সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

অচিন্ত্য দাশ

 

মসীচিত্র ১

(কয়েক বৎসর পূর্বে যখন ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সব সংখ্যা কাগজে ছাপা হইয়া  প্রকাশিত হইত, তখন ‘মসীচিত্র’ শিরোনামে কিছু লিখিতাম। যাহা দেখিয়াছি,  শুনিয়াছি অথবা বুঝায়াছি তাহাই লিখিতাম। কিন্তু লিখিতে গিয়া সেসব কথা  চঞ্চল বালিকার মতো হাত ছাড়িয়া পথের এদিকে ওদিকে ছুটিয়া বেড়াইত। লেখা প্রায়শই মূল ঘটনার স্থান বা তারিখের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকিত না। সে সব রচনা কখনো সত্য ঘটনা হইতে গল্পের দিকে, আবার কখনো গল্পের দিক হইতে নিছক  অভিজ্ঞতার দিকে গড়াইতে গড়াইতে চলিত। তাহার পর গল্প ও না-গল্পের সীমানায় কোনো এক ছায়াছন্ন বটবৃক্ষের নিচে দাঁড়াইয়া পড়িত।

এরূপ রচনা এখন আর কেহ পড়িবে কি না, তাহা জানা নাই। তবু লিখিতেছি।  হয়তো এসব কথা শুধু লিখিবার জন্যই লিখিতেছি।)

 

দলমা পাহাড়ের হাতি


(আলোকচিত্রশিল্পী : কাজল সেন) 


আজ হইতে প্রায় সাড়ে চারদশক পূর্বে শ্রাবণের এক মেঘমেদুর অপরাহ্নে বোম্বে এক্সপ্রেস হইতে টাটানগর স্টেশনে নামিয়াছিলাম। সেই যে নামিলাম তো নামিলাম। এ শহর ছাড়িয়া আর যাওয়া হইল না। কার্যক্ষেত্রের রূপ যেমন হইয়া থাকে মোটের উপর সেই প্রকারই বুঝিলাম। কিন্তু তাহার বাহিরে কলিকাতা হইতে আসা আমার ন্যায় কমবয়েসী ছেলের এই নগরে দেখিবার মতো বহু কিছু আছিল। এত কিছু দ্রষ্টব্য ছাড়িয়া শহরের উত্তর প্রান্তে আকাশপটে দলমা পাহাড়ের রূপরেখাটি আমার ভারি মন টানিয়াছিল। তাহা কখনো কৃষ্ণাভ কখনো নীলাভ আবার কখনো বর্ষার মেঘে জড়াইয়া ঝাপসা হইয়া থাকিত। শুনিতাম পাহাড়ে ঘন অরণ্য রহিয়াছে এবং সেখানে অনেক হাতি বাস করে, পাহাড়ে উঠিলে তাহাদের দেখা পাওয়া অসম্ভব কিছু নহে।

বয়স তখন কম, ছয়জন বন্ধু মিলিয়া দলমা পাহাড়ে হাঁটিয়া উঠিয়াছিলাম। অর্ধপথ যাইয়া থামিতে হইল, কার্‌ দেখিলাম উপর হইতে লোকজন ত্রস্ত হইয়া নামিয়া আসিতেছে। একটি হাতি নাকি পথরোধ করিয়া আছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বেশ কিছু লোক জমা হইল এবং ‘একতাই বল’ এই বিশ্বাস লইয়া আবার আরোহণ করিতে লাগিলাম। এবারও আমরা ফিরিলাম, কারণ, গজরাজকে না দেখিতে পাইলেও গাছপালার আড়ালে তাহার কান  দেখিলাম। হাতপাখার মতো নড়িতেছে। অতএব আমরা অর্থাৎ ‘বীর মনুষ্য-সন্তানেরা’ সত্ত্বর নিচে নামিলাম। আরো অপেক্ষা করিবার পর আবার প্রয়াস  করিলাম এবং অবশেষে চূড়ায় পৌঁছিলাম। পর্ব্বতের প্রায় শীর্ষদেশে একটি কূপের শীতল জলে যে স্নান করিয়াছিলাম তাহা মনে রহিয়াছে।

সূবর্ণরেখা-খরকাইয়ের তীরে এই লৌহনগরীতে দিনে দিনে শিকড় গজাইল,  সংসার হইল। মাঝবয়সে একবার পরিবারের সকলে মিলিয়া একটি জীপগাড়ি ভাড়া করিয়া দলমায় উঠিয়াছিলাম। তখন গ্রীষ্মকাল বলিয়া বিশেষ কেহ নাই। হু হু করিয়া থাকিয়া থাকিয়া উষ্ণ বাতাস বহিতেছে। গ্রীষ্মের অরণ্য যে ভিন্ন এক মেজাজ লইয়া থাকে, তাহা বেশ ঠাহর করিতে পারিলাম।

দুপুরের আহার হইয়া গেলে ভাবিলাম গাড়ি লইয়া এদিক-ওদিক একটু দেখিয়া আসি। একটি ছোট জলাশয়ের নিকটে দেখিলাম একটি অতি-কুঞ্চিতত্বক বুড়ো হাতি জলপান করিতেছে। বড় ধীরস্থির তাহার চালচলন। আমরা সাহস পাইয়া গাড়ি হইতে নামিয়া একটু আগাইয়া যাইলাম। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছিল, কিন্তু আচম্বিতে দেখিলাম অদূরে আর একটি সুউচ্চ কৃষ্ণকায় হাতি আসিতেছে। আমরা পলাইয়া কোনোপ্রকারে গাড়িতে উঠিলাম। ইহা যদি আদর করিয়াও গাড়িতে পদস্পর্শ করে তাহা হইলে পাহাড়ের ঢাল গড়াইয়া গাড়ি সহিত আমরা নিশ্চিন্হ হইয়া যাইব।

গাড়ির চালক অতি কুশলতার সহিত ওই স্বল্প পরিসরে গাড়ি ঘুরাইয়া লইল এবং সত্ত্বর আমাদের লইয়া প্রস্থান করিল। ভয় পাইয়াছিলাম অবশ্যই, কিন্তু তাহারই  মধ্যে মনে হইল, বৈশাখের অরণ্যে হাতিটির উপস্থিতি কত সহজ, কত সাবলীল! অরণ্য ইহার কত আপন, যেন নিজের গৃহের বারান্দায় পায়চারি করিতেছে। আমরা কোনো অযাচিত তুচ্ছ প্রাণী, ভুল করিয়া আসিয়া পড়িয়াছি। এখনি চলিয়া যাইব, আমাদের দিকে মনোযোগ দিবার কোনো প্রয়োজন নাই।

দিনে দিনে সবকিছু পাল্টাইয়া যায়, এদেশ সেদেশ ঘুরিয়া কাজ হইতে অবসর লইলাম। আজকাল নানান প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরাতন বন্ধুদের সহিত যোগাযোগ  করা সহজ হইয়াছে। সেই কলেজে-দিনের জনাকয়েক বন্ধু আমার গৃহে দু-তিন দিনের জন্য আসিল। সকলে মিলিয়া দলমায় যাইলাম। দলমা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন না হইলেও দলমায় গাড়ি লইয়া উঠিবার ভালো রাস্তা হইয়াছে। পর্ব্বতের পাদদেশে সুন্দর ছুটি কাটাইবার সুবিধা ও আহারের ব্যবস্থা। এই স্থান হইতে অরণ্য-পর্ব্বত বড় মোহময় বলিয়া মনে হয়। কেহ যেন ডাকিতে থাকে, ওরে চলিয়া আয় রে…

কিন্তু একটি দৃশ্য দেখিয়া আমি অতীব ব্যথিত হইয়া পড়িলাম। ওই দূর অরণ্য হইতে কে যেন নীরবে কাঁদিতেছে, কারণ, এই স্থান হইতেও এক শব্দহীন  দীর্ঘশ্বাস বাতাস বাহিয়া দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। কতগুলি উচ্চ খুঁটির উপর টিনের চাল লাগানো হইয়াছে। তাহার নিচে দুটি কমবয়সী এবং একটি প্রবীণ হাতি, লৌহশিকলে তাহাদের পা বাঁধা রহিয়াছে। কমবয়সী হাতিগণ ক্রমাগত পা নাড়িতেছে এবং তাহাতে শিকলের আওয়াজ হইতেছে। তাহাদের অভিজ্ঞতা কম, হয়তো তাহাদের বিশ্বাস এইরূপ পা নাড়িতে থাকিলে শিকল একদিন ছিঁড়িয়া যাইবে।

প্রবীণ হাতিটি নড়াচড়া করিতেছে না। তাহার চোখের প্রান্তে বলিরেখা, জল পড়িতেছে কি? সে উদাস দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে চাহিয়া আছে। এ অরণ্য কত নিকটে, তবু অরণ্য হইতে সে আজ কত লক্ষ যোজন দূরে রহিয়া গিয়াছে! এ  জীবনে তাহার আর সেখানে যাওয়া হইল না। চৈত্রের তপ্ত বাতাস মাখিয়া শুকনো শালপত্র মাড়াইয়া সঙ্গীসাথীদের সহিত জলের সন্ধানে ঘোরা হইবে না। চাঁদিনী রাতে মহুয়া ফল খাইয়া মাতাল হইয়া ভালবাসার দোসরটির সহিত খেলা করা জনমের মত সাঙ্গ হইয়াছে।

একবার মনে হইয়াছিল, বন-সংরক্ষকের দপ্তরে ফোন করিয়া বলি, হাতিগুলিকে  ছাড়িয়া দিবার ব্যবস্থা করা হউক। পরক্ষণেই বুঝিলাম, ইহাতে কোনোই ফল হইবে না।

 ******

তাহার পর বেশ কিছুদিন কাটিয়া গিয়াছে। একদিন সকালে চা পান করিতে করিতে সংবাদপত্রে দেখিলাম, দলমা পাহাড়ের পাদদেশে সেই  উঁচু উঁচু খুঁটির উপরে টিনের চালাটির ছবি বাহির হইয়াছে। লিখিয়াছে, এখানে যে প্রবীণ হাতিটিকে রাখা হইয়াছিল, সেটি মারা গিয়াছে। মুহূর্তে মন চলিয়া গেল কয়েকমাস আগের দিনটিতে, যেদিন ইহাকে দেখিয়াছিলাম। তাহার শিকল এতদিনে ছিঁড়িল।

শুনিয়াছি যে প্রাণীমাত্রই তাহার অন্তিমক্ষণে একটিবারের জন্য আকাশের দিকে চাহিয়া কাহাকে কিছু জানাইতে চাহে। এই হাতিটি মনে মনে কী বলিয়াছিল? হয়তো সে ঈশ্বরের কাছে বলিতে চাহিয়াছিল, কী দোষে আমার এই বন্দীদশা  হইল? এই কূটবুদ্ধি ক্ষুদ্র দু-পেয়ে জীবগুলিকে কেন তুমি এত শক্তি দিয়াছ? যাহা হউক আজ আমি শান্তি পাইব, মৃত্যু যেন আমাকে এই কারাগার হইতে বহু দূরে লইয়া যায়।

আমিও কয়েক পল জানালা হইতে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলাম। মনে মনে বলিলাম, তুমি ঈশ্বর বা প্রকৃতি যাহাই হও, একটি হাতিকেও তুমি আর এই  দেশে জন্মলাভ করাইও না। এই আত্মসুখমগ্ন, লোভী, সহানুভূতিহীন কুচক্রী মানুষেরা যদি মহামারী, বায়ুদূষণ বা যুদ্ধে নিশ্চিহ্নপ্রায় হইয়া যায়, তখন না হয় তুমি হাতির দলকে বিস্তির্ণ  অরণ্যভূমিতে আবার আনিও। বনভূমিতে ইহাদের স্বাধীন অবাধ বিচরণ নজরে পড়িলে দেখিবে, তোমার দৃষ্টি কত আরাম  পাইতেছে, তোমারও কত ভালো লাগিতেছে!

1 টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লাগল অচিন্ত্য দা,শেষে আকাশের দিকে তাকান ---তুলনাহীন ।
    বিমল চক্রবর্তী ।

    উত্তরমুছুন