সমান্তরাল মহাবিশ্ব ও
আমরা – ২
সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির পদার্থবিদ শন ক্যারোল ব্যখ্যা করেছেন কীভাবে ডি সিটার স্পেস অর্থাৎ যে স্থানে খুব স্বল্প পরিমাণে ধনাত্মক ভ্যাকুয়াম এনার্জি থাকে, সেখান থেকে শিশু মহাবিশ্বের জন্ম হতে পারে। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে শিশু বিচ্ছিন্ন হবার পর মূল অর্থাৎ প্যারেন্ট মহাবিশ্বের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই থাকে না । শন ক্যারোল আরও বলেন যে, ডি সিটার স্পেসে কোয়ান্টাম দোদুল্যময়তার ফলে এই বুদ্বুদ তৈরীর প্রক্রিয়াটি অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে ঘটতে পারে। অর্থাৎ অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে। সম্প্রতি স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা তাদের বিখ্যাত এম ডুয়াল তত্ত্বের মাধ্যমে এ বিষয়ে আরও আলোকপাত করেছেন। এর মধ্যে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীও আছেন ড. অশোক সেন, যিনি বলেন এই কোয়ান্টাম ফ্লকটুয়েশন থেকে ১০^৫০০টির মতো ভ্যাকুয়াম স্তরের উদ্ভব হতে পারে এবং প্রতিটি স্তর থেকে জন্ম নিতে এক একটি শিশু মহাবিশ্ব। স্টিফেন হকিংয়ের গ্র্যান্ড ডিজাইন গ্রন্থেও এই তত্ত্বের কিছুটা উল্লেখ পাওয়া যায়।
মাইকেল বিহে, জর্জ এলিস, ফ্রাঙ্ক জে টিপলার প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মান্ড এমন কিছু ভ্যারিয়েবল-এর ফাইন টিউনিং বা নির্দিষ্ট ও পরিমার্জিত সমন্বয়ের দ্বারা তৈরি হয়েছে যে একচুল হেরফের হলে আর আমাদের পৃথিবীতে কোনো প্রাণই সৃষ্টি হতো না। তারা মনে করেন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি বা মানুষের আবির্ভাবের জন্য এই কস্মোলোজিকাল চালক বা ধ্রুবকগুলির মান ঠিক এমনই হওয়া দরকার ছিল। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কেমব্রিজ রয়াল সোসাইটির প্রফেসর মার্টিন রিস ২০০০ সালে just six numbers শিরোনামে একটি বই লেখেন এই প্যারামিটারগুলো নিয়ে। তাঁর মতে এইগুলি হলো যথাক্রমে – ইলেকট্রন ও প্রোটনের অনুপাত, তড়িৎ চুম্বকীয় বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের অনুপাত, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার, মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং মহাজাগতিক ধ্রুবক।
মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্রে রেখে বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড নিয়ম নীতিগুলোকে ব্যাখ্যা করার এই যুক্তিকে বলা হয় অন্থ্রপিক আর্গুমেন্ট। বিজ্ঞানী অভিজিৎ রায় তাঁর ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটিতে এই ধরনের কিছু যুক্তির উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন পরিবর্ত রাশি ও ধ্রুবক পদের মান পরিবর্তন করে সিমুলেশনের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের মত অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরী করা যেতে পারে এবং যেখানে প্রাণের সঞ্চার সম্ভব।
পাঠকগণ ইতিমধ্যে একটা বিষয়ে সহমত হতে পেরেছেন যে মাল্টিভার্স তত্ত্ব অনুযায়ী হাজারো লক্ষ কোটি মহাবিশ্বের ভিড়ে আমাদের মহাবিশ্ব একটি। অধ্যাপক মার্টিন রিস এবিষয়ে চমৎকার একটি উপমা দিয়েছেন – “অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিড়ে আমাদের মহাবিশ্ব একটি। অন্য মহাবিশ্ব বিজ্ঞানের সূত্র আর চলকগুলি হয়তো একেবারেই অন্যরকম হবে।… আমাদের বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডকে অনেকটা পরিত্যক্ত সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়ের দোকানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দোকানের মজুদ যদি বিশাল হয় তবে কোনো একটি জামা আপনার গায়ে ঠিকমতো লেগে গেলে আপনি নিশ্চয়ই তাতে বিস্মিত হবেন না”।
স্টিফেন হকিং-এর মতে, “মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর এতসব যাবতীয় সূক্ষ্ম সমন্বয় দেখে অনেকে ভাবতেই পারেন এটি বোধহয় কোনো গ্র্যান্ড ডিজাইনারের গ্র্যান্ড ডিজাইন। আমাদের এই মহাবিশ্ব অসংখ্য অগণিত মহাবিশ্বের একটি যার প্রতিটিতে কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সূত্রাবলী”। গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এই মাল্টিভার্স থিওরির বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে উঠে এসেছে সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব। বিজ্ঞানী মিচিও কাকু থেকে শুরু করে ম্যাক্স টেগমারক গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন, আমাদের মহাবিশ্ব থেকে প্রায় (১০^১০)^২৮ মিটার দূরে আপনারই এক আইডেন্টিকাল টুইন হয়ত এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোনোদিন জানতেও পারবেন না।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন