মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

জপমালা ঘোষরায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


নিপা ভাইরাস

 

এদিকে একবার আসতে পারিস তো নিপা! আমার একটু সেবা পেতে ইচ্ছে হয়। এমনি এমনিই। হরলিক্স খাওয়ার মতো। সারাক্ষণই তো দেখি ফেসবুকে লাইভ থাকিস। না, আমি তোর ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট একসেপট করিনি। তার কারণ শুধুই  তোর সঙ্গে আমার আঁতলেমোয় মেলে না বলে নয়, অন্য কারণ আছে। ভারচুয়াল আর একচুয়ালের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। এই শব্দগুলো আমি বাংলার দিদিমণি হলেও ইংরিজিতেই লিখতে হবে। না হলে মানাবে না। যুগোপযোগী হবে না। ছাগলের দাড়ি গজালে সে যদি ভাবে আমি রবিঠাকুর, তা কি হয়?

কখনো পাইনি কিছু বারান্দা, অথচ অঢেল ঘরকন্না দিয়েছি। চাইনি বলে কেউ একটু জলও দেয়নি কখনো, তুই তো জানিস। মাত্র সাত দিনেই তোর কাছে সাতসমুদ্দুরের তলার জলকেলি ও মাৎস্যন্যায় সবই খুলে দেখিয়েছি, সাতজন্মের কথা শেয়ার করেছি। তুই বলেছিস, এবার হুইয়া পড়েন দিদিভাই! শরীলটা  আবার খারাপ অইব তহন ডাগদারে আমারেই বকা দিব। তুই যে কী ভীষণ  ফোন অবসেসড ছিলি! মাঝেমাঝে অসহ্য লাগতো। স্যুপ বানাচ্ছিস ফোন, টয়লেট নিয়ে যাচ্ছিস ফোন!

এই কালফণি ফোনের লাইগাই তুই ফিরিজ থিহা বাইর করতে গিয়া ম্যাডামের ইনসুলিনের অ্যাম্পুল ভাইঙ্গা ফেলাইলি! তোরে আর এহানে কাম করতে হইব না!

একথা তো তোকে মনে হলেও আমি বলিনি, বলেছিল তোর মা, ডে ডিউটি সেরে ফিরে। কী যে অশান্তি হল তোদের মায়ে ঝিয়ে, তুই কাজই ছেড়ে দিলি।  সিঁড়ির চাতালে তোরা কথা কাটাকাটি করছিলি।

ম্যাডামের দেহাশোনা আমিই করুম। তুই যা বল্লভপাড়ার মেসোমশাইরা তোরে  ডাগদাসে। তোরে খুব পসন্দ। নদী পারাইতে হয়তো কী তুই সাতটার লঞ্চিতেই  চইলা আসিস।

তুই বেশ চেঁচিয়েই বলছিলি

আমারে নদীর ওপার পাঠাইও না মা, জানোয়ারটা আমারে এসিড ছুঁইড়া  সোনামুখ জ্বালাই দিব কইসে। মদের ঘোরে বিরুদারে কইসে বিরুদা আমারে কইল। তোমার কি মায়া দয়া নাই? ক্যামন মা! কী একখান লম্পট ধইরা বিহা দিস! আমারে খুন কইরা ফেলাইব, আমার পোলাডার কী হইব? মাধ্যমিক পরীক্ষা দিব এবার।

আর তর পোলা! মায়ে পোলারে বইসা খাইবি নাকি? বল্লভপাড়ার মেসো ট্যাহা অনেক দিব কইসে। তুই যা!

তোর স্বামী তোকে এত অত্যাচার করত যে তুই একাই ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছিস। চোখেরবালি পড়িস নি তুই, বিনোদিনীকে চিনিস না, অথচ সেদিন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এমন একটা চাবকে দেওয়া মন্তব্য করলি, বিছানার দরকার না থাকলে পুরুষদের খুব একটা দরকার পড়ে না দিদিভাই। আমি চমকে উঠেছিলাম।

আমি কিন্তু রোজই স্যুপ খাই। কখনো রেডিমেট স্যুপ পাউডার, কখনো নিজে বানাই। এখনো হাঁড়ি হেঁসেল আগলাই। অনেকটাই ভালো আছি কিন্তু বেশী কাজ  করতে আর পারি না। একটু তোর সেবা পেতে ইচ্ছে করে। সপ্তম ছায়াপথে ধীরে ধীরে যে চলে যাচ্ছি, তা বুঝতে পারি। এখানে এরা এখনো আমাকে নিঙড়ে  নিচ্ছে রক্ত প্লাজমা সব। আসলে কেউই খারাপ করছে না। কিন্তু কীভাবে ভালো করতে হয়, অসহায় মানুষগুলো হয়ত জানেই না। বড্ড নির্বোধ।  এই সংসারে  আমি শুধু দিয়েই গেলাম। তাতে আমার এতটুকুও দুঃখ যদি থাকতো তাহলে আমি চাইলে এই 'দেওয়া' থেকে অব্যাহতিও পেতাম। মনেই হয়নি কখনো। শরৎচন্দ্রের কথা ‘এ সংসারে যারা দিলে পেলে না কিছুই...’ ইত্যাদি একটা দার্শনিক উক্তি মাত্র মনে হয়। ওসব বড় মাপের নারীবাদী পুরুষেরা বলে থাকেন। কিছুটা ভেবে বলেন, কিছুটা না ভেবেই বলেন। না বললে ওঁদের ডেজিগনেশন থাকে না।

বিশ্বজিত ব্লাড নিতে আসলে ওকে এসব রক্ত নিঙড়ানোর কথা বললে বেচারা বোঝেই না। বলে, ম্যাম! মাত্র দুই থেকে পাঁচ মিলিলিটার রক্তই তো আপনি  দিচ্ছেন। এটুকু তো দিতেই হবে বাঁচতে গেলে। টেস্ট করাতে গেলে। জীবনের পরীক্ষাকে তার মানে টেস্ট বলা যাবে না। তাই তো? ফেসবুকে ফ্রেন্ড করলাম না বলে তুই আর এলিই না। আরে পাগল! ফ্রেন্ড আর বন্ধু কি এক?

ফোন করলাম তো বললি, মুই নিপা ভাইরাস! আপনার ফলে আমি বাসা নিসি।  দিদিভাই অই ফলগুলান খাইয়েন না! তার মানে তুই অভিমানে আসবি না,  কুনো সম্পক্কো রাখবি না, তাই তো? সমস্ত মেডিকেল প্রোটোকল মেনে একবার  এলে পারতিস নিপা। আর কোনো বর্ষা বসন্ত পৃথিবীতে আসবে কি না, লতা হেমন্ত বাজবে কিনা, তা কেই বা জানে বল? যে ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস, তার চেয়ে নিপা ভাইরাসই ভালো। সাতসমুদ্দুর নোনতা জলকেলি আবার মাৎস্যন্যায়ও। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন