সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

মোহাম্মদ হোসাইন

 

কবিতার কালিমাটি ১০৬


প্রকৃত মানবের মতো

 

প্রকৃত মানবের মতো খুব সাদামাটা জীবন কাটিয়ে দেবো ভেবেছিলাম, পারিনি। দেখা হয়ে গেল নানা জনের সাথে, নানা ঘটনার সাথে, তাই, সাদামাটা আর থাকলো না, রইলো না আমার জীবন। নানা বাঁক, নানা ঘূর্ণি তৈরি হয়ে গেল, হলো। এভাবেই, পৃথিবীর সাথে মানুষের এরকম বহুবিধ ঘটনা, সম্পর্ক আলাদা আলাদা সমীকরণ রচনা করে, নানা সম্ভাবনার মাঝখানে নিয়ে ছেড়ে দেয়। যার দৃষ্টি প্রখর, প্রজ্ঞায় শাসিত, সে বহু দূরের পথ পাড়ি দিতে পারে, চলে যেতে পারে অনায়াসে অনেক দূরে, সীমাহীন সীমানার বাইরে... কিন্তু, আমি তো সেরকম কেউ নই। আমি অতি মূল্যহীন, অতি সাধারণ আমি! 

আগুনটা জ্বেলে রেখেছি তাই বুকে। নীরবে। ক্ষণ গুনছি। একটু একটু করে তৈরি করে নিচ্ছি জমি। এখনো অন্যমনস্ক মানুষ, এখনো বেখেয়ালি মানুষ, এখনো বুঝে ওঠতে পারছে না, কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা। অথবা, বুঝতে চাইছে না -কী তার প্রাপ্য, কী তার পাওয়া উচিত কিংবা তার অধিকারই বা কোনটি।

একটা জালের ভিতর, একটা কুহকের ভিতর বন্দি হয়ে আছে মেধা, মগজ, চিন্তা, চৈতন্য! যেন ভাত ঘুম, যেন নিঃসাড়, অসাড় মনোবিকলন!

মুক্তি কী জিনিস, প্রকৃত স্বাধীনতা কাকে বলে, এখনো জানেই না মানুষ। জানেই না,  মন কী বলে, বিবেক কী বলে! রাষ্ট্র কী চায়, সংবিধান কী চায়, কী চায় সাধারণ খেটে খাওয়া, পিছু হটা, পিছিয়ে যাওয়া অপূর্ণ মানুষ!

তাই, আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে, খুব সন্তপর্ণে জ্বালিয়ে রেখেছি কাঠি। ভালভাবে পরখ করে নিক, দেখে নিক শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ, আলো-অন্ধকার! নিজে থেকে বুঝে নিক, বুঝে নিতে শিখুক আন্তর তাগিদ! প্রকৃত ফারাকটুকু বুঝে নিতে হবে, ব্যবধানটুকু চিনে নিতে হবে নিজের মত করে, নিজেদের মত করে, তবেই হবে মুক্তির প্রথম সোপান।

সত্যের একটা জোর আছে, সে জোরটুকু অনুভব করতে শিখতে হবে, শিখুক তারা। কী পুরুষ, কী নারী, এমনকি মানুষ, এমনকি সমাজ, রাষ্ট্র। যারা জোর খাটায়, আর যারা জবরদস্তি করে, তাদের নিজের কোনো সাহস নেই, শক্তিও নেই। তারা ভয়ংকর রকমের ভীতু এবং অসহায়। তারা একা এবং অস্তিত্বহীন। তাই, তারা লুণ্ঠন করে, অসংস্কৃত আচরণ করে, অসাধুতা করে। তারা পবিত্র নারীদের অবজ্ঞা করে, অসম্মান করে এবং তারা জানান দেয় তারা দুর্বল, অসহায়!

প্রকৃত বীর কখনো অন্যায্যতা করে না, অসভ্যতা করে না, এমনকি ডাকাত হয় না, নির্লজ্জ হয় না। 

সেই সত্যকেই রোপন করে দিতে চাইছি প্রতিটি মানুষের মাঝে, প্রতিটি হৃদয়ের গভীর অনুভূতিতে।  

যাদের কোনোকিছু হারাবার ভয় নেই তারাই জেগে ওঠবে, যারা নিঃস্ব, মাটি কামড়ে পড়ে আছে তারাই একত্রিত হবে, যারা আজীবন পদদলিত, কুণ্ঠিত তারাই এগিয়ে আসবে, আসতে তাদের হবেই। কেননা, এই অবারিত জ্যোৎস্নায়, আলোকিত মোহনায় সবাইকে এক হতেই হবে।

তাই, প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে, বায়ুমন্ডলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে, প্রাবল্যতায় পৌঁছে দিয়েছি মুক্তির সেই বার্তা, প্রতিরোধের, কাঙ্ক্ষিত পঙক্তির অনিবার্য উচ্ছলতা!  

জ্বালিয়ে দিয়েছি সেই কাঠি প্রতিটি মন্ত্রে, উচ্চারণে, স্বপ্নে ও জাগরণে। এখন পাখি যে গান গায়, সে গান মুক্তির।এখন যে ফুল ফুটে সে ফুল সত্যের। এখন যে বাতাস বয় সে বাতাস মর্যাদার। এমনকি যে অন্ধকার নামে প্রতিটি দিনের শেষে, সে অন্ধকার সাহসের, অমিত সম্ভাবনার, দুর্নিরীক্ষ্য স্বপ্নের।

ইতিহাস সাক্ষী, এই পবিত্রগ্রন্থ সাক্ষী,  সাক্ষী ওই দূরের গ্রহ-নক্ষত্রের, সমস্ত অশুভের, অকল্যাণের বিনাশ হবেই। ধ্বংস হবেই সমস্ত কদর্যতার! এবং বিজয় হবেই সুন্দরের, সত্যের

একদিন হবেই বিজয়... প্রকৃত মানবের...

 

অবেলার গান

 

খুব কম মানুষই আছে যারা অন্যকে নিয়ে ভাবে

প্রতিদিন যা কিছু করে নিজের জন্যেই করে

অথচ, সে ভাবনাটাও খুব জোরালো নয়, সুখকরও নয়।

 

কী করে নিজের উদরপূর্তি করা যায়, প্রভাব-প্রতিপত্তি করা যায়, মত্ত থাকা যায় বিলাসে, বৈভবে

কী করে লোকেদের চিনানো যায় তার গরব, মহিমা, বেশিরভাগ এই চিন্তা। এটা এমন যে, সে কখনো এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছেড়ে যাবেনা কোথাও।

 

অথচ, সে জানে, তার কেউ না কেউ শুয়ে আছে ওই নির্জন মাটির কুটিরে বিছানা ছাড়াই, একা একা।

এখন সেখানে অনেক ঘাস জমে আছে, হলুদ পাতায় ভরে আছে তার চারপাশ। পানি জমে থিক থিকে কাদা হয়ে যায়!

মাঝেমাঝে দু'একটা কুকুর, কিংবা বিড়াল অথবা অন্যকোনো সরীসৃপ জাতীয় কিছু আসা-যাওয়া করে প্রিয়জনেরা আসেই না কদাচিৎ!

 

যাদের আলিঙ্গন করেছিল একদা

যারা এখনো সেই ঘ্রাণের স্পর্শে তাড়িত হয়, চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় তখনকার কী অমেয় সময় তাদেরকে আবিষ্ট করে রেখেছে। কিন্তু, সেই দর্পিত, যুগলবন্দী মানুষটিই নেই, হারিয়ে গেছে অবেলার গান গেয়ে গেয়ে চিরদিনের মত!

তবুও, তাকায় না পৃথিবীর দিকে, নক্ষত্রপতনের দিকে, নদীর চরের দিকে...

এমনকি নিজের দিকেও খুব গভীরভাবে যে, আগের চে, ত্বক কিছুটা ঝুলে গেছে, বসে যাচ্ছে মুখ ও চোয়াল, কিংবা মিষ্টি খেলে রক্তে বিষ জমে যায়।

 

এইসব প্রাচীন কথা কেউ বিশ্বাসই করে না

অথচ, তাকে ঠিকই ঠায় নিতে হয়, নীরবে, কাউকে কিছু না বলে!

 

আসলে, তখন বলার কিছু তেমন থাকেও না...

 

দেশপ্রেম

 

সব মানুষই কি তার দেশকে ভালবাসে

কিংবা সব সন্তান তার মাকে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম শুকনো কাঠকে। কাঠ শুধু তার দেহকে ফালি করে দেখালো। দাহ্যতার ভিতরে দেখালো গুরুনিঃশ্বাস ছড়ানো ছিটানো...

 

মন্দিরের পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার অভিব্যক্তি, পুরোহিত পবিত্র গ্রন্থ আর উপরের দিকে ইশারা করে দেখালো। আমি তখন শঙ্খনাদ আর কাঁসরঘণ্টা  শুনলাম।

 

একবার এক প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দেশপ্রেমের মাহাত্ম্য, তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাবৎ বই ঘেঁটে আমাকে যে বয়ান দিলেন, অতিসাধারণ মন আমার, তল পেল না-- শুধু ভেতরটা কু ডাকতে থাকলো!

 

রাজনীতিবিদ, ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাগুরু থেকে শুরু করে সবাইকে একে একে জিজ্ঞেস করেছি--দেশপ্রেম, ভালবাসা কাকে বলে

প্রত্যেকেই যার যার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন সুনিপুণ চতুরতায়

কিন্তু, একজন কৃষক, একজন ছিন্নমূল মানুষ বলেছে,

ওসব ভারি ভারি কথা আমি বা আমরা বুঝিনা! শুধু জানি, ভাতের জন্যে আমাকে প্রতিদিন মাঠে যেতে হয় রোদে-বৃষ্টিতে ফসল ফলাতে হয় আর সাঁঝের বেলায় মাঠ থেকে গোরু, মহিষ নিরাপদে গোয়ালে আনতে-যেতে হয়! কাজ করতে হয় মনপ্রাণ ঢেলে, আর, আমার মাকে বুকে নিয়ে পরমবিশ্বাসে ঘুমাতে হয়। ফুটফুটে কোমল শিশুকে কোলে নিয়ে গভীর নির্ভরতায় আরও জানায় -

'সর্বোপরি, ফজরের আজান, সন্ধ্যার আরতিতে আমাদের দিন শুরু ও শেষ হয়!'

একটা মাছরাঙাকে দেখি তখন ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে দিগন্তের ওপারে উড়ে যাচ্ছে...

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন