সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জহর আলি

 

সমকালীন ছোটগল্প


সমীকরণ

 

কী বলছিস তুই? এওকি কখনো সম্ভব?

অলক বক্তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একটু হাসে। তাতে হাসি কম যন্ত্রণা অনেক বেশি। বক্তা দেখেও না দেখার ভান করে বলতে থাকেন, এতগুলো লোক তোর ওপরে নির্ভর করে আছে, তোকে বিশ্বাস এগিয়ে এসেছে, আর আজ তুই বলছিস তুই ওদের সাথে থাকতে পারবি না? এই সংগঠন তোর ওপর কতটা নির্ভরশীল তোর চেয়ে বেশি আর কে জানে? তার পরেও তুই এমন কথা ভাবলি কী করে? একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। এত বছরের সিগারেটের নেশা কিছুদিন হল ভালভাবেই তার প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু সিগারেট ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

একটু দম নেওয়ার ফাঁকে তিনি অলককে লক্ষ্য করতে থাকেন। একসঙ্গে এত বছর কাজ করার সুবাদে দুজনেই দুজনকে ভালভাবে চেনেন। তিনি জানেন অন্যের কথা শেষ হওয়ার আগে, নিজের বক্তব্য ভাল করে গুছিয়ে না নিয়ে অলক মুখ খুলবে না,  আর অলক তো তাঁর হাতেই তৈরি। সেও জানে যে কোনো বিষয়কে সব দিক থেকে বিশ্লেষণ না করে সমরেশদা শেষ করবেন না। তার মতো অনেক ছেলেরই তাঁর হাতেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে। ফাঁকি দিয়ে তিনি রাজনীতির পাঠ শেখাননি।  আদর্শ শিক্ষকের মত ধৈর্য্য ধরে একটু একটু করে বুঝিয়ে তাদের কাছে টেনেছেন। তাঁর সময়ের পার্টি কর্মীদের মত রাজনীতির নেতা হওয়ার চেয়ে রাজনীতির শিক্ষক হওয়াই তিনি বেশি পছন্দ করেছেন।

দ্যাখ অলক, তোর নিজের হাতে গড়া এই সংগঠন - এবারে সমরেশদাকে শেষ করতে না দিয়ে অলক বলে ওঠে, না সমরেশদ্‌ এটা ঠিক হলো না। এই সংগঠন আমার হাতে নয় তোমার হাতে গড়া। বীজ পোঁতা, সময়মত জল দেওয়া, সার দেওয়া সবই তোমা‌র, আর তাতেই আজ আমাদের সংগঠনের এই প্রতিষ্ঠা। তার   পরে আমি যেটুকু করেছি সেটাতেও তোমার অপ্রত্যক্ষ অবদান কতটা সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। তাই তোমার ওই কথাটা আমি মানতে পারলাম না। হাতের ইশারায় অলককে থামিয়ে সমরেশদা বলতে থাকেন, গত সপ্তাহের  কর্মসমিতির সভায় আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা এক কথায় বলতে গেলে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। অন্ততঃ আমাদের মত সংগঠনের পক্ষে তো বটেই। আর এই এক সপ্তাহ ধরে সদস্য সমর্থকদের বোঝানো, সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা আর দীর্ঘস্হায়ী আন্দোলনের জন্য মানসিক ভাবে তৈরি করার জন্য তুই যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছিস তা তোর পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি বলেই বলছি,  এটা আমি কেন আমাদের সংগঠনে কেউই পারতো না। তোর সততা, নিষ্ঠা, ব্যবহার, পরিশ্রম করার ক্ষমতা আর রাজনৈতিক সচেতনতা এই সংগঠনকে নতুন উচ্চতায় তুলেছে, আর তারই ফল এই দীর্ঘস্হায়ী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি। আগামীকালের সাধারণ সভায় এই নিয়ে আলোচনা হবে আর আমরা সবাই জানি সদস্যরা তোর মতকে সমর্থন জানিয়ে এগিয়ে চলার পক্ষে রায় দেবে। আর আজ রাতে তুই আমার বাড়িতে এসেছিস এই কথা বলতে যে, তোর পক্ষে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয় আর তুই সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করছিস?

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে সমরেশদা হাঁপিয়ে গেছেন দেখে অলক একটু অপেক্ষা করে। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে­, সমরেশদা, রাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন সবকিছুই আপনার কাছে শেখা। আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতার আমি ভক্ত বরাবরই। আজকেও আপনি যা বললেন তার সবটাই ঠিক, এমনকি শেষের কথাগুলোও। তা সত্ত্বেও আমি মনে করছি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা  আমার নেই। আপনি যখন আমার সততা, নিষ্ঠা, ব্যবহার, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, রাজনৈতিক সচেতনতার কথা বলছিলেন তখন আমি ভয় পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, সমরেশদা আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছিলাম পাছে আপনি নৈতিকতার কথা বলেন। সেই মুহূর্তে ঐ শব্দটা আমার মনে আতঙ্ক তৈরি করছিলো। আমার ভাগ্য ভালো আপনি  ঐ শব্দটা ব্যবহার করেননি। একেই হয়তো ভাগ্যের পরিহাস বলে। যে শব্দটা আমি শুনতেও ভয় পাচ্ছিলাম আমাকেই সেটা বলতে হচ্ছে। সমরেশদা এটাই বাস্তব যে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার নৈতিক অধিকার আমার নেই, তাই কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে, শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে এই আন্দোলনের সাথে আমি অবশ্যই থাকব, কিন্তু নেতা হিসেবে থাকতে পারি না। তাই সাধারণ সম্পাদকের পদ  থেকে অব্যাহতি চেয়েছি। আপনি এর চেয়ে বেশি কিছু না জানতে চাইলেই ভালো হয়।

অলকের কথার বিষয়বস্তুতে অবাক হলেও উপস্হাপনায় তিনি অবাক হননি। তিনি জানেন কম কথায় নিজের বক্তব্য গুছিয়ে বলার ক্ষমতা অলকের অসাধারণ। একই কাজ এত বছর ধরে করার পরেও তিনি নিজে এরকম পারেন না। ভালভাবেই বুঝতে পারছেন যে অলক অনেক ভেবে তবেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা পাল্টানো প্রায় অসম্ভব, তবু আন্দোলনের স্বার্থে, শ্রমিকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে  তাঁকে চেষ্টা করতেই হবে। বিশেষ করে অলকের কথা ভেবে। ওর মত প্রতিভাবান ছেলেকে এইভাবে হারিয়ে যেতে, আর বিশেষ করে হেরে যেতে দেওয়া যায় না। একটু ভেবে নিয়ে তিনি আবার শুরু করেন, অলক তোকে আমি শুধু ভালবাসি তাই না, তোর অনেক গুণের জন্য বয়সে ছোট হলেও তোকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাই তোর এই ব্যবহারের কারণ জানতে চাইবো না, কিন্তু কয়েকটা কথা বলতে বাধ্য  হচ্ছি। এতটা এগিয়ে এসে যদি শেষ সময়ে তুই সরে যাস তাহলে নানারকম কথা উঠবে। কেউ বলবে তুই— আবার মাঝপথে সমরেশদাকে থামিয়ে দিয়ে অলক বলে ওঠে, আমি জানি সমরেশদা, গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে সুবিধাবাদী, মালিকের দালাল সব রকমই শুনতে হবে। যারা বলবে তাদের দোষও দিতে পারি না। এই রকম অবস্হায় পড়লে হয়তো আমিও অন্যের নামে একই কথা বলতাম। তবু বলছি সমরেশদা, আমি নিরুপায়।

সমরেশদা নীরবে পায়চারি করতে থাকেন। অলক মাথা নীচু করে বসে থাকে। অনেকক্ষণ পরে তিনি বলে ওঠেন, অনেক রাত হয়েছে অলক, এখন বাড়ি যা। কাল সকালে  একবার আয়। তবে আরো একবার ভেবে দেখিস। যদিও সে কথায় যে জোর ছিল না তা তাঁর নিজের কানেও ধরা পড়ে। কোনো কথা না বলে অলক ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ে।

এখন প্রায় মাঝরাত। শরতের মাঝভাগে এসেও গ্রীষ্মের প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরোনো যায়নি। অবশ্য অলকের মনের যা অবস্হা তাতে ভরা শীত হলেও হয়তো একই রকম লাগতো।

গত একমাস ধরে অলক অত্যন্ত ব্যস্ত। দুবছর আগে কোম্পানির ইউনিয়নের সম্পাদক হবার পর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কারখানা আর অফিস মিলিয়ে প্রায় আটশোজন কর্মী। এছাড়া আরো শ’তিনেক অস্হায়ী কর্মী। অলক সাতবছর আগে চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই লক্ষ করেছে, অস্হায়ী কর্মীদের স্হায়ী করার   ব্যাপারে কোম্পানির নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। ছয় সাতবছর কাজ করার পরেও অনেকেই অস্হায়ী থেকে গিয়েছে। অবশ্য যারা ঠিক জায়গায় ধরাধরি করতে পারে তাদের জন্য অন্য নিয়ম। ব্যাপারটা বুঝতে অলকের একটু সময় লেগেছিল। আসলে অস্হায়ী কর্মীদের অনেক কম মাইনে দিয়ে বেশি কাজ করানো যায়, আর স্হায়ী চাকরির বাকি সুযোগ সুবিধা তো তাদের ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে ছোট কোম্পানি হওয়ার জন্য গ্রেড রিভিশনেরও নির্দিষ্ট কোন পলিসি নেই। পারিবারিক মালিকানা ভিত্তিক কোম্পানি হওয়ার ফলে পুরো ব্যাপারটাই খুব ঢিলেঢালা। কিছুদিন ভালভাবে ব্যাপারগুলো লক্ষ করার পরে আর সমরেশদার সাথে বারবার আলোচনা করার পরে অলক বুঝতে পেরেছে, এটা পুরোটাই মালিকপক্ষের পরিকল্পিত চাল। এছাড়া লিখিত সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও এত ফাঁকফোকর রয়েছে সময়মত সেগুলো না পাওয়াটাই নিয়ম। পেলে সেটাকে ব্যতিক্রম ভাবতে হয়। গত ছ’মাস ধরে অলক এগুলো নিয়ে অনেক খেটেছে। একদিকে মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা করে ন্যায্য পাওনাগুলো আদায়ের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে বৄহত্তর লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু  করেছে। এ কাজে সমরেশদা ওর প্রধান ভরসা। মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা যথারীতি ফলপ্রসূ হয়নি ফলে ধর্মঘটের পথে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অলক এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমোতে যাওয়া ছাড়া বাড়ির সঙ্গে প্রায় সম্পর্কই ছিলো না।

মা, বাবা আর ছোটভাই তাপসকে নিয়ে ওদের চার জনের সংসার।মা স্হানীয় একটি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। দু’বছর হল রিটায়ার করেছেন। মায়ের রিটায়ারমেন্টের পরে বাবা এখন ঐ স্কুলকমিটির সেক্রেটারী। অনেকদিন ধরেই উনি স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য। তিনি অবশ্য কোন পারিশ্রমিক নেন না। এর আগে বাবা অলকদের কোম্পানির মালিকের অন্য একটা কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে কাজ করতেন।

অলকের ভাই তাপস এম বি এ পাস করে দু’বছর হল নিজের ব্যবসা শুরু করেছে। কম্পিউটার হার্ডওয়ারের। এছাড়াও কিছু কিছু সাপ্লাই এর কাজ করে। মনে হয় ওর ব্যবসা ভালোই চলছে। কিছুদিন থেকেই একটা কথা ওর মাথায় ঘুরছিল। বাবা স্কুলকমিটির সেক্রেটারী হওয়ার পরেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক আর ইউনিফর্ম সাপ্লাই করার অর্ডারটা অনেক বছর পরে হাতবদল হয়। যিনি পেয়েছেন তিনি বাবার বন্ধুর ছেলে সুবীর। সুভাষকাকু বাবার অনেক পুরনো বন্ধু। তাপসকে ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি করার সময় উনি বাবাকে বেশ কিছু টাকা ধার দিয়েছিলেন। এই দুটো ব্যাপারের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা ভাবছিল। একদিন রাত্রে খাবার টেবিলে বাবাকে জিজ্ঞেস ও করেছিল। বাবা সোজাসুজি কোন উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন সব কোটেশনগুলোই স্কুলকমিটি আলোচনা করার পরে সাপ্লায়ার ঠিক করা হয়। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই যে লোয়েস্ট বিডারকে অর্ডার দিতে হবে তার কোন মানে নেই। একমাত্র সরকারী দপ্তর ছাড়া সব জায়গাতেই এই নিয়মেই কাজ হয়। মা কিছু বলেননি তবে ভাই পুরোপুরি বাবার পক্ষে ছিল আর এই অদ্ভুত নিয়মের ফলে সরকারি দপ্তরে কি ধরনের কাজ হয় সে ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিল। বলাই বাহুল্য তার অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। অলক ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ ঘাঁটায়নি আর পরে ভুলেই গিয়েছিল হয়তো মনেও পড়ত না যদি না মা কথায় কথায় কয়েকদিন আগে বলতেন যে পূজোর পরেই মা বাবা, মঞ্জুকাকিমা আর সুভাষকাকু দক্ষিণ ভারত বেড়াতে যাচ্ছেন। যাওয়া-আসা, ওখানে থাকা আর ঘোরার সব ব্যবস্হা সুবীরই করে দিয়েছে। কথাটা শুনে আচমকা একটা প্রশ্ন মুখে এসে গেল। মা, তোমাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কত? সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা শুনে মা থমকে গিয়েছিলেন। একটু ভেবে বললেন প্রায় তিন হাজার। মা আর কিছু বলেননি। অলকও জানতে চায়নি।

জনা পনেরো স্টাফ নিয়ে তাপসের অফিস। গত শনিবার রাত্রে অফিসের একটা পার্টি ছিল শহরের একটা নামী হোটেলে। মা বাবা না যাওয়ায় অলককে বাড়ির হয়ে যেতে হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশজনকে নিয়ে পার্টি। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল সকলেই হয় কাষ্টমার নয় সাপ্লায়ার। ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্হ অফিসারও কয়েকজন ছিলেন। তাপসের অফিসের কেউই ছিল না। খাদ্য পানীয়ের এলাহী ব্যবস্হা আর হোটেলের স্টেটাস থেকে অলক আন্দাজ করে মোট খরচ ছয় অঙ্কের বেশিই হবে। এছাড়া প্রত্যেকের জন্য আলাদা উপহারের ব্যবস্হা আছে যদিও সেটা এখানে দেওয়া হবে না, কারণ সহজেই অনুমেয়। অলকের অস্বস্তি হচ্ছিল আর রাগও হচ্ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল কেননা তাপস ছাড়া সবাই ওর অপরিচিত আর এই ধরনের পরিস্হিতিতে ও মোটেই অভ্যস্ত নয়। রাগের কারণ আরও প্রত্যক্ষ। ক’দিন আগেই তাপস বলছিল অফিসের কর্মচারীরা পূজো উপলক্ষে অ্যাডভান্স চাইছে। তাপসের রাগের কারণ দশ হাজার করে টাকা সবাইকে দিয়ে পরে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে মাইনে থেকে কেটে নিতে হলে ওকে অনেক টাকা সুদ দিতে হবে। তখনই প্রথম অলক নিজের পরিস্হতি নিয়ে সচেতন হয়। অফিসে আর বাড়িতে তার নিজের ভূমিকায় কী বৈপরীত্য! যদিও ভাইয়ের ব্যবসা সংক্রান্ত কোন বিষয়েই তার কোনো ভূমিকাই  নেই তবুও মন থেকে অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না। তবে ওকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে গতকালের ঘটনাটা। সুমিত্রা ওদের বাড়িতে কাজ করছে প্রায় দশ বছর। সুমিত্রার স্বামী লোকনাথ বাড়ির গাড়ি চালায় আর বাইরের কাজ সামলায়। রান্না করা ছাড়া বাড়ির ভেতরের সব কাজ সুমিত্রা করে। রান্নার জন্য অন্য একজন আছে। কাজের সুবিধার জন্য লোকনাথ আর সুমিত্রার বাড়িতেই থাকার ব্যবস্হা আছে। ক’দিন আগে পড়ে গিয়ে লোকনাথের ডান হাতটা ভেঙ্গেছে। পরশুদিন অপারেশন হয়েছে। এখন অন্ততঃ তিনমাস গাড়ি চালাতে পারবে না। এদিকে একসপ্তাহ আগে সুমিত্রার জণ্ডিস ধরা পড়েছে। ওর পক্ষেও এখন কিছুদিন কাজ করা সম্ভব নয়। রান্নার মেয়েটি তার চেনা একজনকে এনে দিয়েছে। থাকার জায়গা দিতে পারলে তার কাছ থেকে অনেক বেশি কাজ পাওয়া যাবে। তাপসের অফিসের এক স্টাফ মারফত একজন ড্রাইভারও পাওয়া গেছে। তাকে অবশ্য থাকার জায়গা দিতে হবে না, বদলে তাপস তাকে অফিসে চাকরী দেবার লোভ দেখিয়ে রেখেছে। সবদিক বিবেচনা করে লোকনাথ আর সুমিত্রাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু অলক বাড়িতে খুব কম থাকে তাই ও কিছু জানতেই পারেনি। জানার পরে কাল মায়ের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া হয়ে গেছে। মা, বাবা আর ভাই একদিকে আর অন্যদিকে ও একা। বাবা আর ভাইয়ের কাছে সে অন্য কিছু আশা করেনি কিন্তু মা যেহেতু এক সময়ে শিক্ষক সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন আর শিক্ষকদের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন তাই মায়ের কাছে অলক অন্যরকম ব্যবহার আশা করেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা গেল তিনজনেই একমত। যেহেতু ওদের কাছ থেকে এই মুহূর্তে কোনো কাজ পাওয়া যাবে না তাই তাদের চাকরিতে রাখার কোন মানে হয় না। মাইনে ছাড়া চিকিৎসার জন্য কিছু টাকাও দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি দায়বদ্ধতার কোন প্রশ্নই ওঠে না। চেষ্টা করেও অলক বোঝাতে পারেনি দায়বদ্ধতার আইনি দিক ছাড়াও একটা মানবিক দিক আছে। অসুস্হ মানুষকে মাত্র সাতদিন সময় দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু ওদের মত পাল্টানো যায়নি। সেই মুহূর্তে এই তিনজনকে কোম্পানির মালিকদের থেকে  আলাদা বলে মনে হয়নি আর নিজেকেও মালিকপক্ষেরই একজন বলে মনে হচ্ছিল। তখনই অলক প্রথমবার নিজের পরিস্হিতি নিয়ে সচেতন হয়। অফিসে আর বাড়িতে তার নিজের ভূমিকায় কী বিসদৃশ বৈপরীত্য! মনে প্রশ্ন ওঠে মালিকপক্ষের লোক হয়ে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করা কি সত্যিই সম্ভব? বাস্তবতার প্রশ্ন ছাড়া নৈতিকতার প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই সমরেশদার সাথে দেখা করতে যাওয়া। কিন্তু সেখানেও দ্বিধা আর সেই জন্য আসল কারণটা মন খুলে সমরেশদাকে বলা গেল না। সমরেশদা যদিও বললেন পুরো ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে আর কাল সকালে আবার আসতে। অলক জানে না নতুন সকাল নতুন কোন ভাবনা নিয়ে আসবে কিনা! ভাবতে ভাবতে অলক বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।


২টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লাগল। বাস্তব অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ লেখা। জানি না আদর্শ এ খেলায় ৩-১ গোলে বাস্তবের ( শর্ত ও স্বার্থ) কাছে হেরে গেল কি না?

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো। বহুদিন পর 'নৈতিকতা' শব্দটি নিয়ে নাড়াচাড়া হতে দেখলাম। অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন