কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৯ |
অধোমুখী মানুষ
অধোমুখী মানুষ আমি। সবকিছুতেই ভয়। দুপুরবেলা যখন ধুলো ওড়ে, ক্রমাগত হাঁচি দেই। বিকেলে সবাই যখন হেসে হেসে শপিং করতে যায়, পাশের বাসার নবনীতা সেজেগুজে বের হয়, জানালার ধারে বসে থাকি। বের হতে ভয় পাই।
নবনীতার ভাই আমার দুই বছরের বড়। আমাকে প্রায় বলে তুই খাওয়া দাওয়া করিস না কেন? আমি খুব শুকনো। প্যান্ট পরলে ঢলঢল করলে। ক্লাসে ছেলেরা বলে, আমার প্যান্ট নাকি জাতীয় পতাকা, বাতাসে পতপত করে ওড়ে। খানিকটা হ্যান্ডসাম দেখার জন্য কতো কী যে করি। গরমের মাঝেও জামার নিচে মোটা মোটা ২টো টি-শার্ট পরি। প্রতিদিন সকালবেলা হলে পড়ার টেবিলের পাশে ঝোলানো আয়নার কাছে উদ্দীপনামূলক লেখাটা পড়ি। তালিকাটা এরকম:
ক. তোমার কন্ঠস্বর সুন্দর
খ. তোমার হাতের লেখা সুন্দর
গ. তোমার স্মরণশক্তি অসাধারণ
ঘ. তুমি সৎ
তালিকটা পড়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের ভেতর তবু সিল্কের জামার মতো দুলে যায়; আমি দেখতে ভালো না, শত মানুষের ভিতরে ছেড়ে দিলে মিশে যাব। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমার দিকে মিষ্টি হেসে তাকায়নি। তালগাছের মতো আমি একপায়ে কতোদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম; কেউ আমার বেদনা বুঝুক।
অথচ আমি কতো বন্ধুদের ফোনে প্রক্সি দিয়েছি, ওপ্রান্ত থেকে মেয়েরা আমার কন্ঠ শুনে
বলেছে
: দরাজ কন্ঠ তুমি… এসো দেখা
হোক আমাদের।
দপ্তরহীন মন্ত্রীদের মতো বাক্যনবাব হয়ে একাকী ফিরেছি।
আমার ক্রোধ নেই, অনুরাগ নেই, প্রণয় নেই। পৃথিবীর কেউ আমার জন্যে আঙ্গুল টিপেটিপে টেক্সট পাঠায় না। আমার ই-মেইলে শুধু জাংক মেইল।
নবনীতাকে সাহস করে একবার চিঠি লিখেছিলাম, ভেবেছিলাম, কবিতা আর হাতের লেখা দিয়ে ইমপ্রেস করবো। চিঠিটা শুরু করেছিলাম দিলওয়ারের কবিতা দিয়ে।
নবনীতা পরদিন আমাকে ডেকে বলল;
: এই কুরুশকাঠি আজকাল কেউ চিঠি লেখে? বুদ্ধু। তবে তুমি সুন্দর লিখতে পারো, তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ..
এটুকুই। আর কিছু না। শরতের শিউলিফুলের মতো এটুকুই স্মৃতি। নবনীতা আরো লাবণ্যময়ী
হয়েছে। সারাদিন হেসে হেসে কার সাথে যেন কথা বলে।
সেদিন একটা সাক্ষাতকার পড়েছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের, কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জমান
নিয়েছিলেন। নি:সঙ্গ মানুষ স্বমেহন করে খুব।
হাহাকার ধ্বনিতে রাত নামে ধূসর বিছানায়… অক্ষম
আমি নবনীতাকে দলাই মলাই করি… আহা
ঘেমে উঠি কুরুশকাঠি পৌরুষে।
সপ্তাহের প্রতিদিন আমার চোখে বিপ্লবের অলীক সমাজ নেচে যায়। স্বপ্নে আমি নোবেল
প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করি। আয়নায় তাকালে মনে হয় আমি সবচেয়ে সুখী। সুখ বিষয়ক
মন্ত্রণালয় আমার করায়ত্ত। আমি মসলিন পরে হেঁটে যাই আমার সামন্তে।
বাংলাদেশ যখন শেষ ওভারে নিউজিল্যান্ডের ছয় ফিট বোলারকে উড়িয়ে ছক্কা মারে, সমস্ত
স্টেডিয়াম বাঘের গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ইথারে ইথারে গর্জন ছড়িয়ে আসে আমার আট
ফিট বাই আট ফিট আটচালায়;
কেন যেন আর মন খারাপ হয় না।
অস্পষ্ট ছায়ার মতো নবনীতা ভেসে যায় স্বাস্থ্যবতী কম্পনে। কী আশ্চর্য এই ফিতার মতো রঙ্গীন সত্যাগ্রহ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন