মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

ফেদেরিকো গারসিয়া লরকা

 

প্রতিবেশী সাহিত্য      

 

পরাবাস্তববাদীদের কবিতা 

 

ফেদেরিকো গারসিয়া লরকা (১৮৯৮ - ১৯৩৬)

(অনুবাদ: মলয় রায়চৌধুরী)

 


স্বপ্নচর রোমান্স

 

সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।

সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা।      

সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ

আর পাহাড়ে ঘোড়াটা।

মেয়েটির সঙ্গে যার কোমর ছায়ায় গড়া

উঁচু বারান্দায় স্বপ্ন দেখি,

সবুজ মাংস, আর সবুজ বিনুনি,

আর জমাট রুপোর চোখ।

সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।

জিপসিদের চাঁদের তলায়

নিঃশব্দ জিনিসেরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে

জিনিসগুলো যা মেয়েটি দেখতে পায় না।

সবুজ, আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।

শাদা তুহিনের বিশাল নক্ষত্রদল

সকালের পথ খুলে দিচ্ছে।

ডুমুরগাছ গা ঘষছে ভোরের বাতাসে

তার শাখাদের কর্কশ কন্ঠস্বরে,

আর পাহাড় বিড়ালের মতন চোর

তার খামখেয়ালি চোরকাঁটায় রাগ দেখাচ্ছে।

কে আসছে? আর কোথা থেকে?

মেয়েটি উঁচু বারান্দায় অপেক্ষায়,

সবুজ মাংস আর সবুজ বিনুনি,

স্বপ্ন দেখছে তেতো সমুদ্রের।

--‘বন্ধু, ভাই, আমি অদলবদল করতে চাই

আমার ঘোড়ার সঙ্গে তোমার বাড়িকে,

তোমার আয়নার জন্য বিক্রি করব আমার জিন,

তোমার কম্বলের বদলে আমার ছোরা।

প্রিয় ভাই আমার, আমি এসেছি রক্তাক্ত

কাবরা’র গিরিপথ ধরে’।

--‘যদি পারুম, আমার যুববন্ধু,

তাহলে দরদস্তুর করতে পারতুম,

কিন্তু আমি আর আমি নই,

আর এই বাড়িটা আমার, আমার নয়’।

--‘বন্ধু, ভাই, আমি এখন মরতে চাই,  

আমার বিছানার সাজসজ্জায়,

লোহার তৈরি, যদি তা পারা যায়,

মিহিন ক্যামব্রিক কাপড়ের চাদরে।

তুমি কি আমার জখম দেখতে পাচ্ছ

আমার গলা থেকে হৃদয় পর্যন্ত?’

--‘তিনশো লাল গোলাপ

তোমার শাদা জামায় এখন।

তোমার রক্ত থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে আর চুঁইছে,

তোমার রক্তবর্ণ কাঁটা থেকে।

কিন্তু আমি আর আমি নই,

আর এই বাড়ি আমার, আমার নয়’।

--‘তাহলে আমাকে, অন্তত, ওখানে চড়তে দাও,

উঁচু বারান্দার দিকে।

আমাকে চড়তে দাও, আমাকে ওখানে চড়তে দাও,

উঁচু সবুজ বারান্দায়।

চাঁদের আলোয় তৈরি উঁচু বারান্দা,

যেখান থেকে শুনতে পাচ্ছি জলের আওয়াজ’।

এবার ওরা আরোহণ করে, দুই সহযোগী,

ওপরে উঁচু বারান্দায়,

রক্তের ফোঁটা ঝরাতে ঝরাতে

চোখের জলের রেখা ফেলতে-ফেলতে।

ভোরের ঘাসগুলোয়

কাঁপে, টিনের ছোট লন্ঠন।

স্ফটিকের হাজার খঞ্জনি

ভোরের আলোকে জখম করেছে।

সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।

সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা।

ওরা ওপরে আরোহণ করল, দুই সহযোগী।

মুখের ভেতরে, অন্ধকার আওয়া

এক অদ্ভুত গন্ধ রেখে গেলো,

হীরাকষ, আর পুদিনা, আর মিষ্টি তুলসীপাতার।

--‘বন্ধু, ভাই! মেয়েটি কোথায়, আমাকে বলো,

মেয়েটি কোথায়, তোমার তেতো সুন্দরী?

প্রায়ই তো, মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে!

প্রায়ই তো, মেয়েটি অপেক্ষা করতে পারতো,

শীতল মুখাবয়ব, আর অন্ধকার এলোচুলে,

এই সবুজ বারান্দায়!’

জলাধারের ঢাকনার ওপরে

জিপসি মেয়েটা দোল খাচ্ছিল।

সবুজ মাংস, সবুজ এলোচুল

জমাট রুপোর চোখ।

চাঁদের আলোর তৈরি বরফরশ্মি

ওকে জলের ওপরে তুলে ধরে আছে।

রাত কত অন্তরঙ্গ হয়ে এলো,

এক ছোটো লুকোনো বাজারের মতন।

মাতাল সিভিল গার্ডরা টোকা দিচ্ছে,

টোকা দিচ্ছে, দরোজা চৌকাঠে টোকা দিচ্ছে।

সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।

সবুজ বাতাস, আর গাছের সবুজ শাখারা।

সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ,

আর পাহাড়ের ওপরে ঘোড়া।

 

 

অপ্রত্যাশিত প্রেমের হরিণ

 

কেউই বুঝতে পারেনি সুগন্ধ

তোমার তলপেটের ম্যাগনিলোয়া ছায়াকে।

কেউই জানে না তুমি সম্পূর্ণ পিষে দিয়েছ

তোমার দাঁতের মাঝে প্রেমের টুনটুনি পাখিকে।

এক হাজার ছোটো পারস্যের ঘোড়া ঘুমিয়েছিল

তোমার কপালের চাঁদের আলোর বাজারে,

যখন কিনা, চার রাত ধরে, আমি জড়িয়ে ধরেছিলুম

তোমার কোমর, তুষারপাতে সে শত্রু।

পলেস্তারা আর জুঁইফুলের মাঝে,

তোমার দৃষ্টি ছিল ফ্যাকাশে এক শাখা, বীজপ্রসূ।

আমি তোমাকে দেবার চেষ্টা করলুম, আমার বুকের হাড়ে,

হাতির দাঁতের অক্ষরে যা বলছিল ‘চিরকাল’।

চিরকাল, চিরকাল। আমাকে অত্যাচারের বাগান,

তোমার দেহ, আমার কাছে থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নেয়,

তোমার শিরার রক্ত এখন আমার মুখে,

ইতিমধ্যে আমার মৃত্যুতে আলোমুক্ত।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন