শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

পৃথা কুণ্ডু

 

অন্ধকারের রাজা




“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে / সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া”—কবিতার নাম ‘দুঃসময়’। গত কদিন ধরে এ কবিতাটা বড় বেশি করে মনে পড়ছে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে অন্ধকার, দুঃসংবাদ আর আশঙ্কার পাকে জড়িয়ে কাটছে প্রতি মুহূর্ত। এই কবিতার প্রতিটা পঙক্তি যেন এমন এক আঁধারকালের কথা ভেবেই লেখা। কিন্তু সত্যি কি সংগীত থেমে যায়? কার ইঙ্গিতে?  নাকি দুঃসময়ের আবর্তে পড়ে আমরাই শুনতে ভুলে যাই আঁধারের সুর-ভাষা? সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আলো খুব ভালো জিনিস, আর অন্ধকার খুব খারাপ। ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়, নইলে নাকি অমঙ্গল। আলো মানে জীবন, জ্ঞান, দিশা, আর অন্ধকার মানে তার উল্টোদিকের যা কিছু। ভাবনার ওপর  এই ভালো-মন্দের ছাপ মেরে দেওয়ায়, আমরা জীবনের বেশিরভাগ সময় জুড়ে অন্ধকারকে এড়িয়ে চলতে শিখে যাই, ভয় পেতে পেতে, গা বাঁচিয়ে চলতে চলতে একসময় আঁধার পেরিয়ে যাবার ইচ্ছে বা চেষ্টাটুকুও করতে ভুলে যাই।

এই ক’দিন আগে পেরিয়ে গেল ২৫শে বৈশাখ, একশো ষাট হল তাঁর। মনের ভার কমাতে সন্ধ্যায় একটু জোর করেই আঙুল চালানো ইউটিউবে — যা আসে আসুক। ভেসে এল “মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে”। এ গানেই তো আছে ‘দুঃসময়’-এর প্রায় হুবহু কথাছবি! “ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি / ইঙ্গিত করি তোমা পানে আছে চাহিয়া”-র সাথে কী আশ্চর্য মিল “রজনীর তারা উঠেছে গগন ছেয়ে / আছে সবে মোর বাতায়ন পানে চেয়ে”র —তারপর অন্ধকারের মধ্য থেকেও সেই অমোঘ ডাক—“প্রিয়তম হে, জাগো, জাগো, জাগো”—যে ডাক শুনে তিমির কেঁপে ওঠে গভীর আলোর রবে।     

বিশ্বাস করুন, এই কথাগুলো যখন লিখছি, ফোনে এসে ঢুকল একটি বার্তা—“অক্সিজেন পাওয়া গেছে, এখন কিছুটা ভালো।” গত রাতে অনেকগুলো অক্সিজেন সরবরাহ-সংস্থার খবর জোগাড় করে পাঠিয়েছিলাম যাকে, তার কাছ থেকে এই খবরটুকু পাওয়াও অনেক! কেউ বলতেই পারেন, আঁধার নিয়ে রোমান্টিকতা চলে না, সে নিজের না-বাচকতা নিয়ে বড় রুক্ষভাবে বাস্তব। সে আঁধারকে অস্বীকার করতে চাইলে রাত-ছাড়া দিনের কথা ভাবতে হয়, পৃথিবীর, জীবনের একটা দিকের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে হয় তা কি আদৌ সম্ভব?   

অন্ধকার আলোর চেয়ে অনেক বেশি জমাট, কঠিন, তাই সে বাস্তব, এ কথা যদি মেনেও নিই, তাহলেও বলতে হয় - সে বাস্তবকেও কি ধরা যায় না গানে? ‘মেঘে ঢাকা তারাছবিটা যতখানি চলতে চলতে মেয়েটির চটি ছিঁড়ে যাওয়ার ওই দৃশ্যের জন্য মনে থাকে, বোধহয় তার চেয়েও বেশি করে মনে থাকে যে রাতে মোর দুয়ারগুলির জন্য। এ গান ঝড়ের গান, ভাঙনের সামনে বুক পেতে দেওয়ার গান তো অবশ্যই, কিন্তু অন্ধকারের গানও কি নয়? একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় এ গান একান্তভাবেই আমার’, যে আমিথেকে আমাদেরহয়ে ওঠা একইসাথে খুব সহজ আর খুব কঠিন। ঝড়ে কার ঘর ভাঙে? যে বা যারা কুঁড়েঘরের মানুষ। তারা তুচ্ছ, অত্যাচারিত, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও বাঁচার শেষ লড়াইয়ের জন্য টিকে থাকতে চাইলে - ঝড় যে তোমার জয়ধবজা- একথা ভাবার দুঃসাহস ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই ভাঙল’, ‘ঝড়ে’, ‘জয়ধ্বজাশব্দগুলোয় নাটকীয় অভিব্যক্তি। যদি ছবির নিরিখে ভাবি, ঝড়ের পরদিনের যে সকাল তা কিন্তু তেমন কোন সান্ত্বনা বয়ে আনে না, অন্তত প্রধান নারীচরিত্রটির জন্য। তাই সকালবেলা চেয়ে দেখি / দাঁড়িয়ে আছো তুমি এ কিকথাগুলো দীর্ঘশ্বাসের, হাহাকারের মত শোনায় শেষপর্যন্ত।

এ ছবি, এ গান, এ গায়ক এবং তাঁর সহশিল্পী নিঃসন্দেহে অতুলনীয় তার বা তাঁর, বা তাঁদের নিজস্ব পরিসরে। কিন্তু মেঘে ঢাকা তারার বাইরেও তো যে রাতে মোর দুয়ারগুলির একটা বৃহত্তর পরিসর আছে। সেখানে আর একজন শিল্পী, তাঁর এক বা একাধিক শ্রোতার কাছে গানটিকে যদি করে তোলেন বিশেষ করে অন্ধকারের গান’, যদি ভাবান একটু অন্যভাবে? ঝড়টা তো এসেছিল আগে, গানের মুহূর্তে নয়, তাই ঝড়ের আওয়াজ, দরজা ভেঙে যাওয়ার কথা চলে যায় অদূর  অতীতের স্মৃতিতে, আর কেন্দ্রে চলে আসে অনেক বেশি করে সেই বিপর্যয়ের অভিঘাত যা অন্ধকার রূপে ঘিরে ধরেছিল সংকটে, যন্ত্রণায় দীর্ণ অস্তিত্বকে। নিভে গিয়েছিল প্রদীপ, ঘরে  তেলটুকুও ছিল না আবার জ্বালিয়ে নেওয়ার মত তাই সব যে হয়ে গেল কালোর উচ্চারণ যেন তুলে আনে অন্ধকারের ক্যানভাসেও স্পষ্ট একটি ছবি, ভাঙা কুঁড়েঘরের সীমা ছাড়িয়ে আকাশ-পানে হাত বাড়ানোর ছবি। অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি”— এই পড়ে থাকার, সব হারাবার বেদনা ভুলে উঠে দাঁড়ানো বড় সহজ নয়,  যদি না আজ সেই পেরিয়ে আসা আতঙ্কের, ভাঙনের স্মৃতির জায়গা নেয় উপলব্ধি — “দাঁড়িয়ে আছো তুমি এ কি / ঘর ভরা মোর শূন্যতারই বুকের পরেআজ সকালের আলো যা দেখিয়ে দিল, তা কিন্তু ঘটে গেছে বিপর্যয়ের অন্ধকারেই আবর্তনে ফিরে আসেজানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে।এ তো শুধুই ভাঙনের বা অন্ধকারের গান নয়বাগেশ্রীর মীড়ে তুমিকে পাওয়ারও গান!                                                  

অন্ধকাররবীন্দ্রনাথের গানে কোন বিষয় বা উপ-পর্যায় হয়ে ওঠে না — ‘গান’, ‘বিরহ’, ‘বন্ধু’, ‘পথবা অন্য কিছুর মত। অন্ধকার বরং এক ব্যাপ্তি, যা কখনও অব্যক্ত প্রেমকে ঘিরে রাখা ছায়ার মত, কখনও ঘন কুয়াশার মত, কখনও নিবিড় ঘন রাতের মত। মেঘবরণ তুঝ মেঘ জটাজূট’-র বর্ণনায় অনেক আগেই মরণ আর অন্ধকারের সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার আভাসমাত্র দিয়েছেন শ্যাম, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো অন্ধকারের পর্দা ওঠে না। তার জন্য পেরিয়ে আসতে হয় আলোর আর্তি — “কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো!আবার কোথাও আঁধারকে পরম সত্যের এক রূপ বলে মেনে নিলেও, তার লীলায় মেতে ওঠার মত ভাব তখনও জাগেনি, বরং নীরবতা, একাকিত্বের বোধই তখন বড় হয়ে দেখা দেয় — “একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে।এই আঁধারকেই আবার দরকার হয় দুখ জাগানিয়াকে বিরামহীন গান শোনানোর দায় মোচনের জন্য — “এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে, তরী এল তীরে / তবু আমার হিয়া বিরাম পায়নাকো—” কখনও বা আঁধার হয়ে ওঠে সৃষ্টির বেদনা-উপশমের একমাত্র আশ্রয়, ইমন-পূরবীর গন্ধে মাখা সন্ধ্যা-মায়ের আঁচল — “সন্ধ্যা হল গো, ও মাঅতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করোছড়ানো এই জীবন তোমার আঁধার মাঝে হোক না জড়ো।     



গীতাঞ্জলি-পর্বে এবং তার পরেও লেখা বেশ কিছু গানে আছে অন্ধকারকে বাধা, বেদনা, সংশয়ের অনুষঙ্গে দেখতে চাওয়া বিশেষ করে মনে পড়বে দাদার কীর্তিছবির কল্যাণে অমর হয়ে যাওয়া সেই পরিবেশন — “এই করেছ ভালো।জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, আঘাত দাও তবু অন্ধকারে মোহে লাজেতোমার থেকে আমায় আড়াল করে রেখো না। এ গান কবি লিখছেন আটচল্লিশে দাঁড়িয়ে। অনেক পরে, চৌষট্টি বছর বয়সে লেখা গান — “আর রেখোনা আঁধারে” — মনে হতে পারে একই ভাবের। কিন্তু সেই একই শিল্পীর কণ্ঠে দুটি গান শুনলে ধরা পড়ে, “এই করেছ ভালোর দহন-কামনা আর নেই, নিজেকে কালোবলার দীনতা নেই, ‘তুমি আমার সব কালোকে আগুন করে তোলো’ — আর বলা হচ্ছে না, বরং তোমার মাঝে আমার আপনারেদেখতে দেওয়ার দাবি রূপ নিচ্ছে স্বরক্ষেপণে, অভিব্যক্তিতে। এ গানের কালো নিশ্চিতভাবে খারাপনয়, এ কেবল এক মায়ার আবরণ, যা আপন বলে ভুলায়। কিন্তু সেই আঁধারের পারেই লুকিয়ে আছে আলো — “যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে” — পা তে শেষ হয়ে, সেখান থেকেই বারে বারে, নানান সুরে আবর্তন — “...আপনারে দেখতে দাও।প্রায় কাছাকাছি সময়ে লেখা পথে যেতে ডেকেছিলে’ — এখানেও নিবিড় নিশির অন্ধকারে পথ দেখা যায় না, কিন্তু ডাকের উত্তরে সাড়া এলে, সে অন্ধকার থেকেই আসবে, একথা জানা — “সাড়া দাও, সাড়া দাও, আঁধারের ঘোরে।আঁধারকে আসলে ভয় নেই, ‘তুমিপাশে আছ কিনা বোঝা যাচ্ছে না সেইটুকুই চিন্তার।             

এভাবেই গীতাঞ্জলি-উত্তর পর্বে দেখি অন্ধকারের সঙ্গে যেন কবির একটা বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। একটু ভয়, একটু সংশয়, কিন্তু ভালবাসা অনেকখানি। যখন তুমি বাঁধছিলে তার” - এ রাত বা আঁধারের ভূমিকা মাত্র দু লাইনে, কিন্তু সুর বাঁধার জন্য সেই অন্ধকারই যেন যথার্থ সময়। আর দেরি সইছে না, “আর বিলম্ব কোরো না গো, ওই যে নেবে বাতি।কান পেতে থাকা আঁধার রাতকে আর ভয় পান না কবি, বরং ভালবেসে ফেলেছেন তাকে, তা নইলে দুয়ারে মোর নিশীথিনীকথাগুলোর সুর প্রায় পুরোটাই বেঁধে রাখেন কোমল পর্দা স্বরগুলোকে দরদে ভরিয়ে দিয়ে যাতে গাইতে পারেন সচেতন শিল্পী! রাত নামছে, আঁধার হচ্ছে ঘন, এখনই তো সাহানার মরমিয়া সুর বাজানোর কাল — “সেই সুরে মোর বাজাও প্রাণে তোমার ব্যাকুলতা।

প্রায় একই সময়ে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে লেখা আর একটি গান — “শুধু তোমার বাণী নয় গোআচার্য  শৈলজারঞ্জন বলেছেন, এ গানের সমস্ত ভাবরূপ এসে মিলেছে পরশশব্দটিতে। তাঁর কথা মাথা পেতে নিয়েও, শ্রোতা হিসেবে ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা একটু বলা যদি দোষের না হয়, তাহলে যোগ করতে চাই শুধুপরশনয়, এ গানের সবটুকু ভাব নিয়ে ফুটে উঠেছে ঠিক মাঝখানের লাইনটি  এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়োকাল রাতের বেলা গান এলতে আলো, গান আর আঁধারের মধ্যে যেন এক মজার লুকোচুরি চলছে। রাতের অন্ধকারে, যখন কেউ ছিল না পাশে তখন গান এল প্রাণে। ভোরবেলা তাকেশোনাব মনে করে রেখে কিনা দেখা গেল, তখন সে গান আর আসে না। গতকাল রাতের আঁধার এমনি করে ভালবেসে ঠকিয়ে গেলে তো আর রাগ বা দুঃখের জায়গা থাকে না, বরং ভৈরবী সুরে একটু হেসেই নিতে হয় কবি, শিল্পীকে।

আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনিগানটি যেন আরও জোরালো সাহানা-সুরের সওয়াল করে অন্ধকারের হয়ে — “যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে আঁধার-আলোর দুমুখো শত্রুতার বাঁধা ছক ভেঙে পড়তে থাকে। প্রতি স্তবকের শেষে শিল্পী যখন ফিরে ফিরে গাইতে থাকেন, ‘আমি জ্বালব না’—‘জ্বালবআর না’-র মাঝের বিরামহীন বিরতিটুকু যেন তোলা থাকে আঁধারকে জড়িয়ে ধরার জন্য।দীপ নিবে গেছে মমগানেও সেই অন্ধকারে রজনীগন্ধার গন্ধ চিনে আসার ডাক দেওয়া হয় পরাণসখাকে। এ গানও এক-এক জন এক-এক রকম ভাবে প্রাণে ধরতে পারেন একজন দীপ নিবে গেছে বলে দীর্ঘশ্বাসে ভরিয়ে দেন বাতাস, ‘যেওনা ফিরেতাঁর গলায় হয়ে ওঠে ব্যাকুলতা। আর একজন দীপ নিবলেও গান গেয়ে জেগে থাকেন প্রহরে প্রহরে, বিশ্বাসের জোরে। একজন অপেক্ষায়-নিবেদনে ক্লান্ত হয়ে প্রায় ধরেই নেন, শেষরাতে তাঁর সুর ফুরিয়ে যাবে। অন্যজন এত সহজে হার মানতে রাজি নন! উত্তেজনা, একটু আশঙ্কা থাকলেও, এক শ্বাসের টানে সে-সব মিলিয়ে নিয়ে শেষ সম্ভাবনার দরজাটা খুলে রাখেন—“যদি রে…”আমি গান গেয়ে জেগে থাকব, তাও যদি শেষরাতে আর না পারি, তবু তোমায় আসতে হবে। সারারাত জাগিয়ে রেখে গান গাইয়েছ, তার দাম নেই?

পরাণসখা যদি সত্যি নিরপেক্ষ হন, দুজনের ঘরেই কিন্তু তাঁকে আসতে হবে, উপায় নেই।  

আঁধারকে আপন করে নেওয়া শুধু পূজা বা প্রেমের গানেই নয়, প্রকৃতি বা বিচিত্র পর্যায়ের গানেও দেখা দিয়েছে বারে বারে। কালো হরিণ চোখ’-এর ভাষা না হয় কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখে চোখ পড়ার মায়া তৈরি করে, কিন্তু আঁধার সবসময় এত স্নিগ্ধ নয়। কালো?’ ডাকের অতল মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতে, ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’-র মত একখানা গান হাম্বীরের ঝোঁকে আর দ্রুত লয়ের ছন্দে নাড়িয়ে দেয় রীতিমত। এমন দুর্যোগ, ঘন আঁধারের মাঝে কে এসে দাঁড়াল, যার জন্য সব বিপদ তুচ্ছ করে বাধা কেটে বেরোতে হয়! এই কি সেই সিন্ধুপারের রহস্য-প্রিয়া, যাকে শেষপর্যন্ত জীবনদেবতার সাথে এক করে দেখতে হয়? প্রকৃতি-বর্ষা পর্যায়ের এ গান শুনলে যেন মনে হয় প্রথম যৌবনে লেখাশাঙন গগনের পরিপূরকএতকাল প্রকৃতি ছুটেছে ঘোর দুর্যোগে পথের কাঁটা মাড়িয়ে পুরুষের অভিসারে, এতদিন পরে বুঝি পালাবদল না কি অন্ধকারের অনাদি অরূপ রহস্যের মাঝে পুরুষ-প্রকৃতির ভেদ ভুলিয়ে দেবার আগের মুহূর্তেই আসে এমন ‘কঠিন বাধা লঙ্ঘনে’র ডাক?

একই সঙ্গে মনে পড়ে যায় আর এক বর্ষারাতের গান, ‘সঘন গহন রাত্রি’, মেজাজে যদিও অনেক আলাদা। রাতের নিস্তব্ধতা, অন্ধকারের গভীরতা, তার মাঝে একটানা বৃষ্টির শব্দ যেমন জমাট বাঁধে এক-একটি পর্দায় অনেকক্ষণ সুর ধরে রাখার গুণে আর ভারে, তেমনি আবার ‘বিরহিণীর অশ্রু’বেদনায়, ‘মায়ালোক হতে ছায়াতরণী’ ভাসিয়ে দেবার মধ্যে আঁধারের স্বপ্নিল রূপ ধরা দেয় বুঝি প্রেম আর বিচিত্রের আভাসে।        

আলো আর আঁধার যখন মিলেমিশে যায় এক অপার আনন্দের রাজ্যে, কবি তখন লেখেনদিন যদি হল অবসান কিন্তু এ গান অবসানের নয়, বাইরেরকর্মের কলরবশেষে অন্তরে নতুন করে আহ্বান শুনতে পাওয়ার। রাত্রি নিজেই মঙ্গলের বার্তা নিয়ে জ্বেলে দিয়েছে উৎসববাতি, কিন্তু এ বাতির আলো দেখা যায় না বাইরে থেকে “চিত্ত-আসন দাও মেলে, নাই যদি দর্শন পেলে / আঁধারে মিলিবে তাঁর স্পর্শ / হর্ষে জাগায়ে দিবে প্রাণ।” জোর করে দুঃখের আবেগ মাখিয়ে গাইলে এ গানের আত্মা যায় হারিয়ে। অনেক দেরি হলেও সে কথা বুঝিয়ে দিতে ভোলেন নি যিনি, তাঁর উদ্দেশে অভিমান করে বলা যায়, তাঁরই গানের সুরে “কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে।”  

আরও আছে। ‘আমার আঁধার ভালো’, ‘নিবিড় ঘন আঁধারে’, ‘যেতে যেতে একলা পথে’, ‘আমার দিন ফুরাল’, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম’... অনেক, অনেক। গুনতে গেলে হারিয়ে যাবে খেই। যাঁদের গলায় এসব গান বারে বারে শোনা, তাঁদের সবার কাছে ঋণের বোঝা জমাতে জমাতেই এতদিন ধরে একটু একটু করে আঁধার পেরিয়ে হেঁটে চলার চেষ্টা। ঋণের কথা শুধু ওঠে না একজনেরই কাছে। সেখানে জোর চলে, দাবি চলে। বলা চলে, “আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ অন্ধ করা / তোমার পরশ থাকুক আমার হৃদয় ভরা।”              

এ গান শুনেই অন্ধকারকে প্রথম ভালবাসতে শেখা। ‘অন্ধকারের রাজা’কে সেই তো আসতে হয়েছে ‘বিজন ঘরে নিশীথ রাতে’, বলিয়ে নিতে হয়েছে “জানি বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি।”              

 

1 টি মন্তব্য: