মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৪  

 


আমাদের দেশে ও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। আমরা আজ তার ভেতর মাত্র কয়েকটা হলিউড ক্লাসিক বেছে নেব, যার গ্রহযোগ্যতা প্রশ্নাতীত এবং সেগুলো থেকে আমরা কী কী শিখলাম সেই নিয়ে  আলোচনা করব। আমি ইচ্ছে করেই ১৯৩০-এর পরের সিনেমাগুলো বেছেছি যাতে ছায়া-ছবি-শব্দ সব কিছুই থাকে, অর্থাৎ এগুলো সাইলেন্ট মুভি নয় (শুধু আংশিকভাবে ‘মডার্ন টাইমস্‌’ বাদে যেটা পরে বলব)প্রথম ছবি, ফ্রাঙ্ক কাপরার ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ (১৯৩৪), দ্বিতীয় চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস্‌’ (১৯৩৬), তৃতীয় ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯), চতুর্থ ছায়াছবি আলফ্রেড হিচককের ‘রেবেকা’ (১৯৪০) ও পঞ্চম মুভি অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১)

একটা সিনেমা বানানো বেশ জটিল কাজ। সিনেমা-হলে ছবিটা দেখে আসার পর আমরা যেরকম ভাবি, কী দারুন ডায়লগ, সিনারি, অভিনয়, নাচ-গান-মিউজিক –  সিনেমা বানানো কিন্তু এর থেকে বহুগুণ শক্ত। কিছু গলা-কাঁপানো ডায়লগ দিয়ে, নাচ-গান দিয়ে আর প্রকৃতির মাঝে ক্যামেরা ঘুরিয়ে সিনেমা হয় না। স্ক্রিন-প্লে যদ্দূর সম্ভব নিখুঁত তৈরি করে ক্যামেরার পেছনে একজন পরিচালককে শিকারী চিলের মত বসে থাকতে হয়, কখন একেকটা শট্‌ পারফেক্ট হবে, ওমনি সেটাকে ক্যামেরায়  বন্দী করতে হবে। এরজন্য ক্যামেরাটা কোথায় থাকবে, কোন্‌ অ্যাঙ্গেলে থাকবে, শট্‌টা ক্লোজ শট্‌ হবে নাকি দূরের শট্‌, ফোকাস কোথায় হবে, কতক্ষণের শট্‌ হলে  সেটা বেশি কার্যকর হবে, কোন্‌ জায়গাটায় আলো থাকবে আর কোথায় আবছায়া,  সেটে রঙের ব্যবহার কীরকম হবে, এইসব হাজারো হাবিজাবি মাথায় রাখতে হয়।  তারসঙ্গে অভিনয়, ডায়লগ, মেক-আপ, মিউজিকের ব্যবহার ইত্যাদি। অর্থাৎ পুরো সেটের ডিজাইন, প্রত্যেক শটের জন্য। আর এইসব হবার পর আবার শব্দের একপ্রস্থ ডাবিং আর যথাযথ এডিটিং। কাঁচি একবার যদি ভুল কাটে, তাহলে সব পরিশ্রম জলে। আর এইসবের পেছনে থাকে পরিচালকের ধৈর্য্য। তবেই দাঁড়ায় একটা সিনেমা। ফলে আমরা যখন কোন ছবির কড়া সমালোচনা করি, সেটা হয়ত পরিচালকের ভবিষ্যতের জন্য ভাল হয়, কিন্তু সে খুব দুঃখ পায়, তার ঘামঝরা  সৃষ্টির বদনাম হল বলে। সেইজন্য সব পরিচালককেই পরিচালনা করার আগে গোটা পৃথিবীর সবথেকে ভাল ছায়াছবিগুলো থেকে শিখতে হয়। ছবির প্রতি অংশের বিশ্লেষণ বুঝতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাধার কিছু ছবিও দেখতে হয়, যাতে বোঝা যায়  সেই ছবির ভুলগুলো কোন্‌ যায়গায়। তো, আজ আমরা হলিউডের শুরুর দিকের কিছু অসাধার ছবি নিয়ে এইসব আলোচনাই করব। সিনেমাগুলো কোন্‌ অংশে  শিখিয়েছে, কী কী শিখিয়েছে। ছবির প্লট নিয়ে একগুচ্ছ সময় ও স্পেস নষ্ট করব না।




১৯৩৩ সালের এক ছোটগল্প ‘নাইট বাস’ অবলম্বনে তৈরি ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ (১৯৩৪) হলিউডের প্রথম ছবি যা পাঁচটা সেরা অস্কার (বিগ ফাইভ) পেয়েছিল – সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা স্ক্রিপ্ট, সেরা নায়ক ও সেরা নায়িকা। এক বড়লোকের মেয়ে নিজের বাবার শাসন থেকে বাঁচতে পালিয়ে যায়। রাস্তা দেখা হয় এক রিপোর্টারের সঙ্গে, সে যার প্রেমে পড়ে। তারপর ছবি জুড়ে উপভোগ্য নাটকীয়তা। আমার মতে, এই সিনেমার আসল সাফল্য একদিকে প্রকৃতির মায়া ফুটিয়ে তোলা ও অন্যদিকে গ্রাম্য আমেরিকার দারিদ্র ক্যামেরার সামনে আনা। এই সিনেমা ‘প্রি-কোড’ হলিউডের ব্লকবাস্টার রোমান্টিক কমেডি হিসেবে ধরা যায়, যখন ‘মোশন পিকচার প্রোডাকশন কোড’ চালু হয় নি (এই কোড ছিল সিনেমায় কী দেখান যাবে আর কী দেখান যাবে না, তার গাইডলাইন) এই ছবি নিয়ে অনেক  গল্প আছে। এর নায়িকা ক্লদেত কোলবার কিছুতেই এই সিনেমা করতে চাননি কার কাপরার পরিচালনায় ওনার কেরিয়ারের প্রথম ছবি ফ্লপ করেছিল। তারপর  পারিশ্রমিক ডবল করার শর্তে (সেই সময়ে ৫০ হাজার ডলার, ভাবতে পারছেন!)  নায়িকা এই ছবি করেন। শুটিং চলাকালীন পরিচালক বারবার এর স্ক্রিপ্ট বদল করেন ও এই ছবিকে দ্রুতগতির সিনেমা করে তোলেন। একজন পরিচালককে সেরা হতে গেলে ও সেরা ছবি বানাতে গেলে উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে কী কী করতে  হতে পারে, তা এই সিনেমার ইতিহাস থেকে ভালভাবে শেখা যায়। সাদা কালো ছবি হিসেবেও কীভাবে জলে আলোর ঝিকমিকের সাথে মায়াবি মুহূর্ত বা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের  ক্লোজ-শটে মুখের প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা এই ছবি পৃথিবীকে শিখিয়েছে। আরো শিখিয়েছে নায়িকার বিরক্তি সত্বেও পরিচালক কীভাবে তার অভিব্যক্তির  সেরা অংশ ক্যামেরায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এই সিনেমা একদম আদিলগ্নের রোমান্টিক কমেডি হিসেবে এতই জনপ্রিয় ছিল যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রচুর ভাষায় এর গন্ডা গন্ডা রিমেক হয়েছে। ভারতেও হয়েছে। হিন্দি, তামিল, কন্নড়, এমনকি বাংলাতেও... উত্তম-সুচিত্রার চাওয়া-পাওয়া (১৯৫৯) ইত্যাদি




‘মডার্ন টাইমস্‌’ (১৯৩৬) নিঃসন্দেহে চার্লি চ্যাপলিনের সেরা ছবি। লিটল ট্রাম্পের ভূমিকায় চ্যাপলিনের শেষ সিনেমা। যে ট্রাম্প এর আগে বিভিন্ন রোলে ধরা দিয়েছে, সে এই সিনেমায় আধুনিক শিল্পায়নের আগ্রাসনের যুগে মানিয়ে নিতে পারছে না। চ্যাপলিন এই ছবির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপের আর্থিক মন্দা দেখে ও গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার পর। আমার মতে এই ছবি নিতান্ত কমেডি ছবি নয়। থিম হিসেবে আমি এই সিনেমাকে অন্য সব ছবির তুলনায় এগিয়ে রাখব,  কার এখানে যা দেখানো হয়েছে, তা আজকের যুগেও উল্লেখযোগ্যভাবে মানানসই।  জনসংখ্যা বেড়ে চলা, আগ্রাসী শিল্পায়ন, সেজন্য মানুষকে রোবটে পরিত করা,  ক্লান্তি-অবসাদ, মানসিক হাসপাতাল, কমুনিস্ট ধর্মঘট, বেকারত্ব, মানুষের দুর্দশা, বেড়ে চলা অসামাজিক কাজ, এর ভেতরেই ভালবাসা, বাঁচার স্বপ্ন, আবার উচ্চশ্রেণীর মানুষের ভেতর শপিং মল আর ক্যাবারে কালচার – আধুনিক সমাজের খুব জটিল কিছু বিষয় এখানে একসঙ্গে সহজভাবে দেখানো হয়েছে। নিজের সময়ের থেকে এই ছবি অনেক এগিয়ে। সঠিকভাবে বললে, এ হল দুঃখ সত্বেও মানুষের ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নের ছবি। ‘ইটস্‌ এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ থেকে শুরু করে ‘দ্য শ্যশঙ্ক রিডেম্পশন’ অব্ধি সবার পূর্বসুরী।

এই সিনেমাকে সাদা-কালো সাইলেন্ট মুভি বলা হলেও আসলে এটা নির্বাক, সবাক, শব্দ, মিউজিক, স্ক্রিনে লেখা ও সংলাপের এক অপূর্ব মিশ্র। এমনকি  চ্যাপলিনের মুখেও গিবারিশ ভাষায় গান আছে। সঙ্গে তাঁর অনবদ্য অভিনয়,  শারীরিক সক্ষমতা আর স্ল্যাপস্টিক কমেডি। সবাক সিনেমার যুগেও শব্দ-নির্বাক মিশ্র এই সিনেমার সবথেকে বড় পাওয়া। একটা সিন আছে যেখানে চ্যাপলিনের  পেটে গুড়গুড় করছে। সেই শব্দ চ্যাপলিন নিজে তৈরি করেছিলেন – জলের ভেতর প্লাস্টিক বুদবুদ ফাটিয়ে। আরেকটা কথা। এই সিনেমা শুট করা হয়েছিল প্রতি সেকেন্ডে ১৮-টা ফ্রেমে। নির্বাক ছবির এটাই মোটামুটি স্পিড। এবং সেটাকে প্রোজেক্ট করা হয়েছিল প্রতি সেকেন্ডে ২৪-টা ফ্রেমে। সবাক স্পিডে। ফলে স্ল্যাপস্টিক মুহূর্তগুলো দারু ফুটে উঠেছে। সবশেষে বলতেই হয় এই মুভির সেট   পরিকল্পনা। ধরুন, শুরুর ফ্যাক্টরির সিন। যন্ত্রাংশের মিনিয়েচার দিয়ে পুরো সেটটা নিখুঁতভাবে তৈরি করা। যা আজকের পরিচালককে জানতেই হবে। একে সর্বকালীন ক্লাসিকের তালিকায় না রাখলে ইতিহাস রাগান্বিত হবে।




১৯৩৬ সালে মার্গারেট মিচেলের বিখ্যাত উপন্যাসের ছাঁচে ফেলে তৈরি ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) প্রায় চারঘন্টার ছবি, দেখতে গেলে বেশ ধৈর্য্য দরকার। তবুও দু’বার দেখেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, এই সফল রসায়নের পেছনে ঠিক কী  লুকিয়ে। এবং বারবার আলো আর রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। প্রায় ৮২ বছর আগের ছবি, অথচ রঙের ব্যবহারে কী সাবলীল! এই সিনেমার শুরুর দিকের  আউটডোর সিন আর শেষের মিউজিক দৃশ্য যতবার দেখি, মনে হয় স্বদেশ সেনের কবিতা –- ‘নীল রবারের থাবা পড়ে গেছে এইসব আকাশের গায়ে/ কি ভাবে যে খেলে গেছে শরতের যত ভালো/ যত কিছু আলো’।

এবার আসি ছবির টেকনিকাল কথায়। আমেরিকান সিভিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণের জর্জিয়া ও আটলান্টার তুলোচাষিদের জীবন ও তার নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে এই ছবি। ইতিহাসের সঙ্গে ইমোশনে ভরা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ ৮২ বছর আগের সেই প্রথম ছবি যা দশ’খানা অস্কার পেয়েছিল। আরো বড় কথা, এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবির ভেতর একটা। আরেকটু এগোই, এই ছবি সেই প্রথম ছবি যা রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মুড ভাল করার জন্য অনারারি অস্কার পেয়েছিলসঙ্গে অনবদ্য কস্টিউম ডিজাইন যার জন্য আর্ট ডিরেকশনেও অস্কার। আর ভিভিয়েন লেই ও ক্লার্ক গ্যাবলের মনকাড়া অভিনয় তো রয়েইছে হ্যাঁ, এই সিনেমা নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক আছে। যেমন, সিনেমার দ্বিতীয় ভাগ অনাবশ্যক ভাবেই দীর্ঘ। দাসপ্রথাকে এখানে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। ছবির নাটকীয়তায় বুদ্ধিদীপ্ত অংশ নেই বললেই চলে, শুধুই আবেগে ভরা। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে কথাটা মনে রাখতেই হবে, তা হল এই ছবি সেই সময়কার সর্বোচ্চ সফল ছবি এবং বেশ কিছু বিভাগে এই ছবি এমন কিছু ব্যাপার শিখিয়ে গেছে যা আজকের দিনেও হবু পরিচালকদের কাছে খুব প্রাসঙ্গিক। স্কারলেট ও’হারা-র ভূমিকায় ভিভিয়েন লেই সেই সময়কার প্রোটোটাইপ নারী চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা এক ব্যতিক্রম। বারবার জীবনের ওঠাপড়া। অবসেশন। ধূসর হয়ে আসা স্বপ্ন। এতগুলো মোটিফ বা কনট্রাস্ট একই সিনেমায় সহজে দেখা যায় না। সঙ্গে দুরন্ত রঙিন ক্যামেরার কাজ। সেজন্যই এই সিনেমা হলিউডি ক্লাসিকের একদম ওপরের সারিতে।     



এরপর হিচককের ‘রেবেকা’ (১৯৪০) দাফনি দু’মরিয়ে–র ১৯৩৮-এর বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে। হিচককের একমাত্র সিনেমা যা সেরা ছবি হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। জানি, অনেকেই হয়ত বলবেন, হিচককের ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) বা ‘সাইকো’ (১৯৬০) ছেড়ে আমি হঠাৎ ‘রেবেকা’ নিয়ে পড়লাম কেন? কার বেশিরভাগ দর্শক মনে করেন, পরিচালক হিসেবে হিচককের সেরা ছবি ভার্টিগো বা সাইকো। কিন্তু আমি আমার পছন্দের পেছনে দুটো কার দেখাব (অস্কার পাওয়া অবশ্যই কোন কার নয়)প্রথমত, ‘রেবেকা’ অন্য দুটো সিনেমার তুলনায়  বহু আগের ছবি। হিচককের পাকাপাকিভাবে হলিউড আসার পর প্রথম ছবি। দ্বিতীয়ত, ‘রেবেকা’র পর সাইকোলজিকাল থ্রিলার এক অন্য মাত্রা পায় এবং অন্যান্য পরিচালকরা এই ধরনের ছবির প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে, রেবেকা আমার কাছে ট্রেন্ড-সেটার। আর আজ তো আমরা জীবনের ওঠাপড়ার সাথে ট্রেন্ড-সেটার মুভি নিয়েই আলোচনা করছি। একটা গোটা ছবি জুড়ে গথিক আধাভৌতিক পরিবেশে মৃত এক চরিত্র (রেবেকা) না থেকেও অদৃশ্যভাবে প্রতি সিনে রয়ে গেল আর তার বিশ্বস্ত পরিচারিকা মিসেস ডেনভার্স (জুডিথ অ্যান্ডারসন) আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে নায়িকার (জোন ফন্টেন) মনে সেই ভয় বজায় রেখে তার ঘাড়ে  নিঃশ্বাস ফেলে গেল, এই কম্বিনেশন ৮২ বছর আগে ভাবা যেত না। এমনকি, মিসেস ডেনভার্স যখন মৃত রেবেকার অন্তর্বাস কোথায় থাকে বা সে যখন পার্টি থেকে মাঝরাতে ফিরে এসে আনড্রেস করত, সেই স্মৃতিচারণায় আভিজাত্যের  মাঝেও সাহসী হাল্কা লেসবিয়ান ছোঁয়া টেনে আনছে – তখন এই ছবিকে সম্ভ্রম করতেই হয়। অস্কার কমিটির ভুল, এইরকম অসাধার অভিনয়ের পরেও জুডিথ  অ্যান্ডারসনকে সেরা সহ-অভিনেত্রীর জন্য অস্কার না দেওয়া। এবং এটাও ভুললে চলবে না, এই সিনেমায় জোন ফন্টেনের ভেতর হলিউড সেই হবু সুপারস্টার পেয়ে গেছিল যে পরের বছর হিচককের ‘সাসপিশন’ (১৯৪১) ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় এই ছবি আরো অনেক কিছু শেখাতে পারে। ক্যামেরা অ্যাঙ্গল আর কথোপকথনের সময় দুজন চরিত্রের মাঝের দূরত্ব (স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স) কী রকম হওয়া উচিৎ, সেটা সত্যিই তারিফ করার মত।  এই সিনেমার একটা স্টিল ছবি দিলাম, ভাল করে দেখলে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। হবু পরিচালকরা আরো ভাল বুঝবে। এরপর রয়েছে সাদা আলোর সাহায্যে কালো আবছায়া ফুটিয়ে তোলা আর কস্টিউমের মাধ্যমে গথিক সেই মেজাজ ধরে আনা। এবং এডিটিং। আর সবার ওপরে, ক্যামেরার অ্যাকশন যখন হচ্ছে, তখন সাউন্ড-ট্র্যাক কী রকম হলে সেই অ্যাকশন দর্শকের মনে শিহরণ জাগায়। মিউজিক  দিয়ে রোমান্স অথবা থ্রিলার ফুটিয়ে তোলা। সিনেমাটা মনোযোগ সহকারে দেখলে আমার কথাগুলো ধরতে পারবেন।  



অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১) কোন উপন্যাস বা বই থেকে নেওয়া নয়। সরাসরি লেখা চিত্রনাট্য যা সিনেমায় দেখানো হয়েছে। চিত্রনাট্য এতই ব্যতিক্রমী যার জন্য এই ছবি বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিন-প্লে হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। অবশ্য প্রকৃত অর্থে এই সিনেমার একক স্টার অরসন ওয়েলেস। উনি এই ছবির পরিচালক, প্রোডিউসার, নায়ক ও স্ক্রিন-প্লে লেখক (যৌথ)। দু’ঘন্টার ছবি শুরু  হচ্ছে খুব ধনী ব্যক্তি অরসন ওয়েলেসের (ছবিতে চার্লস ফস্টার কেন) মৃত্যু আর তার বলা শেষ শব্দ ‘রোজবাড’ নিয়ে। সেই নিয়ে খবরের কাগজগুলো তদন্ত শুরু করে। তারপর পর্দায় কেনের জীবন উঠে আসে। অবশ্য নন-লিনিয়ার ন্যারেশনের মাধ্যমে। সিনেমার টেকনিকাল জায়গায় যাবার আগে যেটা বলে রাখতে চাই, তা হল ওয়েলেসকে হলিউড আমেরিকায় ডেকে এনেছিল তার মার্কারী থিয়েটারের সাফল্য দেখে। এবং তার হাতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল নিজের মত করে মুভি বানানোর। যে কারণে ওয়েলেস এই সিনেমা একগুচ্ছ নতুন মুখকে নিয়ে বানাতে  পেরেছিলেন। এবং বলাই বাহুল্য, এই ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।

ঐ যে ‘রেবেকা’য় ক্যামেরার মুভমেন্ট আর ক্যামেরা অ্যাঙ্গলের কথা বলছিলাম তখন, সেগুলো দারুনভাবে শিখিয়েছে ‘সিটিজেন কেন’এমন একেকটা অ্যাঙ্গলে ক্যামেরা বসিয়ে শুট করা হয়েছে যা দেখলে অবাক লাগবে। সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার শিখিয়েছে -- ডিপ ফোকাসকী রকম? ধরুন আপনি একজন ফটোগ্রাফার। একটা  গোলাপ ফুলের ফটো তুলবেন। ফোকাল লেন্থ গোলাপ অব্ধি ফিক্স করলে দেখবেন পেছনের সমস্ত অবজেক্ট ঝাপসা হয়ে গেছে। এবার দূরের পাহাড়ের দিকে ক্যামেরা তাক করুন। ফোকাল লেন্থ ইনফিনিটি। সামনে কাউকে দাঁড় করিয়ে দেখুন, এবার সেই ব্যক্তি ঝাপসা হয়ে গেছেন। SLR ক্যামেরায় এটাই ফোকাসের স্বাভাবিক নিয়ম। এবার ক্যামেরায় একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স লাগান। অ্যাপার্চার ছোট করে দিন। ফটো তুললে দেখবেন, সামনের পেছনের সব অবজেক্ট স্পষ্ট আসছে। এটাই ডিপ ফোকাস। কিন্তু সিনেমায় ডিপ ফোকাস ব্যবহার করতে গেলে মুন্সিয়ানা লাগে। সিটিজেন কেন-এর একটা সিন বলি। কেন-এর মা-বাবা একজন ব্যাঙ্কারের সঙ্গে কেনের ভবিষ্যত নিয়ে ঘরের ভেতর আলোচনায় ব্যস্ত আর বালক কেন জানলার বাইরে বরফ নিয়ে খেলছে। সাধার একজন পরিচালক হলে সে প্রথমে জানলার  ওপর ক্যামেরা রেখে বালক কেন-কে একটু দেখিয়ে ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর ক্লোজ শটের জন্য নিয়ে চলে আসত। কিন্তু ওয়েলেস সেই পথে যান নি। উনি ডিপ ফোকাস করে বাকি চরিত্রগুলোর সঙ্গে সারাক্ষণ বালক কেন-কে দেখিয়ে গেলেন যাতে কথোপকথনের সময় আমাদের দৃষ্টি সেই বালকের ওপর পড়তে বাধ্য হয়। এটা কিন্তু ৮০ বছর আগে বেশ শক্ত এক টেকনিক ছিল। ঠিক যেমন ছিল লং শট বা বহুক্ষণ ধরে তোলা একটা শট। কারণ তখনকার দিনে ক্যামেরা স্থিরভাবে রাখার যন্ত্রপাতি বিশেষ ছিল না। অথচ ‘সিটিজেন কেন’ সেটাও করে দেখিয়েছে। হিচককের ‘রেবেকা’র মত এখানেও আবছায়া ব্যবহার করা হয়েছে রহস্য জিইয়ে রাখার জন্য। শার্প কনট্রাস্ট রয়েছে। এছাড়াও এখানে বেশ অদ্ভুতভাবে এসেছে মন্তাজের ব্যবহার। ওভারল্যাপের মাধ্যমে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়া। সব মিলিয়ে, এই সিনেমা সর্বকালের সেরা হবার দৌড়ে সবসময় এগিয়ে থাকবে। ‘আই ডোন্ট থিঙ্ক এনি ওয়ার্ড ক্যান এক্সপ্লেন এ ম্যান’স লাইফ’ – এই সিনেমার এক বিখ্যাত উক্তি। একটু ঘুরিয়ে বলতে পারি, এই দুর্দান্ত সিনেমাকে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য আমার কাছেও শব্দ নেই। 

সবশেষে বলি, আজ হলিউড ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করলাম মানে এরপর অবশ্যই একদিন গোটা পৃথিবীর ক্লাসিক কিছু মুভি নিয়ে বলতেই হবে। নাহলে আমার পেটে একটা সুড়সুড়ি থেকে যাবে যে আপনারা হয়ত আজ আলোচনা করা এইসব সিনেমাগুলোকেই সর্বোচ্চ ধরে নিলেন। তবে তার আগে কয়েকটা দেশ একটু ঘুরে আসব। ওঠানামার পাশাপাশি জীবনের একটা অদ্ভুত রহস্যময়তাও আছে। আমি সেই রকম রহস্য খুঁজে পাই বেশ কিছু কোরিয়ান সিনেমায়। সামনের বার সেই রহস্য নিয়ে আপনাদের মুখোমুখি হব।     


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন