিউজিকাল ভ্রমকাহিনী বানানোর অছিলায় বিভিন্ন জায়গায় শুটিং  করতে থাকেন। যদিও আসল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের এক প্রামাণ্য দলিল বানানোর। এই ছবির বেশিরভাগ চরিত্রই রাস্তার ধারের হেঁটেচলে বেড়ানো মানুষ যারা অনেকেই জানত না তারা এক ছবির অংশ হতে চলেছে। ছবির নায়ক জাকারাইয়া ছিল একজন জুলু শ্রমিক।

ছবির নায়ক জারাকাইয়া এক দুর্ভিক্ষের পর নিজের গ্রাম ছেড়ে বউ-বাচ্চাদের ছেড়ে জোহানেসবার্গে চলে আসে কাজ করে টাকা কামানোর আশায়। কিন্তু সেখানে সে বেশিদিন চাকরি করতে পারে না। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের জ্বালায় মাঝে মাঝেই চাকরি যেতে থাকে। অগত্যা সে জোহানেসবার্গ ছেড়ে এক ছোট্ট শহর সোফিয়ায় চলে আসে। তার বউ-বাচ্চারাও গ্রাম ছেড়ে হঠাৎ তার কাছে চলে আসে। তারা ওঠে তাদের এক বৃদ্ধা আত্মীয়-র কাছে। কিন্তু এখানেও জাকারাইয়া-র চাকরি চলে যায়। প্রতিবার বর্ণবৈষম্যের কারণে। এবার সে ঠিক করে আবার গ্রামে ফিরে  যাবে কিন্তু তার বউ ভিনা যেতে রাজি হয় না। স্বামীর বদলে ভিনা কাজ করতে চায়। এই নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। এর মাঝে জাকারাইয়া এক স্থানীয় গুন্ডার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। সেই গুন্ডা একদম শেষ সিনে জাকারাইয়াকে না পেয়ে আক্রোশবশত ভিনাকে মেরে ফেলে।

ছবি শেষ হবার পর রোগোসিনকে গোপনে সবকিছু নিয়ে চলে যেতে হয় লন্ডন। সেখানে ছবির বেশিরভাগ ডাবিং করা হয়। তারপর ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে এই ছবি প্রকাশ করা হয়। যদিও এই ছবি সত্যি অর্থে আফ্রিকান ছবি নয় কার সিনেমার পরিচালক আফ্রিকান নন, কিন্তু এই ছবি বানানোর জন্য তাঁর আফ্রিকায় এসে ভ্রমকাহিনী   শুটিংয়ের বাহানায় দিনের পর দিন গোপনে কাজ করে চলা, তার জন্য এই সিনেমা আফ্রিকার ইতিহাসে জ্বলজ্বলে হয়ে লেখা থাকবে। অবশ্য এটাও বলতে হয়, যেহেতু রাস্তার ধারের চরিত্রদের দিয়েই বেশিরভাগ কাজটা করানো হয়েছে, তাই অভিনয় বা সংলাপ, কোনোটাই ভাল নয়।   

‘ব্ল্যাক গার্ল’ (১৯৬৬) সেনেগালের ছবি। যার পরিচালক উসমান সামবেনে আফ্রিকার লিজেন্ডারি ফিগার। আফ্রিকান সিনেমাকে আন্তর্জাতিক করার পেছনে তাঁর অবদান সিংহভাগ।  

এই ছবিও আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের আরেক জ্বলন্ত উদাহরন। ছবির নায়িকা ডিয়না ভাল জীবন কাটানোর আশায় আফ্রিকা ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যায়, এক দম্পতির দেখভাল করার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে বুঝতে পারে সেখানে তার ভূমিকা বাড়ির ক্রীতদাসী ছাড়া কিছুই নয়। সে নিজের ইচ্ছেমত কোথাও যেতে পারে না, পোশাক পরতে পারে  নাতার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাড়ির অতিথিরা তাকে জোর করে চুমু খায়। অবশেষে ডিয়না একদিন আত্মহত্যা করে।

ডিয়নার ভূমিকায় এমবিসিনে ডায়প ক্যামেরার সামনে সাবলীল। প্রথমবার বড় শহর দেখার উচ্ছ্বাস, কুকুর দেখে পালিয়ে যাওয়া, একটা আফ্রিকান মাস্ক নিজের ঘরে এনে রাখা, পুরোটাই স্বচ্ছন্দ। তবে সিনেমায় অ্যাবরাপ্ট কাট প্রচুর আছে। আর বেশিরভাগ ইনডোর শট।    

‘তুকি বুকি’ (১৯৭৩)-ও এসেছে সেনেগাল থেকেপরিচালক ডিব্রিল ডায়প মাম্বেতি। মাম্বেতি মাত্র দুটো সিনেমা বানিয়েছেন (পূর্ণদৈর্ঘ্যের), ‘তুকি বুকি’ ও ‘হায়েনাস’কিন্তু দুটোই অন্য পরিচালকদের থেকে একটু আলাদা কারণ সেখানে সুররিয়েলিজম থাকে, নন-লিনিয়ার ন্যারেশন থাকে, মোটিফ থাকে, এবং প্রতি ছবিতে গতি থাকে। আমরা দু পর্বে এই দুটো সিনেমাই আলোচনা করব।

তুকি বুকি এক যন্ত্রণা থেকে বানানো। একদিকে শেকড় ছিঁড়ে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার টান, অন্যদিকে মাটির  আকর্ষ। কে জিতবে? কীভাবে? সিনেমা শুরু হচ্ছে কশাইখানায় গরুর পাল নিয়ে গিয়ে গলা কেটে একে একে গরু  জবাই করার দৃশ্য দিয়ে। এটা পরিচালক মোটিফ হিসেবে মাঝে মাঝেই ব্যবহার করেছেন। এমনকি ছাগল জবাই করার দৃশ্যও। এর মাঝে এক যুবক রাখাল, মোরি, যে নিজের মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে গরুর শিংওয়ালা স্কাল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। মোরি আর তার প্রেমিকা আন্তা স্বপ্ন দেখে অনেক টাকা জমিয়ে ফ্রান্স চলে যাবার। মোরি এক হোমোসেক্সুয়াল ধনীর থেকে প্রচুর টাকা চুরি করেও ফেলে, দুজনে টিকিট কেটে নেয় জাহাজে ফ্রান্স পাড়ি দেবার  জন্য, আন্তা জাহাজে উঠেও পড়ে। কিন্তু মোরি মাটির টানে জাহাজে উঠতে পারে না, সে দৌড়তে থাকে নিজের ফেলে আসা মোটরবাইকের দিকে। শেষ সিনে দেখা যায় আন্তা জাহাজে চড়ে আফ্রিকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর মোরি নিজের ভেঙে যাওয়া বাইকের গরুর স্কালের দিকে চেয়ে উদাস বসে আছে। ঠিক যেন শঙ্খ ঘোষের কবিতা – ‘আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছটান’ (এই লেখা লিখতে লিখতে খবর পেলাম শঙ্খ ঘোষ আর নেই, কোভিড ভাইরাস তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছে)।

দারু ছবি। বিশেষ করে ক্যামেরা আর সাউন্ড-ট্র্যাকের তারিফ করতেই হয়। একটা সিন, পরিচালক দু’বার দু’ভাবে  দেখাচ্ছেন গতি একটুও না থামিয়ে। অথবা সেক্সের দৃশ্য, সমুদ্রকে ব্যাকড্রপে রেখে বাইকে আঁচড়কাটা আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ একটা সিন কেটে দিচ্ছেন, আবার ক্যামেরা ঘুরিয়ে আরেকটা অ্যাঙ্গলে রেখে দিচ্ছেন। সিনেমার ভাষায় যাকে স্পেসিয়াল শিফ্‌ট বলে, তার দারু উদাহরণ এই ছবি। পেছনে লো-টোনে কন্টেম্পোরারি মিউজিক।  

‘ক্রনিকল অব দ্য ইয়ার্স অব ফায়ার’ (১৯৭৫) আলজেরিয়ার ছায়াছবি। পরিচালক মহম্মদ লখদর-হামিনা। এই ছবি ৭৫ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালে মার্টিন স্করসেসে বা অ্যান্তনিয়নি-র ছবিকে টেক্কা দিয়ে গোল্ডেন পাম জিতেছিল। ১৯৬৬ সালে গিলো পন্টেকর্ভো তৈরি করেছিলেন ‘দ্য ব্যাট্‌ল অব আলজেয়ার্স’আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এক দুর্দান্ত সিনেমা। তারপরেই এই ছবি দেখিয়েছিল ৬৬ সালের সেই সিনেমার আগের গল্পএক চাষীর জীবনে ঘটে চলা কাহিনীর মধ্যে দিয়ে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়া অব্ধি সেখানকার গণ আন্দোলন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল।

এই ছবি একটু অতিনাটুকে। দৃশ্য এবং কথোপকথনের জন্য। প্রথম দৃশ্যে এক চাষীর সেনায় যোগদানের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে মরুভূমির গনগনে বালিতে ভেড়াদের মরে থাকার চুপচাপ শট থেকে গণ আন্দোলনে সবার একে একে যোগ দেওয়া – অনেক অংশই যেন সিনেমা নয়, নাটকের ফ্রেমে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু লং শটগুলো মনে রাখার মত করেই বানানো হয়েছে।   

‘ইয়েলেন’ (১৯৮৭) মালি দেশের সিনেমা। পরিচালক সুলেইমান সিসে এই ছবিতে আফ্রিকার ব্ল্যাক ম্যাজিক ও কুসংস্কার ফুটিয়ে তুলেছেন। এক তরু ম্যাজিশিয়ান নিয়াঙ্কোরো, যার বাবা ছোটবেলায় ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য তাদের  ছেড়ে চলে গেছে, তার কাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তার লক্ষ্য, কাকার কাছে ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখে নিজের বাবার  মুখোমুখি হওয়া, যে বাবা তাকে মেরে ফেলতে চায়। কেন? কার তার বাবার মনে কুসংস্কার জমে আছে যে নিজের  ছেলের হাতে সে খুন হবে। নিয়াঙ্কোরোর সেই যাত্রা নিয়ে এই ছবি। ইয়েলেন মানে উজ্জ্বলতা। পূব আকাশে রোজ সূর্যের উজ্জ্বলতা নিয়াঙ্কোরোর জীবনে নতুন নতুন জ্ঞান নিয়ে আসে।

এই ছবি তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় সামান্য হলেও এখানে জটিলতা মিশে আছে। আফ্রিকার নিজস্ব কুসংস্কার আর তন্ত্র-মন্ত্রের মাঝেও এক যুবকের জীবন সম্বন্ধে খোঁজ সেখানকার ইয়ং জেনারেশনের উদার মানসিকতার পরিচয়। ফলে এই ছবি পাশ্চাত্য সমাজেও এক নতুন জ্ঞান নিয়ে হাজির হয় যা একান্তভাবেই আফ্রিকার নিজস্ব। এবং ছবির ফটোগ্রাফি বেশ ভাল। 

‘বুদ য়াম’ (১৯৯৭) এসেছে বুর্কিনা ফাসো দেশ থেকে। পরিচালক গাস্টন কাবোরে। থিমের দিকে এই ছবির সঙ্গে আমি ‘ইয়েলেন’-এর বেশ খানিকটা মিল খুঁজে পাই। উনিশ শতকের আফ্রিকায় এক মা-হারা ছেলে ওয়েন্ড কুনি।  ছেলেবেলায় তার মাকে লোকেরা ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারে। তারপর ছেলেটি মানুষ হয় তার পালিত মা-বাবার কাছে। একদিন কুনির পালিত বোনের অসুখ হয়। গ্রামের লোকেরা কানাঘুষো করে যে কুনি নিশ্চয় তান্ত্রিক, তার মন্ত্রেই তার বোনের এই অবস্থা। বাধ্য হয়ে নিজের নাম সন্দেহের বাইরে আনার জন্য সে বোনের চিকিৎসার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সেই যাত্রায় সে আস্তে আস্তে বিভিন্ন মানুষের থেকে নিজের পরিচয় একটু একটু করে জানতে পারে। এখানেও জীবন খোঁজার মধ্যে দিয়ে নতুন জ্ঞান।

ওয়েন্ড কুনির ঘোড়ায় চড়ে ঘোরা আর পেছনে স্যাক্সোফোনের ব্যবহার মাঝে মাঝেই তুকি বুকির কথা মনে পড়িয়ে দেবে। আমার আরো ভাল লেগেছে ক্যামেরায় বুর্কিনা ফাসোর সাধার গ্রাম্য জীবনের ছবি। কখনো মনে হচ্ছিল যেন  পটভূমিকায় পুরুলিয়ার মাটির বাড়ি, রুক্ষ্ম লালমাটি আর পাহাড় দেখতে পাচ্ছি। ছবি শেষ হচ্ছে ইতিবাচক সুরে, যা আফ্রিকার সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য যথেষ্ট।   

‘আদাঙ্গামান’ (২০০০) কোট ডি’ভয়া (আইভরি কোস্ট)-র ছবি। পরিচালক রজার এমবালা। ১৭ শতকের পটভূমিকায় এই সিনেমা আফ্রিকার ক্রীতদাসপ্রথা, মানুষদের গরু-ছাগলের মত কীভাবে ব্যবহার করা হত, আর তার  নৃশংসতা, সেই নিয়ে তৈরি। এক যুবক ওসেই বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। কয়েকদিন পর ফিরে এসে দেখে গ্রামের বেশির ভাগ লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। তার বাবা, তার বিয়ের জন্য পছন্দ করা পাত্রী – সবাই মৃত। জানতে পারে তার মা-কে খুনে যোদ্ধা গোষ্ঠীর রাজা আদাঙ্গামান আর তার লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে ক্রীতদাস হিসেবে বেচবে বলে। এরকম অনেককে নিজের গ্রামে আটকে রেখেছে। ওসেই বেরিয়ে পড়ে তার মাকে ছাড়িয়ে আনবে বলে। রাস্তায় বন্ধুত্ব হয় আরেক যোদ্ধা নাকা-র সঙ্গে। তারপর ছবি এগোয়।

এই সিনেমায় দারু লাগবে ক্যামেরার কাজ। রঙের কাজ। আর ক্রীতদাসদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার লং শট যা থেকে  ফুটে ওঠে পায়ে হাঁটা সেইসব মানুষের দুর্দশা কতটাএটাও বলতে হয় মাঝে মাঝেই নৈঃশব্দ আর প্রকৃতির শব্দ  সিনেমাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে এটাও ঠিক, এই ছবি শুধুমাত্র ক্রীতদাসপ্রথার ন্যারেটিভ হিসেবেই  থেকেছে, কোন উজ্বল সমাধান তুলে আনে নি।   

‘সোৎসি’ (২০০৫) সাউথ আফ্রিকার সিনেমাপরিচালক গেভিন হুড এই ছবি তৈরি হয়েছে সাউথ আফ্রিকার শহুরে আর শহরতলীর পটভূমিতে। আফ্রিকার চলিত কথায় সোৎসি মানে গুন্ডা-বদমাশ। ছবির প্রধান চরিত্রকে তার বন্ধুরা বেশিরভাগ সময় সোৎসি নামেই ডাকছে দেখা যায়। তো, সোৎসি একবার এক গাড়ি ছিনতাই করে। ছিনতাই করে আনার পর বুঝতে পারে গাড়ির ভেতর কয়েকমাসের এক বাচ্চা ছিল, যাকে সে গাড়ির সঙ্গেই তুলে এনেছে। সেখান থেকে এই সিনেমা শুরু। বাচ্চা চুরির পর সে বুঝতে পারে বাচ্চা মানুষ করা তার কম্মো নয়। এদিকে বাচ্চার জন্য সময় দিতে গিয়ে তার নিজের গুন্ডামিতেও আস্তে আস্তে ভাটা পড়ে। সে তার এলাকায় মিরিয়ম নামক এক মহিলাকে  খুঁজে বের করে যার নিজেরও সমবয়সী এক বাচ্চা আছে। সোৎসি একদিন মিরিয়মের ঘরে জোর করে ঢুকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে বাধ্য করে এই ছিনতাই হওয়া বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে। এরপর মাঝে মাঝেই সেই মহিলার কাছে যায় বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্যএবং বাচ্চার জন্য নিজের অপরাধের জগৎ থেকে অনেকটাই সরে আসে। যদিও এক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মুহূর্তে আগুপিছু না ভেবে নিজের বন্ধুকে গুলি করে মেরে ফেলে। শেষদিকে  দেখা যায় মিরিয়মের কথায় সোৎসি সেই বাচ্চাকে তার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতে আসে।   

শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই সোৎসি তার ক্রমাগত ভুলের জন্য ক্লান্ত, অনুতপ্ত। বাচ্চাটাকে বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সময়েও তার চোখে সেই ভুলের ছবি। পুলিশের উঁচিয়ে রাখা পিস্তলের দিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এ যেন অবিকল প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাগর থেকে ফেরা’। বিষণ্ন ও বিমর্ষ। ‘হাওয়া বয় শনশন, তারারা কাঁপে / হৃদয়ে কি জং ধরে, পুরনো খাপে?’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন