সমকালীন ছোটগল্প |
হারিয়ে যাওয়া
বিন্ বিন্
করে মাছিটা কানের সামনে ঘুরে চলেছে। মাছির এই বিন্ বিন্ শব্দটা বড্ড বেশি কানে লাগছে, কিছুতেই আঁকাতে মন বসাতে
পারছে না তিতলি। বারো বছরের তিতলির এখন পছন্দের একমাত্র বিষয় হল ছবি আঁকা। ওই বড়দিভাই, মেজদিদি, কিংবা মিঠিদিদির মতো সারাদিন চোখে
চশমা গুঁজে মোটা-মোটা বই পড়তে
তিতলির মোটেই ভাল লাগে না। সোনাজেঠু মানে বড়দিভাই আর মেজদিভাইয়ের বাবা অবশ্য তিতলির
মতোই... আঁকাআঁকি করেন, ঘর জুড়ে কত বড় বড় ছবি, কোনটাতে সুন্দর সুন্দর
পাহাড়, কোনটাতে ঝরণা, আবার কোনটাতে কী সুন্দর সুন্দর মানুষের মুখ! সোনাজেঠু আর্ট কলেজে পড়ান, বড় বড় ছেলে মেয়েদের
আঁকা শেখান। মাঝেমধ্যে আবার বিদেশেও যান, এই তো সেদিন সোনাজেঠু ফ্রান্স থেকে ফিরলেন। কত্ত সুন্দর সুন্দর জিনিস
এনেছিল তিতলিদের জন্য, তিতলি তো সেই থেকেই একপ্রকার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, বড়
হয়ে ও একজন শিল্পী হবে। সোনাজেঠুর মতো দেশে বিদেশে ঘুরবে। রংয়ের প্যালেট আর ওই মোটা
মোটা তুলিগুলো দিয়ে সাদা ক্যানভাস জুড়ে সুন্দর এক একটা ছবি এঁকে ফেলবে সোনাজেঠুর মতোই।
সোনাজেঠু
ফ্রান্স থেকে ফিরে বীরভূমের একটা নাম না
জানা গ্রামে গিয়েছিলেন, তাও মাস তিনেক হল... সেখান থেকে ফিরে গত কয়েকদিন ধরেই সোনাজেঠু কেমন জানি
গুম মেরে গেছেন। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে
বিশেষ কথাও বলছেন না। জেঠিমার
সঙ্গেও না। বড়দিদি তো
স্কুলের প্রোজেক্ট, স্কুলের পরীক্ষা নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। তবে সোনাজেঠু সবসময়ই নিজের ঘরে বসেই থাকেন, আর এঁকে চলেন... মাঝেমধ্যে দরজার ফাঁক
দিয়ে উঁকি মেরে তিতলি দেখেছে সোনাজেঠু এক একটা ছবি আঁকেন, টান মেরে
ক্যানভাস থেকে নামিয়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দেন কখনও সখনও, মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা বিরক্তিভাব।
সোনাজেঠু
এমনটা ছিলেন না... কানের কাছে মাছিটা এখনও বিন্ বিন্ করে বলে চলেছে। তিতলি বুঝতে পারছে, মাছিটা কিছুতেই ওর এই সিনারি আঁকাটা কমপ্লিট করতে দেবে না। কানের কাছে একনাগাড়ে বিন্ বিন্ করে, ঘ্যান ঘ্যান করেই ওকে বিরক্ত করে চলেছে।
সেই
কবে থেকে তিতলিদের স্কুলটা বন্ধ। প্রায় মাসতিনেক হতে চলল। বড়দের মুখে তিতলি শুনেছে এখন নাকি বেশ কয়েকদিন স্কুল বন্ধ
থাকবে, একটা দুষ্টু ভাইরাস নাকি ওদের চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু এই দক্ষিণ কলকাতা চত্বরেই কেন… ভাইরাসটা
নাকি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা বিশ্বেই। তিতলি এই ছোট্ট মাথায় ভাইরাস যে কী সেটা অতটাও বোঝে না! তবে কিছুদিন আগেই বড়দিদি প্রোজেক্ট করতে করতে হঠাৎ করেই
চেঁচিয়ে জেঠিমাকে ঘরে ডেকে এনে বলছিল, “মা আমার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকে পুরো প্রোগ্রামটাই উড়িয়ে
দিয়েছে।” হাউ হাউ করে সোনাদিদি
কাঁদছিল। সেদিনই
জেঠিমা গিয়ে পাশের বাড়ির বুকাই দাদাকে ডেকে এনেছিল। বুকাইদাদার ভাল নাম সৌমাভ রায়, বড় ইঞ্জিনিয়র। বড় সফটওয়্যার কম্পানিতে কাজ করে বুকাইদাদা। কিন্তু দাদা তো কত সহজেই কম্পিউটারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা
ভাউরাসটাকে মেরে ফেলেছিল। তাহলে এত বড় বড় ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা কী করছে? ধুত! কোনওটাই মাথায় আসছে না তিতলির। স্কুল খুললে একবার ইন্দ্রাণী
ম্যামকে জিজ্ঞাসা করবে তিতলি।
রং-তুলি
নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করল সিনারিটা শেষ করে ফেলার। মা এরইমধ্যে গরম গরম লুচি
আর সাদা আলুর তরকারি নিয়ে হাজির হয়েছেন। বন্ধুদের সঙ্গে কতদিন তিতলি বাইরে খেলতে যায় না, বাড়িতেই বই পড়ে, গান শোনে। সকালে অন
লাইনে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় বটে কিন্তু বাপির ওই ল্যাপটপে ছোট ছোট বক্সে অর্ক, দীপ্ত, অর্ঘ্য,
রিয়া, সহেলীকে দেখলে কি মন ভাল হয় কারও? কতদিন ক্লাস চলতে চলতে অর্ক ওর চুলের ঝুঁটি ধরে টান
মারেনি, কতদিন ক্লাসের ওই বিচ্ছু ছেলে মৈনাক ওর টিফিন খেয়ে নেয়নি... সব মনে পড়ছিল। মন খারাপ করছিল তিতলির বড্ড।
একটা
অদৃশ্য প্রাণী কেমন করে ওদের রোজকার দিনটাই পালটে দিল না! তিতলি জানে আবার হয়তো একদিন স্কুল খুলবে,
সব হয়তো নর্মাল হবে, শুধু স্বাভাবিক হবে না ওদের বন্ধুদের ছোঁয়াগুলো। রিয়া কিংবা অর্ক ওর জন্মদিনে ওকে জড়িয়ে ধরে আর ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলবে না। টিভিতে, সংবাদপত্রে সবসময়ই এখন বলে চলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। তিতলি অবশ্যও
এখনই অত কঠিন শব্দের মানে বোঝে না, শুধু বোঝে
দূরত্ব মানে ডিসট্যান্স আর কোনও ডিসট্যান্সই মোটেও ভাল হয় না।
এই যেমন
এখন সোনাজেঠুর সঙ্গে কেমন অজানা একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। সোনাজেঠু নিজেকে ওই যে আর্ট স্টুডিয়োতে আটকে রেখেছেন আর তো বাইরে
বেরোচ্ছেন না। খালি যখন
খাবার খেতে ডাকা হয় সোনাজেঠু
আসেন, একটুখানি খান আবার উঠে চলে যান।
“না! এই বিষয়টা একটু ভেবে দেখতে হবে…” নিজের মনের মধ্যেই বলে উঠল তিতলি।
একছুট্টে
চলে গেল জেঠুর স্টুডিয়োতে।
জেঠুর
পরনে তখন সাদা রংয়ের ফতুয়া আর পাঞ্জাবি, একমুখ দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, উসকো খুসকো মুখে কী যেন
তখনও এঁকে চলেছেন...
তিতলি
এমন একটা দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেখান থেকে জেঠুর মুখটুকু দেখা যায়, কিন্তু জেঠু যে ক্যানভাসে
কীসব এঁকে চলেছেন, তা মোটেই দেখা যায় না।
সন্ধে
সাতটা কি আটটা হবে তখন… তিতলি একটু ভয় ভয় নিয়েই বলে উঠল, “সোনাজেঠু তুমি কি ব্যস্ত”…
তিতলির
ডাক শুনে কিছুটা যেন স্থিতধী হলেন জেঠু, উসকো খুসকো গলাতেই বললেন, “না রে মা! বল রে, কিছু বলবি?”
“জেঠু তোমার কী কিছু হয়েছে? মন খারাপ?”
“না রে, মন খারাপ নয়... কিছু বলবি...?”
“না জেঠু, তোমাকে দেখে মনে হল হয়তো কিছু
হয়েছে তাই চলে এলাম, আচ্ছা জেঠু তুমি কী আঁকছো বল তো সারাদিন
ধরে...”
“একবার এসে দেখেই যা না...”
গুটি
গুটি পায়ে ক্যানভাসটার দিকে এগিয়ে গেল তিতলি... ক্যানভাস জুড়ে একটা ধূসর প্রলেপ, জেঠুর কাছ থেকে তিতলি শিখেছে ওই টোনটাকে বলে সেপিয়া টোন। পুরনো কোনও জিনিস, সময়, কিংবা ঘটনা বোঝাতে নাকি বেশিরভাগ
আর্টিস্ট ওই টোনটা ব্যবহার করে থাকে। সেপিয়া টোনের মধ্যে থেকেই তিতলি দেখতে পেল একটা মানুষের অবয়ব... মলিন, ধূসর,
ক্লান্ত, একটা মুখ। যে মানুষটার মুখের চামড়াগুলো ঝুলে গিয়েছে, চোখের রং
ঘোলাটে... তিতলি বয়সে ছোট হলেও বুঝতে পারল যে, সোনাজেঠুর আঁকা ছবিটার মধ্যেকার মানুষটা যেন কোনও
অজানা ভয়ে ভুগছে।
ভাইরাসের
দাপটের থেকেও এই ভয় যেন আরও বেশি ভয়াবহ। যেন কোনও একটা বিষয় হারিয়ে যাওয়ার ভয়।
“সোনাজেঠু ইনি কে গো? তোমার কোনও বন্ধু?”
জেঠু
কোনও উত্তর দিলেন না, একদৃষ্টিতে ছবিটার দিকে চেয়ে রইলেন। তিতলি জানে কখন জেঠুর মন খারাপ হয়, কখন জেঠু
একটুখানি আড়াল চায়। সবটুকু বুঝতে পেরে তিতলি নিজের ঘরে ফিরে গেল।
সিনারিটা
শেষ করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করেই মনে পড়ল, জেঠুর ক্যানভাসে আঁকা
ছবিটা ওর ভীষণই চেনা, যেন অনেকদিন আগে কোথায় ও দেখেছে লোকটাকে। পাড়ার
গলিতেই, নাকি অন্য কোথাও, ঠিক মনে করতে পারছে না ও।
এটা
সেটা ভাবতে ভাবতে নিজের পছন্দের পুতুলটাকে জাপটে ধরে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল তিতলি। সন্ধেবেলাতে ভরপেট লুচি-আলুর তরকারি খেয়েছে বলে মা-ও
তিতলিকে আর ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাওয়াননি।
সকালবেলা
থেকেই বাড়ি জুড়ে কান্নাকাটির আওয়াজ। ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারল বড়দিভাই কাঁদছে, জেঠিমাও... কান্নার আওয়াজে দু’তলায় উঠে গেল তিতলি। দেখল বাবা
গম্ভীর মুখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, এদিকে-সেদিকে ফোন করছে। সুদীপকাকু পুলিশে আছে, বোধহয় ওঁকেই ফোন
করার চেষ্টা করছে বাবা! কানাঘুষো থেকে যেটুকু বুঝল তার থেকে অর্থ উদ্ধার করা গেল যে, কাল রাতের পর থেকে সোনাজেঠু বাড়ি
ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সোনাজেঠু কোথায় গেছেন, কেনই বা গেছেন, তার কোনও
হদিশ নেই। শুধু রয়েছে একটা চিঠি, যাতে লেখা রয়েছে...
“রসুল মাদারিকে কথা দিয়েছিলাম, যে কোনও বিপদেই ওর পাশে থাকব... আজ তো ওর এত বড় বিপদ। ওর ওইটুকু কোলের বাছাকে ওরা কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গেল, এমন
শোক ভুলব কী করে? তোমরা চিন্তা করো না। বীরভূমের
পথটুকু আমার দিব্য চেনা... লকডাউনে গাড়ি নেই তো কী আছে, দুটো পা আছে,
হেঁটে চলে যাব। কত কত মানুষই তো হাঁটছে! আমি আমার প্রাণের বন্ধুর কাছে হেঁটে যেতে পারব না? তোমরা ভাল থেকো। পৃথিবীতে এখন ঘোর অসুখ, পারলে মনের জোরে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখো।”
এইবারে
তিতলির সব হিসেবগুলো একটা একটা করে মিলে যাচ্ছে। রসুল মাদারিকে তো অনেকবার ও ওদের বাড়ির উঠানে দেখেছে। জেঠুর সঙ্গে গল্প করত। তিতলিকে ‘বুলবুলি’ মানে রসুল চাচার আদরের বাঁদর ছানা কতই
না খেলা দেখাত। সোনাজেঠুর মুখেও রসুল চাচার গল্প শুনেছে ও। কিন্তু একটা হিসেব কিছুতেই মিলছে না।
‘কোলের বাছা’-টা কে?’ তাহলে কি বুলবুলিকে কেউ নিয়ে গেছে? কিন্তু কারা? বড়দিভাই একবার বলেছিল, কোনও ওষুধ,
ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পর নাকি
প্রথমে বাঁদর, শিপাঞ্জি জাতীয় প্রজাতির উপর এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। তাহলে কি বুলবুলির উপরেও নেমে আসছে পরীক্ষামূলক গবেষণার
থাবা? সবটুকু কেমন জানি গুলিয়ে যাচ্ছে।
জেঠুর স্টুডিয়োতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে তিতলি। কালরাতে ওমন সাত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে না পড়লে ও হয়তো জেঠুর সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারত। জেঠু চিঠিতে লিখেছে পায়ে হেঁটেই নাকি পৌঁছে যাবে কিন্তু এতটা পথ কেমন করে? কান্না পাচ্ছে, খুব কান্না। তিতলি তো তাও কাঁদতে পারছে, কিন্তু সোনাজেঠু তো কতদিন না কেঁদে সব কান্নাগুলো চেপে রেখে রং-তুলি নিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। আর নিজেকে ভোলাতে পারলেন কই! ক্যানভাসে প্রিয় বন্ধুকে দেখতে না পারার যন্ত্রণাতে বাড়ি ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন।
প্রিয় পুতুলটাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে তিতলি মনে মনে ভাবতে লাগল, আবার দেখা হবে তো সোনাজেঠুর সঙ্গে? নাকি সামাজিক দূরত্বের এই নিয়মের খেলাতে জেঠুও হয়তো অনেক অনেক অনেক দূর সময়ের কোনও মানুষ হয়ে যাবেন...
ভাবনাগুলো
সব আবছা হয়ে গোঙানিতে মিশে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন