মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

ফারহানা রহমান

 

কাজিও ইশিগুরো : মানবমনের গভীরতম উপলব্ধির নায়ক




‘উপন্যাসের দিন ফুরিয়ে গেছে’ বলে যেসব গুঁজব সৃষ্টিকারীরা গত কয়েকবছর ধরে যে হাঁকডাক করে বেড়াচ্ছিল, তাদের অবাস্তব উক্তিগুলোর মুখে চুনকালি মাখিয়ে জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ উপন্যাসিক, গল্পকার এবং বিজ্ঞানলেখক  কাজুও  ইশিগুরো তাঁর অসাধারণ আবেগীয় উপন্যাসসমূহের জন্য সাহিত্যের  সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কারটি তাঁর ঝুলিতে ভরে নিয়েছেন। তাঁর নোবেল  পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে সুইডিশ একাডেমির প্রেস রিলিজে বলা হয় যে , কাজুও ইশিগুরো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পিছনে রয়েছে তাঁর এমন একটি  ক্ষমতা যা দিয়ে তিনি মানব মনের গভীরতম উপলব্ধিকে অবলোকন করতে পারেন। তিনি তাঁর আবেগীয় শক্তিতে ভরপুর উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে আমাদের  বাস্তবজগতের সাথে অলীক জগতের সম্পর্কের অন্তরালের নিমজ্জিত হতাশাগুলোকে উন্মোচন করেছেন।  

কাজুও ইশিগুরোকে বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমরা এমন  একটি সময়ের খুব কাছে পৌঁছে যাচ্ছি, যখন আমরা কিছু মানুষ অন্য মানুষদের থেকে উন্নততর মানুষ বানাতে সক্ষম হব। নবকারিগরি দক্ষতা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে দেবে যদি না আমরা বিজ্ঞানের সাথে এখনই  সংযুক্ত হতে পারি। আমরা আসলে এমন একটি দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমাজের কথা কল্পনা করতে পারি, যেখানে অভিজাত নাগরিকরা জৈবপ্রকৌশল প্রযুক্তির কারণে অধিকতর চৌকস স্বাস্থ্যবান এবং দীর্ঘজীবী হবে। আর নিন্মস্তরের মানুষেরা হবে গড়পড়তা সাধারণ ও দুর্বল। এটি শুনে মনে হতে পারে যে, আমি কোন ভীতিকর উপন্যাসের কথা বলছি। কিন্তু  ব্রিটেনের জনপ্রিয়তম লেখকের মতে এই বিশ্ব আসলে এমনই একটি দৃশ্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। কাজুও ইশিগুরো যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘ক্রিস্পর (Crispr) প্রযুক্তি দ্বারা জীন বা প্রাণ-কোষ সম্পাদনার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থায় অনিবার্য যে পরিবর্তন আসবে, তা প্রতিষ্ঠিত মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিতে পারে।   

তিনি বলেন, “আমরা এমন এক স্থানে যাচ্ছি যেখানে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে  নির্মিত আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা সহসা অকার্যকর হয়ে পড়বে। যদিও উদারনৈতিক গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি, মৌলিকভাবে সব মানুষ সমান। কিন্তু আমরা এমন একটি স্তরে পৌঁছে যাচ্ছি যেখানে বস্তুতঃ আমরা এক ধরনের উন্নততর মানুষ সৃষ্টি করতে পারবো বলে মনে করি।   

ব্রিটিশ উপন্যাসিক, গল্পকার এবং বিজ্ঞানলেখক কাজুও ইশিগুরো, ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর জাপানের নাগাসাকিতে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। সমুদ্রবিজ্ঞানী বাবা সিজুও  ইশিগুরো ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সারেতে অবস্থিত বড়শহর গিল্ডফোর্ডে the National Institute of Oceanography তে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে রিসার্চ করার জন্য আসেন এবং সেখানেই স্ত্রী, পুত্র ইশিগুরো ও দুই কন্যা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।    

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি তাঁর বাবা সিজুও ইশিগুরো সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন অতীতের দিকে তাকাই আমি দেখতে পাই যে বাবা  তাঁর নিজের কাজের প্রতি পুরোপুরি সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরে রেখেছিলেন, ঠিক  যেমন ছিল একজন লেখক হিসেবে আমার কাজের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি। বাবা আমার জীবনের মডেল কারণ তিনি তাঁর কাজকে কখনই শুধুমাত্র তাঁর পেশা হিসেবে দেখেননি। বরং তিনি তীব্রভাবে সবসময় কাজটিকে উপলব্ধি করতেন।    

ইশিগুরো সারেতে স্টটটন প্রাথমিক স্কুলে এবং তারপর উইকিং কাউন্টি গ্রামার স্কুলে পড়ালেখা শেষ করেন। স্কুল শেষ করার পর তিনি প্রায় একবছর প্রচলিত পড়ালেখা বন্ধ রেখে ইউএসএ ও ক্যানাডাতে ঘুরে বেড়ান। এরপর যুক্তরাজ্যের  কেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৮ সালে ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রী নেন এবং  ইস্ট এঞ্জলিয়া থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর উপর ১৯৮০ সালে  মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান। এবং এরপর থেকে তিনি ব্রিটেনেই বসবাস করতে থাকেন। জাপান থেকে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে আসার পর প্রথম তিনি ৩৮ বছর বয়সে একটি সাহিত্যসভায় যোগ দেওয়ার জন্য জাপান সফরে যান।  

ইশিগুরোকে সমকালীন ইংরেজিভাষী বিশ্বের সবচেয়ে  জনপ্রিয় কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।  তিনি এ পর্যন্ত চার চারবার ম্যানবুকার প্রাইজ উইনিং-এ মনোনয়ন পেয়েছেন এবং ১৯৮৯ সালে অবশেষে তিনি তাঁর  উপন্যাস ‘দ্য  রিমেইন্স  অফ দ্য ডে’এর জন্য পুরস্কৃত হন। তাঁর ৭টি উপন্যাস  প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘দি  টাইম’ ম্যাগাজিনের জরীপে ১৯৪৫ পরবর্তী ৫০জন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখকদের মধ্যে তাঁর স্থান হচ্ছে ৩২তম। ২০০৫এ লেখা তাঁর ‘নেভার লেট মি গো’ উপন্যাসটি বছরের সেরা উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো। ৬২ বছর বয়সী এই লেখকের বিখ্যাত  দুটি উপন্যাস  'দ্য রিমেইনস অব দ্য ডে' ও 'নেভার লেট মি গো' অবলম্বনে বিখ্যাত দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।   

নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন যে, “এটি আমার জন্য একটি বিরল সম্মাননার, কারণ যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত লেখকদের  মধ্যে আমি আমার পদচিহ্ন রাখতে পেরেছি, যা ভূয়সী প্রশংসার দাবী রাখে।  পৃথিবীটা এখন খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে আর আমি আশা করি যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর জন্য সমস্ত নোবেল পুরস্কারই ইতিবাচক শক্তি হিসেবে ভুমিকা রাখতে পার। আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হবো যদি এবছর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমি ইতিবাচক কোন অবদান রাখতে পারি”।  

সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামত হচ্ছে, “উপন্যাসিকরা আসলে তাদের আবিষ্কৃত  জগতকে সম্পূর্ণ তাদের আয়ত্তের মধ্যে রেখেছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রায়শই তারা যা করতে চায় তার জন্য তাদেরকে আশ্চর্যজনকভাবে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কথাসাহিত্য প্রকৃতপক্ষে অতটা সহজসরল কোন ব্যাপার নয় যা আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখি”।      

তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন আরও বেশি বহুবিধ সাংস্কৃতিক এবং অনেক   বেশি বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছি, কিন্তু শরণার্থী  সংকটের ব্যাপাটিকে একেবারেই ভিন্ন মতামত বলে মনে করি। যেভাবে আমি ব্রিটেনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হই তা থেকে সেটা একেবারেই ভিন্ন।" 

কাজুও ইশিগুরো অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন যে, তিনি যখন একটি  শীতের উজ্জ্বল বিকেলে তাঁর কটসউডের কুটিরটিতে বসে থাকেন, তখন তিনি  তাঁর উপন্যাসের একজন মানুষ এবং তাঁর ঘোড়াকে দেখতে চান। অবশেষে তিনি  তাঁর সপ্তম উপন্যাস ‘দ্য বারিড জায়ান্ট’-এর প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর গন্তব্যপথ খুঁজে পেলেন। তিনি মজা করে বলেন যে, “সেই একাকী পথিকই আমার জন্য সবসময় কাজ করে গেছে”।     

১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা পেইল ভিউ অফ হিলস’ প্রকাশিত হয়। এক মধ্যবয়সী জাপানি নারীর ভিন্ন দেশের মাটিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রামের কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর তিনি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এন আর্টিস্ট অফ দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ লেখেন। এই সময়টিতে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে তিনি তাঁর সমাজসেবী স্ত্রী লরনা ম্যাকডুগালের সাথে পরিচিত হন এবং  পরবর্তীতে প্রেমাসক্ত হয়ে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। নাওমি নামে এ যুগলের একটি কন্যা সন্তান  আছে।

তাঁর সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে লেখা সবচেয়ে স্মরণীয় উপন্যাসগুলির মধ্যে  একটি হচ্ছে, ‘নেভার লেট মি গো’। গল্পটিতে একটি কল্পিত সমসাময়িক  ইংল্যান্ডের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও নেতিবাচক বোর্ডিং-এ বড় হয়ে ওঠা ছাত্রদের মধ্যকার প্রেম, বন্ধুত্ব ও বেদনাময় স্মৃতির জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর অন্য একটি বিখ্যাত উপন্যাসটি হচ্ছে ‘দি রিমেইন্স অফ দ্য ডে’। তিনি এটি ১৯৮৯ সালে লেখেন যা তাঁকে এনে দিয়েছিল বুকার প্রাইজের মতো সম্মাননা। তিনি এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের পটভূমিতে এক ইংরেজ লর্ডের সেবায় নিয়োজিত এই বাটলারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘দ্য আনকন্সল্ড’ এবং ২০০০ সালে তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘হোয়েন উই ওয়ের অরফেন্স’ লেখেন। 

তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়, যেটির নাম, ‘দ্য বারিড জায়েন্ট’। এখানে দেখানো হয় যে একটি বয়স্ক দম্পতি তাঁদের হারিয়ে যাওয়া   ছেলেকে খুঁজতে একজন নাইটের কাছে আসেন।  উপন্যাসটিতে আমরা দেখি যে একজন তৃতীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ গল্পটি বর্ণনা করছেন। আধুনিক পাঠকদের কাছে তিনি গল্পের সময়কার রাস্তাঘাট এবং ঘরবাড়ির বর্ণনা  দেন। উপন্যাসটির পটভূমি রাজা আরথার যুগের সময়কার ব্রিটেন। এখানে আরথারিয়ান ব্রিটেনের পরপরই স্যাক্সনেসদের ব্রিটন্স-এর বর্ণনা করা হয়। শুরু থেকে এখানে অগারস  নামক ফ্যান্টাসি চরিত্রদের দেখান হয়। স্যাক্সনদের গ্রামে থাকা অবস্থায় ভ্রমণের প্রথম রাতেই দম্পত্তিটি দুটি অগারস বন্ধু দ্বারা আক্রমণিত হয় এবং এডউইন  নামের ছেলেটি অপহৃত হয়। পূর্ব ফিনল্যান্ডের স্যাক্সন যোদ্ধা ইউস্ট্যান এডউইনকে উদ্ধার করে আক্রমণকারীদের মেরে ফেলেন। যদিও অগারসদের দ্বারা এডউইন ক্ষত হয়। এখানে ইশিগুরো সায়েন্স ফিকশন, জাদুবাস্তবতা আর ফ্যান্টাসির একটি পরাবাস্তব জগত তৈরি করে পাঠকদের অভিভূত করতে সমর্থন হন। 

ইশিগুরো গীটার বাজিয়ে গান গাওয়া ছাড়াও অনেক ছোটগল্প এবং গান রচনা করেন। সেইসাথে তিনি লিখেছেন নানা চিত্রনাট্যও।

ইশিগুরোর উপন্যাসগুলি প্রায়শই কোন নির্দিষ্ট সমাধান ছাড়াই শেষ হয়। তার উপন্যাসের চরিত্রদের সমস্যাগুলো অতীতে সমাধিস্থ হয় এবং অমীমাংসিত রয়ে যায়। এভাবেই ইশিগুরো তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসগুলোকেই মর্মস্পর্শীভাবে শেষ করেন। তাঁর গল্পের এই উপলব্ধিটি সান্ত্বনা এবং মানসিক যন্ত্রণার মাধ্যমে শেষ হয়।   

সাধারণত মনে করা হয় যে তাঁর লেখায় জাপানি সাহিত্যের প্রভাব আছে, যেখানে সান্ত্বনা এবং মানসিক যন্ত্রণা যুগপৎ বৈশিষ্টের মাধ্যমে লেখাটি এগিয়ে  যায়। ইশিগুরো মনে করেন তিনি তাঁর লেখার ব্যাপারে ফ্রয়েড, দস্তোয়েভস্কি এবং  মার্সেল প্রুস্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। 



যদিও সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমিদের কাছে কাজুও ইশিগুরো একটি সমূহ বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তথাপি একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে,  একজন যোগ্য কথাসাহিত্যিকই আসলে নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন