মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

দেবলীনা চক্রবর্তী

 

কবিতার কালিমাটি ১০৭


বৃষ্টিকথা

 

কবে যেন প্রথম বৃষ্টির গন্ধ পেয়েছিলাম

আকণ্ঠ পান করেছিলাম ঝোড়ো বাতাসের ঘ্রাণ

বুকে বেজে উঠেছিলো চৌরাশিয়ার মোহন বাঁশি

মল্ল্হারের ঘনগম্ভীর সুরে — “কদম - বাহার”

বর্ণিল রোদে আঁকা কৌণিক অস্তরাগ। 

 

কুলকুল বয়ে যাওয়া শান্ত নদীটির মতো পাশ ঘেঁষে চলে এসেছি আজ বহুদূর

ইচ্ছে বকুল এখন ম্লান -

স্মৃতি ধূসর হয়ে, শেষে পরে থাকে শুধু বিবর্ণ অস্থি কঙ্কাল।

 

বৃষ্টির গন্ধ এলে এখনও নদী ফুলে ওঠে

দুলে ওঠে তার গোপন ঢেউ -

আছড়ে পরে পাথর ঘরে!

কত নামহীন ফুল ফোটার গন্ধে নদীমন হয় আকুল —

 

তবুও মনে পরে না সেই প্রথম দিনের বৃষ্টি সম্মোহন!

 

সুর সম্বন্ধীয়

 

(১)

 

ছেলেটি তারস্বরে কেঁদে উঠতেই আমি তাকে কাছে ডাকি, মাথায় হাত রাখি, চোখ মুছিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টার পর বুঝতে পারি এ তার কান্না নয়, কোন অপূর্ণ ইচ্ছের বিলাপি সুর। যে সুর আসলে সাধনার নয় ইচ্ছে পূরণের জাদুকাঠি।

 

(২)

 

কান্না এমন এক সুর যা হাসির মতই সংক্রমিত। আনন্দ-উৎসব-বিষাদ-অভিমান  প্রতিক্ষেত্রেই বেজে ওঠে তারে তারে, আর মন তখন কেঁদে ওঠে করুণ সুরে।

 

(৩)

 

কান্না যেন হেমন্তের সোনাঝরা দুপুর। গাঢ় সন্ন্যাসী রঙ মেখে দূর থেকে ভেসে আসা সে কোন অজানা পাখির সুর। বয়ে আনে উতরোল আর রেখে যায় অপার নৈঃশব্দ্য।

 

(৪)

 

কান্নার ভেতর একটা পাহাড়িয়া পথ আছে। যেখানে সুর ভাসে ত্রিকোণ পাতায় আর আবেশিত সেই সুর পরিব্যাপ্ত হয় সাদা কুয়াশার চাদরে চাদরে।

 

(৫)

 

কান্না আসলে সেই ফল্গু নদীটির মতো, যায় তাপিত বুকে হাত ছোঁয়ালে শুনতে পাবে সহস্রধারার কল্লোল ধ্বনি, অজস্র মূর্ছনা! অথচ চলনের যে সুর সে কত শান্ত শীতল, বহু সাধনার।

 

(৬)

 

এমন করে অন্ধকারে, নিশ্চুপে এসে দাঁড়াও

যে তোমায় দেখা প্রায় অসম্ভব।

অথচ তোমার প্রলম্বিত ছায়া আমাকে ছুঁয়ে যায় সস্নেহে, ঢেকে দেয় পরম নির্ভরতার উপশম হয়ে।

প্রতিবার তোমার এই উপস্থিতি উচ্ছসিত বা সরব না হলেও জানি তা সুরের মতোই অনাদি-শ্বাশত।

                                                                                        

অকপটে...

 

দু'এক পশলা রিনরিনে বৃষ্টির পর আকাশের অভিমানী মুখ ভার — আরও কিছুটা আবেগ ঝেড়ে ফেলে হালকা হওয়ার ইচ্ছে ছিলো বোধহয়। এই মেঘ ছায়ামাখা নিবিড় সুকোমল প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে কতবার মনে হয়েছে হারাই নিজেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক মনকে ছিঁড়ে খুঁড়ে উড়িয়ে দিই পেঁজা মেঘের সাথে। কী  এক আশ্চর্য মৌজে দুহাত মেলে লুটে নিতে চাই আকাশ-মাটির সোঁদাগন্ধ।

আকাশের বিষাদজন্ম ভুলে গিয়ে তৃকোণ পাতা থেকে ঝরে-পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলের বিরহটুকু মেখে নিতে সঙ্কোচ হয় না কখনও, আমি যেন জলে ভেজা থোকা থোকা জোনাকির আগুন আলো! যে নাবিক পথ হারালো তার দিক নির্দেশে পৌঁছে দিই সেই বাতিঘরে যেখানে আলো ছায়ামাখা নীল জলে স্বপ্ন ভাসে।

আসলে প্রকৃতির এই ফুসমন্তরের ডাকে সারা দিয়ে কবেই হয়েছি আমি ভবঘুরে। স্তরীভূত জীবনের বন্দরে ঋতু আসে ঋতু যায়! ঢেউ খেলা করে, প্রাচীন প্রস্তরে চির ধরে তবু ভাঙে না, আর গোপন ব্যাধির মতো গাঢ় হয় অন্ধকার সান্ধ্যভাষা নিয়ে!

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন