সমকালীন ছোটগল্প |
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
চুপচাপ অস্থি-র কাছে বসে আছি, এখনো গ্রন্থিতে মায়া লেগে আছে
- এযাবৎ
এই অব্দি লিখে রাখার পর আর কিছু মনে পড়ছে না। হতে পারে মায়ার এক্সপায়ারি ডেট পার হয়ে গেছে বা টাইপিং হ্যাজার্ডের জন্য মায়া একবার মাথা একবার মায়াবী। এই প্রচেষ্টা উৎসাহ মূলক কারণ এর ফার্স্ট পার্টটা ছিল –‘পিতার মৃত্যু হইলে পর, অমূল্য ঠিক করিল বাটী পরিত্যাগ করিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইবে। উহাদের সহিত আর সে কোনোরূপ সম্বন্ধ রাখিবে না’।
অমূল্য আর আমি এক লোক না। একেবারে আলাদা। কিন্তু অমূল্য একথা মানে না। আমার অস্তিত্ব সে একেবারেই ভুলে গেছে। পৃথিবীর কোনো সম্বন্ধ গোলাপ না। আমি প্রত্যেকটা সম্বন্ধকে এইভাবে জানি। কোনো রিলেশনই আজ অবধি গোলাপ হয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র দুটো জিনিসই এযাবৎ পড়ে আছে পৃথিবী্তে - এক নম্বর - গোলাপ, দুই নম্বর - গোলাপ নয়। কোনো একটা বছর থেকে ২০২০ পৃথিবীর এই ঐতিহাসিক সময়টা বেছে নিলেও কোনো ঐতিহাসিক ইতিহাস এটা নয়। কারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক, এরকম কোনো কবিতা যেমন হয় না, তেমনই কোনো ঐতিহাসিক বা ভৌগলিক লেখা নয় এটা। সুতরাং এর প্রথম পরিচ্ছেদটা তৈরী করা হয়েছিল কেবলমাত্র একটি সমস্যার সমাধানের কথা ভেবে, আর সেটা হলো, সেখানে সেই পরিচ্ছেদেই এমন একটা গদ্য রচনা করতে হবে যা কিনা শুধুমাত্র কবিতারই মুখপাত্র।
‘অমূল্যর পিতা মার্চেন্ট আপিসে কর্ম করিয়া বহু অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন। কলিকাতা শহরে তাঁহার মস্ত তেতলা বাড়ি’। এই মস্ত তেতলা বাড়িটা আর তেতালায় অমূল্যর বেডরুমের সিলিংফ্যান - এরও একটা গল্প আছে যেটা অবশ্যই কবিতা না। প্রতিটা ব্লেডে একটু করে ঢেউ খেলানো ভাব এবং মিহি ধুলোর আস্তরণ, কিন্তু এগুলো তো কোনো সমস্যা নয়, কারণ যার কোনো সমাধান থাকে সেইগুলোই সমস্যা। কিছুদিনের জন্য পৃথিবী যখন বন্ধ হয়ে পড়লো, দেখা গেল অতি বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীর সমস্ত সরলতাগুলোর তিরতির বাড়-বাড়ন্ত, আমাদের জেনেটিক অ-সম্বন্ধের হ্যাপি-এক্সটেন্ডেড বহুস্তরীয় সম্বন্ধের একটা অমিত্রাক্ষর গল্প। তৃতীয় পরিচ্ছেদে আমি তাই গোলাপই রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দিনান্তে অমূল্যর উদাসীন নিষ্ঠুরতা এবং আমার অনিয়ন্ত্রিত ভাবাবেগ কিছুতেই কাঁটা ডালপাতার সবুজাভ ডাঁটিই হলো না তো ঈষৎ ঝুঁকে থাকা ভারী একটি গোলাপ কি করে তৈরী হবে? অথচ এই সংকলনে এগুলিকেই বিশেষত অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। এখন ঘটনা হলো আমার জায়গাটা কিছুতেই নির্ণয় করে উঠতে পারছিলাম না। বিষয়ে ও আঙ্গিকে, যেমন অনেক সময় হয় না গদ্যে লেখা গল্প-উপন্যাসকে একেবারে নিকৃষ্ট আর্টফর্ম মনে করা। কেবলি আমার মনে হত ঐ অর্থাৎ গদ্যের ভাষা যেখানে কবিতার মতো, উপস্থিত বাক্য যখন বাক্যকে এক লাফে ডিঙিয়ে সটান বাক্যের বাইরে চলে যাচ্ছে, শব্দ ও বাক্যের সম্বন্ধ যেখানে কিছুটা নির্ণেয় কিন্তু মূলতঃ অনির্ণে। সুতরাং ধৈর্য সাপেক্ষে গদ্য ততক্ষণ অব্দিই লিখে যাওয়া উচিত যতক্ষণ না তা থেকে কবিতার দ্যুতি বের হচ্ছে । সুতরাং অমূল্যর সঙ্গে আমি পেরে উঠব কেন? তাই পারি কখনও? ও যখনই একবার স্থির করে নিয়েছে ব্যস্… আর না… , ঘূণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি। আগের দিন সারা দুপুর ওর কথার অন্ত ছিল না বরাবরের মতো। কথা কথা কথা। অথচ রাত্তিরেই দেখলাম সোশাল নেটওর্য়াকিং থেকে কখন লগ আউট করেছে, কল রেজিস্টার খালি, ডিপির জায়গাটা ধবধবে সাদা এবং উপসংহারের মতো - ধন্যবাদ সেই সিলিং ফ্যানকে – তারপর সারা রাত সেই ফ্যান ঘুরেছে নিজের মতো, তিনদিন পর আবিষ্কার হল ফ্যান বন্ধ। সেখানে গলায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলছে অমূল্য। গায়ের চামড়ায় পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তো যাইহোক, এখন ঐ দূরে অনেক বোগেনভলিয়া জারবেরার সংগে সম্পূর্ণ শান্ত ও নিস্তব্ধ ভাবে ফুটে আছে অজস্র লাল হলুদ গোলাপ। রক্ত জমাট বাঁধা নেই, হাড় জুড়ে জুড়ে স্কেলিটন তৈরী হওয়া নেই, এপিডারমিস বা ত্বকের উপরিভাগ যতক্ষণ না মসৃণ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মানবশরীর বলা যাবে না হওয়া নেই। রূপ দেখতে দেখতে আমরা রূপেই এমন বিভোর হয়ে থাকি রূপান্তরকে ভুলে যাই। গোলাপ মরে গিয়ে আবার গোলাপ জন্মই নেয়। আজ ফুটেছে, কখন আবার নিঃশব্দে ঝরে যাবে। সরলতার সুদূর থেকে উড়ে এসে উড়ন্ত গোলাপ আবার নির্জন সরলতায় গিয়ে শেষ করবে তার যাত্রা।
গতকাল অমূল্যর অস্থি নিয়ে আসা হয়েছে। চুপচাপ সেখানেই বসে আছি…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন