শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

শিবাংশু দে

 

গীর্ণকুসুম – ১




 

বাঙালির গান শোনা

একটা গল্প মনে আসছে। তখন আমরা নিতান্ত বালক। মাঝে-মধ্যে দোকানে রেকর্ড কিনতে যাওয়া হতো। সেরকম একবার রেকর্ড শোনা হচ্ছে। মানে বাবার ছিল দোকানে গিয়েই বলা হেমন্তের নতুন কোন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড এসেছে কি না? তারপর অন্য কোনও গান শোনার কথা, কেনার কথা ভাবা যাবে না হয়। সেমত কেনাকাটা করে একটু দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে, এই সময় এক সজ্জন এসে একটা রেকর্ডের খোঁজ করলেন। দোকানী তখন রেকর্ডটি চালিয়ে সন্তর্পণে স্টাইলাসটি তার উপর রাখা মাত্র (তখন কেনার আগে লোকজন রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনে নিতো) সদম্ভে, সজোরে  মান্না দে গেয়ে উঠলেন, "দে রে লে লে য়ম", বাবা বেশ চমকে গেলেন। তার একটু পরেই শুরু হয়ে গেলো, "এক চতুর নার"। আমরা বেশ শুনছিলুম, কিন্তু বাবা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দোকানীকে প্রশ্ন করলেন, "এটা কী গান?" দোকানী তখন বিশদ জানালেন গান'টির বিষয়ে। তখন বাবা'র সব রাগ  গিয়ে পড়লো প্রয়াত কৃষ্ণচন্দ্র দে ও শচীনকত্তার উপর। তিনি রীতিমতো অপ্রসন্ন হয়ে দোষারোপ করছিলেন এই দু'জনকে। অভিযোগ ছিলো, তাঁরা তাঁদের শিষ্য ও বংশধরদের মধ্যে সঠিক সঙ্গীতের শিক্ষাটি দিতে পারেননি। বাড়ি ফেরার পথেও বাবা ক্রমাগত গজগজ করতে করতে ফিরলেন, এই হয়েছে গানে'র হাল আজকে। সেই আজ আর এই আজ! এখন আমরা জানি এই গান'টি শুধু প্লেব্যাক সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটা জলবিভাজকই নয়, এই মুহূর্তেও সর্বকালের লোকপ্রিয় একটা সৃষ্টি। তিপ্পান্ন বছর হয়ে গেলো।  

 https://www.youtube.com/watch?v=lGfTQ-YFjIE

বাবা'রা সেটা তখন বুঝতেন না।  তাঁদের সঙ্গীত উপভোগের মানদণ্ড আলাদা ছিলো। এক কথায় গান শোনার অভ্যেস। এই অভ্যেসের সঙ্গে গানের সুর ও কথাবিন্যাস দুইই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গান কেউ শোনেন কান দিয়ে, কেউ অভ্যেসবশে, কেউ বা মস্তিষ্ক দিয়ে, ক্রিটিক্যালভাবে। কবিতাও তাই। কেউ তাকে আবেগ দিয়ে স্পর্শ করতে চান, কেউ অবলম্বন হিসেবে, কেউ বা তাকে নিছক মেধাপ্রকল্প ভেবে নে'ন। প্রত্যেকের যাত্রার অভিমুখ কিন্তু একই দিকে। একটু ছায়া, একটু স্বস্তি, একটু শান্তি, আর কিছু নয়। এরকম মানুষ চিরকাল আছেন যাঁরা মনে করেন আমি কবিতা 'বুঝি না' তাই ওটা ট্র্যাশ। সময়ের অপচয়। কেউ বা কবিতার কাছে কিছু পা', তাই তাঁরা আরো কিছু পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। কেউ বা মেধাচর্চা করে শেষপর্যন্ত কবিতা''রহস্যময়' জগতে ঢোকার পাসপোর্টও পেয়ে যা'ন। সবারই স্বাধীনতা আছে নিজের মতো করে ভাবার। তবে শ্রমের শর্তটি অস্বীকার করলে কিছু প্রাপ্তি হবে না। কবিতার কাছে কিছু পেতে গেলে ভাষাটি অন্তত ভালোভাবে শিখতে হবে। কারণ কবিতা ভাষাভিত্তিক শিল্প। তেমনি গানের কাছে তাৎক্ষণিক ভালো লাগার ঊর্ধে কিছু পেতে গেলে সুরের কারিগরি'র দিকগুলি নিয়ে একটু প্রস্তুতি থাকা দরকার। এমন নয় যে সে প্রস্তুতি না থাকলে গানের কাছে কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু এ দিল মাঁগে মোর। সঙ্গীতসমুদ্রের কোনও সীমা নেই।

আরো বহু বিষয়ের মতো সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে ঠাকুরবাড়ি, বাঙালির গান শোনার, বোঝার, সৃষ্টি করার ক্ষমতাটিকে সুনির্দিষ্ট প্রত্যয়ে একটা বাঁক দিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির গায়ন ধারার সব চেয়ে বিশ্বস্ত রূপ আমরা প্রথম শুনেছি অমলা দাশের পরিবেশনায়। তাঁর ১৯১১ সালে রেকর্ড করা এই গানটি শুনলে তার কিছু আভাস পাওয়া যাবে।

https://www.youtube.com/watch?v=QgYkTE2EGmI

বাংলা গানে রবীন্দ্রসঙ্গীত আসার পর বাণীর গভীরতা সাহিত্য উৎকর্ষের শিখর ছুঁয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সুরের বৈচিত্র্য ও প্রয়োগে অনন্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষা। আমাদের আবহমান সংস্কৃতিতে এর কোনও অতীত উদাহরণ নেই। নেই কোনও সমান্তরাল সাফল্যের নজির। সমঝদারেরা বলেন সারা পৃথিবীতে এর সমতুল কিছু দেখা যায়নি। আমরা ইতরজনেও তার কিছুটা বুঝি। মাতৃভাষাসূত্রে এই কৃতিত্বের অংশীদার হয়ে হয়তো কিঞ্চিত শ্লাঘাও বোধ করি। কিন্তু সমস্যাটি আসে অন্যদিক থেকে। বাংলায় যাকে বলে 'স্ট্যান্ডার্ড', সেটা এইফাঁকে এতটাই উপরে উঠে গেছে যে পরবর্তী সুরশিল্পী বা গীতিকার'দের জন্য তা এক অনন্ত চ্যালেঞ্জপরিবর্তিত হওয়াটা কালের ধর্ম। কিন্তু কীভাবে পরিবর্তিত হলে তা কম্পোজার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ছায়ার বাইরে আসতে পারার এলেম দেখাবে, সেটা নিয়ে অনিঃশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে গত ষাট-সত্তর বছর ধরে। সত্যি কথা বলতে কি 'ছায়ার বাইরে' আসার জন্য অনেক সংলাপ বিনিময় হয়েছে, কিন্তু দিনের শেষে কেউই বাইরে আসতে পারেননি। বাণীশিল্পের দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ করার কোনও অবকাশ নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ চেতনে-অবচেতনে শুদ্ধ  'কবিতা' ও লিরিকের মাঝখানের সীমারেখাটি প্রায়শঃই অদৃশ্য করে দেন। তাই কোনও পাথুরে মাপদণ্ড এখানে অপ্রাসঙ্গিক। উত্তর-রবীন্দ্র বাংলাগানের বিবর্তনটি অন্যান্য যে কোনও ভাষাভিত্তিক অর্বাচীন সাঙ্গীতিক বিকাশের সঙ্গে মিলবে না। তাই আমাদের গান শোনার অভ্যেসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের হস্তাবলেপ পরিপ্রেক্ষিতগুলি পাল্টে দেয়।

https://www.youtube.com/watch?v=90zsRVydVP4

একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। বাংলাগানের শ্রোতা এবং স্রষ্টারা নানারকম শৈলী নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এই সব পরীক্ষা থেকে অন্তত একটা সূত্র সাধারণভাবে উঠে আসে। শৈলী যাই হোক না কেন, যদি মেলোডির অভাব থাকে তবে কোনও গানই সামগ্রিকভাবে বাঙালি শ্রোতার আনুকূল্য পায় না। বিভিন্ন বিদেশি জঁর নির্ভর অনেক কাজ হয়েছে আমাদের গানে। কিন্তু সেই সব গানই  সাধারণ শ্রোতার কাছে গ্রাহ্য হয়েছে যেখানে তাল, লয়, চলন, গতি ও গানের অন্যান্য অঙ্গ কখনও মেলোডির সহজ উৎসার ও অগ্রগতিকে ব্যহত করেনি। তাই যদি সুরসৃষ্টির সফলতার প্রেক্ষিত থেকে বাংলাগানের গড়ে ওঠা বিচার করি, তবে দেখবো মেলোডিক প্রগ্রেসনের নানা বৈচিত্র্যই তার মূল লক্ষণ। এই দৃষ্টিকোণটি থেকে বিচার করলে দেখা যাবে বাংলাগানে এতো বিরাটমাপের সুরকারেরা রাজত্ব করে গেছেন, তার জুড়ি অন্য ভাষার গানে মেলা ভার। কিন্তু গানের বাণী সৃষ্টির প্রশ্নে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি যাওয়ার মতো গীতিকারদের সন্ধান আমরা পাইনি। অবশ্য এটা একটা খণ্ডিত সন্ধান। আমরা পৃথকভাবে গীতিকার বা সুরকারদের চিহ্নিত করার প্রয়াস থেকে না হয় একটু নিবৃত্ত হই। এখানে আমাদের বিচার্য হোক বাংলাগানে সম্পূর্ণ কম্পোজারদের ঐতিহ্যটি। রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী বাংলাগানের প্রধান দিকপাল, যেমন রামপ্রসাদ সেন বা রামনিধি গুপ্ত (কমলাকান্ত, দাশরথি রায়, শ্রীধর কথক, রাম বসু প্রমুখ কম্পোজারদের আমি 'প্রধান' উৎসমুখ  হিসেবে বিবেচনা করছি না), নিজস্ব গীতধারা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। এটা ছিল আদ্যন্ত নাগরিক স্রোত।

https://www.youtube.com/watch?v=wJLbbWF_4L0

আবহমান কীর্তন ও লোকজ সঙ্গীতধারার প্রভাবী স্রোতে লালন বা সিরাজ সাঁই সৃষ্ট সমান্তরাল গীতধারা প্রবলভাবে বর্তমান ছিলএই সমস্ত স্রোত এসে মিলে যায় রবীন্দ্রসঙ্গমে। এই সব ঐতিহ্যের উপাদান এবং নিজস্ব সীমাহীন সৃজনসম্পদ,  সুর বা বাণী, উভয় ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ কম্পোজার হিসেবে অনর্গল গ্রহণ করেন। উপরন্তু সেই পথে বাংলাগানকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে যা', যা হয়তো তার আগে অসম্ভব বোধ হতো। এই সৃষ্টিধারার সময়কালের পরিধিও বিস্ময়কর। এতো দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের সৃষ্টিশীল জীবৎকাল) শ্রোতামণ্ডলীর অভিনিবেশকে আকর্ষণ করে রাখার ক্ষমতা সম্ভবত সারা বিশ্বেই তুলনাহীন। 

অন্য লেখার প্রসঙ্গ আনছি না। রবীন্দ্রনাথের গানে টেক্স্ট আর কনটেকস্টের  ক্রমাগত স্থানপরিবর্তন, সুষম বৃত্তাকার কেন্দ্রিক টানে গীতিধর্মিতার ধরন বজায় রেখেছিল। কবিতার রহস্যগূঢ় মোহমায়াকে এভাবে ছন্ন প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া, এখনও পর্যন্ত আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। ভিতর থেকে অ্যাকাডেমিক দর্শনচর্চার তুমুল প্ররোচনা থাকলেও  লিখতে বসে কবিতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সেই তাড়না'কে উপেক্ষা করার ক্ষমতাও কবি হিসেবে তাঁর অন্যতম সিদ্ধি। এই পর্যায়ের  শৈল্পিক পরিণতমনস্কতা এখনও পর্যন্ত অদ্বিতীয় একটি সাফল্য। তাঁর সমসাময়িক কম্পোজারসমূহ দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা এই ঘরানার শেষ দিলীপকুমার এবং পরবর্তীকালে নজরুল, সে রকম কিছু ভাবতে পারেননি। অন্যদিকে প্রতিটি ব্যবহৃত শব্দ, কয়েনেজ, ধ্বনি ও সমাপতন, সুরের ভাষায় নির্ভুল অনূদিত হয়ে যায়। শতাধিক বছর পেরিয়ে এসেও শ্রোতার ভিতরে এখনও অনুরণন সৃষ্টি করে প্রবণতা দেখলে মনে হয় আরো বেশ কিছুদিন এরকম যাবে। এহেন একটি হিমালয়ের ছায়ায় পরবর্তীকালে আর কোনও সম্পূর্ণ কম্পোজারের স্বাধীনভাবে স্ফূর্ত হওয়া দুষ্কর। এমনকি সলিল চৌধুরীও পারেননি। তাঁর সুরের জাদু যতোই বহুমুখী, মুগ্ধমোহন হোক না কেন, বাণীর ঔৎকর্ষের বিচারে সেটি তাঁর পূর্বসূরির উত্তরাধিকারটি পায়নি। কনটেকস্টের কাছে টেকস্ট পিছিয়ে পড়েছে সব সময়।

https://www.youtube.com/watch?v=RY6YHO5vuPY

১৯৫২ সালে সলিল চৌধুরীর মনে হয়েছিল, "...আমি মনে প্রাণে আমার বিষয়বস্তুর প্রতি আন্তরিক হতে চাই। কোনো কথাকে প্রকাশ করবার সময় কোনো সুরের আমি যখন আশ্রয় নিই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার দ্বারা ঐ কথাটি ঐভাবে বলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে বলা সম্ভব নয়।" সলিল চৌধুরী কিন্তু কবি ছিলেন না। তাঁর কথা কিন্তু আসলে সুরের কথা। ভাষার ভূমিকা সেখানে দ্বিতীয় সারিতে। এ নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। খুব উর্বর সুরের জমি ছিলো তাঁর মননে। 'গান' ভাবলেই আগে সুর'টি, তার স্বরলিপি, তার অর্কেস্ট্রেশন, তার পরিবেশন, সব মিলিয়ে তাঁর 'কথা' হয়ে উঠতো। তাই গানের বাণীগুলি বহু সময়েই সমকালের চলিত প্রবণতা'র থেকে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত একটা বিশেষ সময়ের দাবিই থাকতো প্রত্যক্ষভাবে। পরিচিত ছাঁচের থেকে আলাদা তাঁর লেখা বহু লিরিক শ্রোতাবর্গকে চমকে দিয়েছে বহুবার। আমরা এখনও সেই সব লিরিক 'ভালোবেসে' শুনি, অনেকটা অভ্যেসবশে। একটু মনোসংযোগ করে যদি বিশ্লেষণ করতে যাই, তবে চোখে পড়ে যাবে পুনরাবৃত্তি, মামুলি শব্দবন্ধ, অপ্রভাবী রূপক ইত্যাদি। এইসব 'চ্যুতি'র ঝুঁকি হয়তো 'সুর'কে জায়গা ছেড়ে দেবার জন্যই তিনি নিয়েছিলেন। হয়তো শব্দের অভিঘাত নিয়ে একটু ধৈর্যহীন, অসহিষ্ণু। অবশ্য এই বিচারটি আমরা একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রচলিত মানদণ্ডে করার প্রয়াস পাচ্ছি। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেলে সমকালের বিচারে সলিল চৌধুরীর কাব্যভাষা খুব একটা বেমানান লাগে না। আমার পিতৃদেবের বিচারে (তিনি একজন নিবেদিত কাব্যপ্রাণ মানুষ ছিলেন) সলিলের লিরিক সেই যুগে মানুষকে বিশেষভাবে প্রেরিত করতো। যদি সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারাটা কাব্যের প্রসাদগুণের লক্ষণ হয়, তবে সলিলের বাংলা লিরিকে নতুন স্বাদ এনে দেওয়ার প্রয়াসকে সাফল্যের একটা নিরিখ বলে মানতে হবে।

https://www.youtube.com/watch?v=P5OcTA3nZzg


(ক্রমশ)

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন