সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

মেঘ অদিতি

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৩


গ্লেসিয়ার


ভীতুদের কখনও ভুল করেও পাহাড়ে বেড়াতে যেতে নেই। পাহাড় আঁকতেও নেই। ভাবতেও নেই। তবু অনিচ্ছাতে কত কী যে ঘটে!

নিজেকে ভীতু জানি। সেই আমাকে দু’রকম ভাবে সে উচ্চতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রতিবারই নিজেকে যতটা খর্বকায় লেগেছে তার চাইতে বেশি সমস্যা  হয়েছে বুকের ভেতর একটা করে হিমবাহের জন্ম হওয়ায়।

আজিমপুরের চায়নাবিল্ডিং তেমন এক পাহাড়। এ জনপদে বিয়ের পর পা রেখেই মনে হয়েছিল উঁচুতে থাকলে মানুষ কেমনতর যেন অচেনা হয়। পাঁচতলার মিঙ্কিকে দেখতাম অর্ধেক শরীর ঝুলিয়ে তিনতলার বারান্দায় আমার বর রিকির সাথে কথা বলত। মিঠুদিরা পাশের সবুজ দরজা দিয়ে আসত যেত। কথা বলত না। কচ্ছপ আকৃতির গাড়িগুলো স্লো-মোশনে বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে ঢুকত,  বেরুত। মা শিখিয়েছিল, ওগুলো ভক্সওয়াগেন। পিকু বলল, ধুর, ভক্সওয়াগেন  আবার কীরে! বাবা বলত ফোক্সভাগেন। বেশ তাই সই। যা বলছিলাম, যে উচ্চতায় দাঁড়ালে ভীতুরা যানবাহনকে পিঁপড়ে বা খেলনাগাড়ি মনে করে অবাক চোখে চেয়ে থাকে, তারাই আবার অতল খাদের কথা ভেবে পরমুহূর্তে ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। সেভাবেই চায়না বিল্ডিংয়ের এক বড়ভাই যাকে দেখতে ঠিক রাজ্জাকের মতো তার সাথে একদিনই বলাকায় ম্যাটিনি শো’তে পাশাপাশি বসেছিলাম। বিশ্বাস করুন, আকাশটায় সেদিনই চির ধরল।

জোরালো শব্দে ধেয়ে এল, ডিভোর্স। পাহাড় থেকে সজোরে ধাক্কা, খাদে। আর পিকুর কী হাসি! এবং এক গ্লেসিয়ারের জন্ম।

তাকে বুকে করে চলতে চলতে পাক্কা বছর দশ কী করে যে কেটে গেল! ফের  নতুন করে বাঁচব বলে আবার যখন বান্দরবান থেকে ২২০০ ফুট উঁচুতে নীলগিরির দিকে তাকাচ্ছি, বলে উঠলাম, গাড়িগুলো খেলনাগাড়ির মতো। আমার সঙ্গী, জন। মাত্র দু’সপ্তাহের আলাপে দু’জনে বেরিয়ে পড়েছি। খেলনাগাড়ি শুনে সে সকৌতুকে আমার দিকে তাকাল। বলল, আমাদেরকেও দূর থেকে তাই মনে হচ্ছে ম্যাডাম!

পিকু হাসে। কানে-কানে বলে, তোর এই কেসটাও ঘেঁটে গেল। বুকের ভেতর ধুপ করে কী একটা শব্দ হয়… পিকুটা না! কী বলব ওর কথা। কখন কোথা থেকে  যে উদয় হয় বোঝা দায়। ছোটবেলায় বাবা-মার সাথে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে পিকু আর ফেরেনি। সেই থেকে পিকু সবার কাছে নেই হয়ে গেছে। কিন্তু কী অদ্ভুত কাণ্ড, ও আমাকে কখনই ছাড়েনি। পিকু কে? বলিনি, না? পিকু হলো, একই সময়ে জাত আমার সহোদর।

পিকু আবার কথা বলে ওঠে। গাড়িগুলো পিলপিল করে এঁকেবেঁকে কেমন করে চলছে দেখেছিস? যদি পড়ে যায়? জানেন, সেবারে পিকুর সাথে পিক-আ-বু খেলছিলাম তো আমিই। কখন যে পাহাড়ের ধারে চলে গেছিল ও… আমি তাকে ছুঁয়ে দিতে দৌড়ে আসছিলাম বিপরীত দিক থেকে…

পিকু, প্লিজ, বিলিভ মী! ইচ্ছে করে তো নয় বল… পিকু খ্যাকখ্যাক করে হাসে।  আর আমি দু’চোখ বুজে জনের হাত খুঁজি। ভেতর-ভেতর তৈরি হতে থাকে আরও একটা গ্লেসিয়ার। গালে চকাস করে একটা চুমু খায় পিকু। বলে, পড়ে গেলে আমার মতোই সোজা, খাদে, আসবি?

আর অমনি গ্লেসিয়ারটাও ভেঙে পড়ে, সশব্দে…


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন