বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

 

কবিতার কালিমাটি ১০৫


শিরোনামহীন

 

(১)

গাছেদেরও বয়স হয়। বয়স হলে তারা নদীর কাছে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খরস্রোতা নদীকে বয়ে যেতে দেখে। ভাবে এরকম জীবন হলে মন্দ হতো না। শিকড় আর ধরে  রাখতে পারে না। এইসব ভেবে শিকড় আরও শিথিল হয়ে যায়। প্রার্থনা করে শিকড় ছেড়ে গুঁড়ি হয়ে ভেসে যেতে। ভাবে যদি কিছু ক্লান্ত, ডুবন্ত পশু-পাখিকে নদী পার করিয়ে দিতে পারে এইভাবে। অথবা তারা গুঁড়ি হয়ে ভেসে যায়।

 

(২)

শিল্পী লাল, নীল, হলদে, সবুজ ইত্যাদি রঙ নিয়ে আঁকতে বসেছে। তার মনে খুব দুঃখ, তাই সে তার মন আঁকার দিকে ঘোরাতে চায়। কিন্তু আকাশ আঁকতে গিয়ে নীল রঙ দেওয়া মাত্র রঙ ভীষণ আপত্তি করে ওঠে। বলে, “আমি কেন সব সময়    আকাশ হব? আমারও তো কখন গাছ হতে ইচ্ছে করে! কেন গোলাপি আকাশ হতে পারে না? কেনই বা সবুজ পাতা হবে?” শিল্পী বলে, “আমি তো জানি না কেন!” “তুমি কখনও আমাদের কাছে জানতে চেয়েছ, আমাদের কী হতে ইচ্ছে করে?”  গোলাপি বলে ওঠে। এরপর সব রঙ বাক্স থেকে বেড়িয়ে নাচতে থাকে। আর শিল্পী দেখে তার চোখের সামনে খয়েরী পাখি হয়ে যায়। সবুজ আকাশ হয়ে যায়। নীল হয়ে যায় মাটি। গোলাপি রঙের সূর্য, আকাশে জ্বল জ্বল করতে থাকে।

 

(৩)

ঘরের জানলার সামনে একটা হলুদ পাখি, কোথা থেকে এসে বসে। অতীত ঘর থেকে তাকিয়ে দেখে পাখিটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাখির কাছে জানতে চায় সে কোত্থেকে এসেছে। পাখি কিছু বলে না শুধু উড়ে যায়। অতীত ভাবে কী আশ্চর্য এই পাখি! কেমন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল! পরের দিন দেখে একটি হলুদ পাখি সঙ্গে এসেছে। তারা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অতীত বাড়ির লোকদের জানায়। তারা কেউ পাখি দেখতে পায় না। তারা বলে যে অতীতের মনের ভুল। এরপর রোজ একটা একটা করে পাখি বাড়তে থাকে, গাছ ভর্তি হয়ে যায় অজস্র হলুদ পাখিতে। তারা ভিড় করে আর অতীতকে দেখে। কোনও শব্দ নেই, কোন আওয়াজ নেই, শুধু দেখে। পৃথিবীর সমস্ত হলুদ পাখিরা সেখানে ভিড় করেছে।   এরপর পাখিরা বাড়িতে ঢুকে পরে। অতীত পর্দা টেনে দেয়, ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে দেয়। নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে। অথচ খেয়াল করে না, সেদিন থেকে আর ঘড়ি চলছে না।

 

(৪)

চেতনা একদিন ঠিক করল সে বেড়াতে যাবে। অনতিদূর পথ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সমস্ত সবুজ গাছের পথ। নিরন্তর সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে একদিন অবচেতনের সাথে দেখা হয়ে যায় ঠিক। চেতনার মনে পড়ে না কবে শেষ দেখেছিল অবচেতনকে। এই অচেনা সবুজ ঢালুতে অবচেতনকে তার অন্যরকম লাগে। গাছের সাথে কথা বলতে থাকে তারা। বলে কীভাবে তারা ব্যস্ত শহরের অলিতে গলিতে থাকত আর কখন কদাচিৎ দেখা হত। গাছ জানতে চায় তারা চলে আসাতে  শহরের কী হল? অবচেতন বলে, সে তা জানে না, শুধু এটুকু জানে চেতনা চলে  যাওয়াতে তাকে প্রাণপণ খুঁজেছে শহরে। তারপর সেও চলে এসেছে। তখন একা শহরে সূর্য প্রতিফলিত হচ্ছে দেয়ালে, পাথরে। মেঘেরা একে একে ছায়া বিস্তার করছে, শহর ঘুমাবে বলে। অথচ নিদ্রা কখন বেরিয়ে গেছে শহর ছেড়ে চেতনা আর অবচেতনের খোঁজে। শহর তা জানে না।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন