কালিমাটি অনলাইন / ৮৩
বিগত প্রায় দশমাস ধরে আমরা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ যে অচলাবস্থার মধ্যে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, তা থেকে মুক্ত হয়ে কবে আবার আগের মতো তথাকথিত সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব, তা সত্যি সত্যিই কারও পক্ষে সঠিক অনুমান করা সম্ভব নয়। এই ভাইরাসের প্রতিষেধকের অনুসন্ধান নিরলস ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে চলছে। বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা ব্যাপক ভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অসহায় ও সন্ত্রস্ত মানুষেরা অধীর আগ্রহে সেই দিনটির প্রতীক্ষায় আছে, যেদিন সেই প্রতিষেধক মানুষের শরীরে পরীক্ষাগত কারণে নয়, বরং নিরাময়ের কারণে নিশ্চিত হয়ে প্রয়োগ করা শুরু হবে। অবশ্য শুরু হলেও প্রতিটি দেশেই সব মানুষের কাছে সেই প্রতিষেধক পৌঁছতে যে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হবে, তা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। এবং এই দীর্ঘ সময়ের অবসরে যে আরও কত কত মানুষের জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তাতে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু চলমান জীবনের নিয়ম অনুসারেই ধ্বংসের পাশাপাশি সৃষ্টির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে কখনও গতি স্লথ হলেও তা স্তব্ধ হয়ে যায় না। জীবন পুরনো গতিপথ পাল্টে নতুন গতিপথ খুঁজে নেয়। পাল্টে যায় তার শৈলী, কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও। কার্যকারণ নিয়ম সূত্রেই তার এই চলাচল।
এবছর দুর্গাপুজো পঞ্জিকার হিসেব অনুযায়ী শরৎকালের পরিবর্তে উদযাপিত হচ্ছে হেমন্তকালে, যদিও আগমনীর সূচনা হয়েছে শরৎকালেই। তবে ঋতুর বিচারে না গিয়ে যদি আমরা এই পুজো উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবের কথা চিন্তা করি, তাহলে পুজো যখনই সম্পন্ন হোক না কেন, এই উৎসবকে শারদোৎসব নামেই অভিহিত করব। বিশেষত এই উৎসবে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরা নন, বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকেন বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও। আসলে দুর্গাপুজো যখন থেকে দুর্গোৎসবে উন্নীত হয়েছে, তখন থেকেই ভেঙে গেছে তথাকথিত ধর্ম সম্প্রদায়ের বেড়াজাল। আসলে যে কোনো উৎসবকে সঠিকভাবে রূপদান করতে পারে বিভিন্ন পেশার শিল্পী এবং কর্মীরা। পুজোর উপাচার থেকে উৎসবস্থল সাজানোর বহর, সাধারণ মানুষের নিজেদের সাজানোর জন্য যাবতীয় পোশাক ও পরিচ্ছদ, রসনা তৃপ্তির রকমারি উপাদান ও আয়োজন, সেইসঙ্গে আনন্দকে নতুন নতুন রূপ দেবার জন্য কত কত শ্রমিক ও শিল্পীর যে নিরলস যোগদান ও অবদান থাকে, তার তালিকা কিন্তু সত্যি সত্যিই সুদীর্ঘ এবং ব্যাপক। অবশ্য সেইসঙ্গে উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন ও কর্তব্য, উৎসবের তাৎপর্য কী এবং কেন। এই প্রাসঙ্গিকতায় উদ্ধৃত করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধের অংশ বিশেষ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না – যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বারা ক্ষুদ্ধ করি, সেদিন না — যেদিন প্রাকৃতিক নিয়ম পরস্পরায় হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো — সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না — সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট — সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না — সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না — সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না। প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী — কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ”!
কিন্তু অত্যন্ত বেদনার ব্যাপার, এবছর আমাদের এই শারদোৎসব থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। উৎসবের আয়োজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো হবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা সম্ভবত উৎসবের রূপ ও আকার ধারণ করবে না। বিশেষত নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করা আদৌ উচিৎ হবে না। বরং আমরা আমাদের অতীত উৎসবের দিনগুলির স্মৃতি রোমন্থন করে নিজেদের উজ্জীবিত করতে পারি এবং আশা করতে পারি, আগামী বছরে করোনামুক্ত উৎসবের দিনগুলিতে এবছরের অপ্রাপ্তিগুলোকে সুদে আসলে মিটিয়ে নেব নিশ্চিতভাবে ।
সবার সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন কামনা করি।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com
/ kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Phase 2, Parvati
Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar,
Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.