সমকালীন ছোটগল্প |
ঘাতক
না, তাকে ধরা যায়নি। আতঙ্ক ছড়ানো নৃশংস ঘাতকের
হদিশ পুলিশ, প্রশাসনের কাছে অধরাই থেকে গেছে। আর সেও এমন কোনও ক্লু রাখেনি যার
দ্বারা তদন্তের গতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। শুধুই পাওয়া গেছে হত্যার সাদৃশ্য। শহরের
চারধারে সবকটা খুনের ধরন একরকম – ঘাড়ের নিচে একটা গভীর ক্ষত। ছোরা বা ঐ জাতীয় কোনও
ধারাল অস্ত্রের আঘাতে যা ঘটানো সম্ভব। আর প্রতিটা হত্যাই হয়েছে পেছন থেকে অতর্কিত
আক্রমণে। খুনের তালিকায় এযাবৎ কয়েকজন পুলিশ, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন
আছে তেমনই আছে জনাকয়েক নিরীহ সাধারণ মানুষ, রিক্ত, নিঃস্ব ফুটপাথবাসিও। হত্যাকারী
ঠিক কী চায়, কী তার আক্রোশের কারণ এবং
কেনই বা সে ঘটনাগুলো পরপর ঘটায় এই নিয়ে
সকলের ভয়, বিভ্রান্তি যখন চরমে, ঠিক তখনই থেমে গেল এই নৃশংস হত্যালীলা। শেষ খুনের
পর প্রায় আটমাস কেটে যাওয়ার পরও নতুন কোনও লাশ দেখা যায়নি শহরের কোথাও। বলতে গেলে
এক চরমতম রহস্যের কুয়াশা তৈরি করে খুনি উধাও হল। হত্যালীলা থেমে যাওয়ায়
প্রত্যাশামতই ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়েছে শহরবাসীর আতঙ্ক। জনজীবন ফিরেছে স্বাভাবিক
ছন্দে।
এরকমই এক দিনে রিকশাওয়ালা বদন মণ্ডল তার রিক্সাটা টানতে টানতে নব নিকেতন স্কুলের পাশের গলির ছায়ায় দাঁড় করাল। গলির দু’পাশে গাছগাছালির প্রাচুর্য। বড় বড় বাড়িও আছে। তাই দীর্ঘ ছায়া পড়ে। শেষ জ্যৈষ্ঠের প্রবল তাপে বদন অস্থির। শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। এই গরমে রিক্সাটানা সত্যিই বড় দুঃসাধ্য কাজ।
পাগড়ীর মত করে মাথায় জড়ানো গামছাটা দিয়ে বদন ঘাম মুছল। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পাশেই একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় আধশোয়া হয়ে রইল সে। আপাতত বিশ্রাম। ঠিক করল রোদের আঁচ না কমা অবধি রিক্সা নিয়ে আর বের হবে না। ছোট্ট মোবাইলে দেখে নিল দুপুর তিনটে দশ। নিজের একটা রিক্সা কেনার ইচ্ছা তার বহুদিনের। কিন্তু পারছে কই? ভাড়ার রিক্সা মানে দিনের শেষে মালিকের হাতে তিরিশটা টাকা ধরিয়ে আসতেই হবে। নিজে রিক্সার মালিক হলে সে দায় থাকে না। কিন্তু মেয়ে যে এবার ক্লাশ এইটে উঠেছে। ওর পড়াশোনার সামান্য খরচটা নতুন রিক্সা কিনতে গিয়ে তো আর বন্ধ করে দেওয়া যায় না!
ফুরিয়ে আসা বিড়িটায় শেষ একটা টান মেরে বদন ড্রেনে ছুঁড়ে ফেলল। মহীতোষ তার বাইকটা সার্ভিসিং–এ দিয়ে তখন ও পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। দাদা গোছের লোক সে। এলাকার নাগরিক কমিটির আগামী নির্বাচনে সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতা করার আশায় দিন গুনছে এবং সে নিশ্চিত তার জয়ের ব্যাপারে। মহীতোষ বদনের সামনে এসে বেশ কর্তৃত্বের সাথে বলল – ‘অ্যাই বদন, চল্ তো’! বদন বিলক্ষণ চেনে তাকে। অনেকবার তার রিক্সায় চড়ে ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে। বাকি থাকা ভাড়া অনেকবার চেয়েছে বদন। ‘পরে দেবখন’ বলে অবলীলায় পাশ কাটিয়ে গেছে মহীতোষ। এসব বদন ভোলেনি। সে বলল –
-
না বাবু, এখন
যাবনি।
- কেন রে, কী হয়েছে, যাবি না মানে? তাহলে এখানে দাঁড়িয়েছিস
কেন?
- আজকের রোদডা দ্যাখছেন? এই গরমে আর পারতিছি না। বিশ্রাম না
নিলি হাফায়ে যাব। শরিলটাও তো রাইখতে হবে।
- বটে? হাফায়ে যাবি? তাহলে চালাস কেন রিক্সা? অ্যাঁ? এখানেই
বা দাঁড়িয়েছিস যে বড়?
- বাবু এটা ইস্ট্যান্ড না। আমি একটু জিরায়ে নিবার জন্য বইসছি। আপনে সামনে
একটু আগায়ে দ্যাখেন। রিক্সার ইস্ট্যান্ড পাবেন।
কিন্তু মহীতোষ নাছোড়। ওকেই তার চাই। তার মুখের উপর সরাসরি না বলার সাহস এই সামান্য লোকটা পায় কোথা থেকে? ভেতরে ভেতরে গুমরে ওঠে রাগ। বদনকে নিয়ে যাবার জন্য জোর করতে থাকে। হুমকির সুরে বলে –
-
না গেলে দেখব
কী করে রিক্সা চালাস এলাকায়। চিরকাল মনে রাখবি এমন ব্যবস্থা করে দেব তোর। আমার কথা না শুনলে ঐ
রিক্সা তোর আস্ত থাকবে ভেবেছিস? পাবলিককে
হেনস্থা করার খালি ধান্দা তোদের।
- বাবু, আগে আমার বাকি ভাড়ার টাকাগুলান দ্যান্। কতবার বইলছেন
পরে দেব, পরে দেব। আমরা গরীব মানুষ। আপনেরা না দিলে আমাদের চলে ক্যাম্নে? আমদের
কি সংসার নাই?
- রাখ্ তোর বাকি টাকা। পরে হিসাব হবে। এখন যাবি কিনা বল্?
-
না, ভাড়ার
টাকা শোধ না কইরলে আপনেরে নিয়ে আর যাব না বাবু। এরপর আমি পুলিশে যাব। জানায়ে দিব
উহাদের। গরীবের টাকা মাইরছেন আপনে।
পুলিশের কথা শুনে আগুন জ্বলে ওঠে মহীতোষের চোখে। এত বড় স্পর্ধা এই সামান্য রিক্সাওয়ালার যে তাকে পুলিশের ভয় দেখায়!
বদন মণ্ডল নিরীহ, গরীব লোক। বচসায় সে জড়াতে চায় না। তার ওপর শুনেছে এই বাবুর এলাকায় নামডাকও আছে। তাই পুলিশের কথা বলেও ভেতরে ভেতরে বদন খানিক থমকে গেল। ভয় চেপে বসল তাকে। প্রতিবাদের স্বর আর বেশী বাড়াতে পারল না সে। মহীতোষ তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় একরাশ হুমকি ছুঁড়ে দিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গেল।
(২)
সন্ধ্যের মুখে আবার দেখা হল দুজনের। তবে
স্থানের বদল হয়েছে। এবার তারা পরস্পরকে প্রত্যক্ষ করল যতীন মাস্টারের ঘরের সামনে। বদন
অবশ্য দেখেও না দেখার ভান করে থাকল। যতীন ঘোষদস্তিদার নামী বাংলার শিক্ষক। বহু দূর
থেকে অনেক ছেলেমেয়ে তার কাছে বাংলা পড়তে আসে। অতি সম্প্রতি মহীতোষের মেয়ে শ্রেয়াও যতীন মাস্টারের কাছে টিউশন নিতে আসা শুরু করেছে।
বদনকে এখানে দেখে আবার রোখ চাপে মহীতোষের।
তখন বলল শরীর ভালো নেই, যেতে পারব না, আর এখন এখানে হাজির! ভেতরে জমে থাকা রাগের
বলয়ে আবার ঢুকে পড়ে সে।
তখন ছুটি হয়েছে একটা ব্যাচের। এদিক ওদিক
জটলা করে রয়েছে অনেক ছেলেমেয়ে। তাদের ঠাট্টা ইয়ার্কির কলরবে জায়গাটা মুখর। সার্ভিসিং
থেকে সারিয়ে নিয়ে আসা বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মহীতোষ দেখল একটি মেয়ে গুটি গুটি
পায়ে বেরিয়ে এল যতীন মাস্টারের বাড়ি থেকে। তারপর নিঃশব্দে বদনের রিক্সায় গিয়ে উঠল।
দুজনের মধ্যে কিছু কথাও হল যা দূরে দাঁড়ানো মহীতোষের কর্ণগোচর হল না। বদন দ্রুত
বেরিয়ে গেল মেয়েটিকে রিক্সায় নিয়ে।
কিছুক্ষণ পর মহীতোষের কন্যাও বেরিয়ে আসে। উঠে পড়ে তার বাবার বাইকে। স্টার্ট দেওয়ার আগে কী মনে হল মহীতোষ তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে – হ্যাঁরে, রোগা করে একটা মেয়ে একটু আগেই রিক্সা করে বেরিয়ে গেল। কে রে ও?
- কার কথা বলছ বাবা? অনেকেই তো রিক্সায় আসে, যায়। আমি তো নতুন, তাই সবার নাম জানি না।
না কি নাম তুমি জানো বাবা?
- আরে নাম জানলে কি আর তোকে জিজ্ঞাসা করি? যত্তসব।
সহজেই কর্কশ ধ্বনি বেরিয়ে এল মহীতোষের মুখ থেকে। কোচিং ছুটির পর ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছিল জায়গাটা। মহীতোষও বাইকে ঝড় তুলে ফিরে গেল।
(৩)
সপ্তাহখানেক বাদে রেললাইন সংলগ্ন জঙ্গলের
ভেতর যেখানে চোলাইয়ের আড্ডা বসে সেখান থেকে বদন মণ্ডলের লাশ উদ্ধার হল। কিছুটা
দূরে তার রিক্সা দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে ছিল। প্রচণ্ড প্রহারে তার ডান হাত
আর বাঁ পায়ের হাড় ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ঘটনায় শহরে আবার পুরনো আতঙ্ক ফিরে
এল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, প্রায় বিস্মৃত হতে থাকা সেই হত্যাকারী কি আবার ফিরে এল
শহরে? তাও প্রায় আট-ন’মাস বাদে! আবার কি শুরু হবে সেই নৃশংস হত্যালীলা? পুলিশ-প্রশাসনকেও এ ঘটনা অনেক
প্রশ্নচিহ্নের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিল। উদ্বেগে আবার এলোমেলো আর দিশাহীন হল তারা। কিন্তু
বদন মণ্ডলের লাশ পরীক্ষা করে দেখা গেল যে তার মৃত্যু কিন্তু সেই পুরনো ধারায় হয়নি।
অর্থাৎ সেই ঘাড়ের নীচে কোনও গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল না। পেছন থেকে অতর্কিতেও আক্রমণ
করা হয়নি তাকে। ফরেন্সিক রিপোর্টে তার পাকস্থলী থেকে বিষাক্ত চোলাই মদের অস্ত্বিত্ব পাওয়া গেল। আর কিল, চড়,
ঘুষির মতো হাতাহাতির কিছু দৃষ্টান্ত তো ছিলই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় চোলাইয়ের ঠেকে
পারস্পরিক বিবাদ বচসা থেকে এই খুন হয়ে থাকতে পারে। এমন তো কতই হয়। তবুও শহরে সেই
পুরনো চাপা টেনশন আর ভয় দ্বিগুন মাত্রায় আবার ফিরে এল।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে যেদিন এল তার দিন দুয়েক পর যতীন মাস্টারের কাছে মহীতোষের মেয়ের বাংলার ক্লাশ ছিল। সেদিন রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা আর থমথমে। মহীতোষ তার মেয়েকে নিয়ে বাইকে সময়মত পৌঁছে গেল মাস্টারের বাড়ি। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত ছাত্রছাত্রীদের সেই জটলা, কোলাহল, হাসি মস্করার পরিবেশ দেখা গেল না। গেটে তালা ঝুলছে ভেতর থেকে। কলিং বেল টিপতেই বেরিয়ে এলেন যতীন মাস্টার।
-
আজ ক্লাশ হবে
না? মহীতোষ জিজ্ঞাসা করল।
- ওহ্, আপনি। না আজ ক্লাসটা অফ্ই রাখলাম। আমার এস এম এস
পাননি না? অনেককেই মেসেজ পাঠিয়েছি। বলেছি নিজের বন্ধুদেরও জানাতে। সবাইকে তো আর
জানিয়ে উঠতে পারি না। এত স্টুডেন্ট!
- না, তেমন কোনও মেসেজ তো পাইনি। কিরে তুই পেয়েছিস? মহীতোষ তার
কন্যাকে প্রশ্ন করে।
- না তো বাবা।
- কী হয়েছে আজ? আপনার শরীর-টরীর--
- না না, ওসব কিছু না। আসলে আজ অনেকেই বদন মণ্ডলের বাড়ি যাবে।
ওর মেয়েও তো আমার ছাত্রী এইটে পড়ে। ওদের এই দুর্দিনে একটু পাশে থাকা আর কি।
যতীন মাস্টার আরও বলে চলে – কী হয়ে গেল বলুন দেখি! কে যে মারল ওকে! ভয় হয় জানেন মহীতোষবাবু, আবারও কি আতংকের দিনগুলি ফিরে আসছে? সেই হত্যালীলা আর মৃত্যুমিছিল! রাস্তাঘাটে বেরোতেই তো ভয় হয়। বদনের মতো গরীব লোকটা কার আক্রোশের কারণ হল এই তো ভাবে পাচ্ছি না। ওর মেয়েটা খুব সিরিয়াস পড়াশোনায়। সংসারটা ভেসে যাবে যে এবার।
মহীতোষ নিঃশব্দে শুনল সব। ভেতরে ভেতরে একটা অসহ্য বিরক্তি সারাটাদিন ধরে ছেয়ে আছে। সে তার দলের ছেলেপুলেদের বলেছিল বদনকে দু’চার ঘা দিতে। মুখে মুখে কথা বলার সাহস বদন যাতে আর কোনোদিন না পায়। কিন্তু নির্বোধগুলো যে একবারে বদনের লাশ ফেলে দেবে, এতটা মহীতোষ কল্পনাও করেনি।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে
মহীতোষ বলল – সত্যি! গরীবের উপর এমন অত্যাচার? ভাবা যায়
বলুন তো? কত চড়েছি ওর রিক্সায়। কী ভদ্র ব্যবহার ছিল ছেলেটার! নাগরিক কমিটির মিটিং-এ আমি প্রস্তাব রাখব এই
ঘটনার প্রতিবাদে আর বদনের আত্মার শান্তি কামনায় শহরে একটা মিছিল বের করার।
হ্যাঁ, মিছিল বের হয়েছিল। নেতৃত্ত্বে ছিল মহীতোষ। শহরের অনেক লোকও উপস্থিত ছিল মিছিলে। প্রত্যেকের হাতে ছিল মোমবাতি। একজন রিকশাওয়ালার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এমন মিছিল শহরে আগে কেউ কখনও দেখেনি।
এ কাহিনী এখনেই শেষ করে দেওয়া যেত। কিন্তু শেষের একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাংশের উল্লেখ না করলে কাহিনীর অবতারণায় কিঞ্চিৎ ঘাটতি থেকে যায়। ঘটনাটি প্রকাশ্যে এসেছিল মোমবাতি মিছিলের পরদিনই।
শহরের প্রান্তিক জায়গায় একটা খাল আছে। সারা শহরের বর্জ্যের প্রবাহ সেই খাল দিয়েই হয়। খালের খুব কাছেই রেলের লাইন। অনতিদূরে ষ্টেশন। অচেনা বুনো ঝোপঝাড় আর নুড়ি পাথরে ভর্তি জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। মিছিল যেদিন হয় সেদিন রাতে জোর বৃষ্টি নেমেছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুকিয়ে যাওয়া খালের জলও অনেকদিন বাদে বৃষ্টি পেয়ে ভরে উঠছিল অনেকটা। খুব ভোরে রেলের এক লাইনম্যান জলকাদা আর রক্তে মাখামাখি অবস্থায় মহীতোষের লাশ খালের জলে ভাসতে দেখে। এবারের খুনটা কিন্তু ঠিক আগেরগুলোর মতো। ঘাড়ের নীচে একটা গভীর ক্ষত। যেন পেছন থেকে অতর্কিতে কেউ আক্রমণ করেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন