বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৮৩


বিগত প্রায় দশমাস ধরে আমরা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ যে অচলাবস্থার মধ্যে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, তা থেকে মুক্ত হয়ে কবে আবার আগের মতো তথাকথিত সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব, তা সত্যি সত্যিই কারও পক্ষে সঠিক অনুমান করা সম্ভব নয়। এই ভাইরাসের প্রতিষেধকের অনুসন্ধান নিরলস ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে চলছে। বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা ব্যাপক ভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অসহায় ও সন্ত্রস্ত মানুষেরা অধীর আগ্রহে সেই দিনটির প্রতীক্ষায় আছে, যেদিন সেই প্রতিষেধক মানুষের শরীরে পরীক্ষাগত কারণে নয়, বরং নিরাময়ের কারণে নিশ্চিত হয়ে প্রয়োগ করা শুরু হবে। অবশ্য শুরু হলেও প্রতিটি দেশেই সব মানুষের কাছে সেই প্রতিষেধক পৌঁছতে যে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হবে, তা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। এবং এই দীর্ঘ সময়ের অবসরে যে আরও কত কত মানুষের জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তাতে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু চলমান জীবনের নিয়ম  অনুসারেই ধ্বংসের পাশাপাশি সৃষ্টির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে কখনও গতি স্লথ হলেও তা স্তব্ধ হয়ে যায় না। জীবন পুরনো গতিপথ পাল্টে নতুন গতিপথ খুঁজে নেয়। পাল্টে যায় তার শৈলী, কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও। কার্যকারণ নিয়ম সূত্রেই তার এই চলাচল।

এবছর দুর্গাপুজো পঞ্জিকার হিসেব অনুযায়ী শরৎকালের পরিবর্তে উদযাপিত হচ্ছে হেমন্তকালে, যদিও আগমনীর সূচনা হয়েছে শরৎকালেই। তবে ঋতুর বিচারে না গিয়ে যদি আমরা এই পুজো উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবের কথা চিন্তা করি, তাহলে পুজো যখনই সম্পন্ন হোক না কেন, এই উৎসবকে শারদোৎসব নামেই অভিহিত করব। বিশেষত এই উৎসবে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরা নন, বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকেন বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও। আসলে দুর্গাপুজো যখন থেকে দুর্গোৎসবে উন্নীত হয়েছে, তখন থেকেই ভেঙে গেছে তথাকথিত ধর্ম সম্প্রদায়ের বেড়াজাল। আসলে যে কোনো উৎসবকে সঠিকভাবে রূপদান করতে পারে বিভিন্ন পেশার শিল্পী এবং কর্মীরা। পুজোর উপাচার থেকে উৎসবস্থল সাজানোর বহর, সাধারণ মানুষের নিজেদের সাজানোর জন্য যাবতীয় পোশাক ও পরিচ্ছদ, রসনা তৃপ্তির রকমারি উপাদান ও আয়োজন, সেইসঙ্গে আনন্দকে নতুন নতুন রূপ দেবার জন্য কত কত শ্রমিক ও শিল্পীর যে নিরলস যোগদান ও অবদান থাকে, তার তালিকা কিন্তু সত্যি সত্যিই সুদীর্ঘ এবং ব্যাপক। অবশ্য সেইসঙ্গে উপলব্ধি করা একান্ত  প্রয়োজন ও কর্তব্য, উৎসবের তাৎপর্য কী এবং কেন। এই প্রাসঙ্গিকতায় উদ্ধৃত করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধের অংশ বিশেষ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না – যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বারা ক্ষুদ্ধ করি, সেদিন না — যেদিন প্রাকৃতিক নিয়ম পরস্পরায় হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো — সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না — সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট — সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না — সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না — সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না। প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী — কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ”!

কিন্তু অত্যন্ত বেদনার ব্যাপার, এবছর আমাদের এই শারদোৎসব থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। উৎসবের আয়োজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো হবে, কিন্তু  প্রকৃত অর্থে তা সম্ভবত উৎসবের রূপ ও আকার ধারণ করবে না। বিশেষত নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করা আদৌ উচিৎ হবে না। বরং আমরা আমাদের অতীত উৎসবের দিনগুলির স্মৃতি রোমন্থন করে নিজেদের উজ্জীবিত করতে পারি এবং আশা করতে পারি, আগামী বছরে করোনামুক্ত উৎসবের দিনগুলিতে এবছরের অপ্রাপ্তিগুলোকে সুদে আসলে মিটিয়ে নেব নিশ্চিতভাবে ।

সবার সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন কামনা করি।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

                                         


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

সভ্যতার ধূসর পর্ব আর অপনায়ক নন্দলাল




Antihero-র ধারণার জনক ব’লে ধরে নেওয়া ফিওদর দস্তয়েভস্কি Notes from the Underground বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের দশম অধ্যায়ে বলেছিলেন, কোনো  উপন্যাসের পক্ষে নায়ক দরকার, আর antihero-র সকল বৈশিষ্ট্য এখানেই খোলসা করে বলা আছে, আর সব চেয়ে যেটা বড় ব্যাপার, এর সবই একটা অপ্রীতিকর বোধের জন্ম দেয়, কারণ আমরা সবাই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আর আমাদের প্রত্যেকেই কম বেশি পঙ্গু লোক। আমরা জীবনের এর থেকে এত বিচ্ছিন্ন যে আমরা সবাই একসঙ্গেই সত্যিকার জীবনের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা  পোষণ করি, আর সেজন্যে তার কথা মনে করিয়ে দেওয়া সহ্য  করতে  পারি  না। (‘A novel needs a hero, and all the traits of an antihero are expressly gathered together here, and what matters most, it all produces an unpleasant impression, for we are all divorced from life, we are all cripples, every one of us, more or less. We are so divorced from it that we feel at once a sort of loathing for real life, and so cannot bear to be reminded of it.’) দস্তয়েভস্কির এই বইয়ের ত্রিশ বছর আগেই অবশ্য Georg Büchner তাঁর Woyzeck  নাটকে ‘loser’-এর কথা বলেছিলেন। সেও এক antihero। এদের কাজ বিরাজমান সমাজ আর তার অধঃশায়ী আদর্শতত্ত্বকে  ‘perturber’, ‘disturber’, এমনকি 'subverter’ হিসেবে একটু নড়িয়ে দেওয়া। ব্রেখট বলে গেছেন, ‘Unhappy the country that needs heroes’। মনে আছে চেক লেখক Jaroslav Hašek-এর লেখা Good [মানে bad] Soldier Švejk ব্যঙ্গোপন্যাসের কথা, যার থেকে ১৯৬০-এ The Good Soldier Schweik নামের ছবি আর থিয়েটার ওয়ার্কশপে বিভাস চক্রবর্তীর অসাধারণ চরিত্রায়নে ‘সোয়াইক গেল যুদ্ধে’ সোয়াইক গেল বাংলা  নাটকের কথা। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে আর্দালি হিসেবে  কর্মরত সোয়াইক সম্পর্কে Victor Brombert-এর In  Praise of Antiheroes: Figures and Themes in Modern European Literature, 1830-1980 (Chicage and London: University of Chicage, 1999) নামক অসাধারণ সাহিত্যসমালোচনা গ্রন্থে কথাগুলি হলো, সমরপ্রিয় উগ্র দেশপ্রেমী এক পাগল হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এক অবীর কিন্তু বিদ্রোহী জীবনধারণশিল্পী (an unheroic yet rebellious  survival artist in a jingoistic world gone mad), পৃঃ ৭। তার ভান করা মানসিক দুর্বলতাকে সে কর্তৃত্বের সঙ্গে স্থায়ী লড়াইয়ে অস্ত্র  হিসেবে ব্যবহার করে। তার কাজ বিপ্লব নয়, নবারুণ ভট্টাচার্যর ভাষায় ফ্যাতাড়ুগিরি বা চোক্তারি, এই যেমন কর্তৃত্বের বাড়িতে গিয়ে তার বৈঠকখানার সোফায় গোপনে আঙুল ঢুকিয়ে গর্ত ক’রে দিলেন।    

Antihero-র এই জীবনধারণশিল্পীর দিকটা আমি নিচ্ছি। বাংলা সাহিত্যে এর একটা প্রাক্‌নিদর্শনও পাচ্ছি, যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নন্দলাল। আসলে নন্দলালকে দেখছি এই পতিত সময়ের প্রতীক বা নির্যাস হিসেবে। এই পতিত সময়ের চিত্রকল্পায়নের জন্য মুষলপর্বের ইমেজ নিচ্ছি না। সেই কবে  যদুবংশের কিশোররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার জন্যে শরকাঠি হাতে নিলো, আর দৈবী ব্যতিচারে বা হস্তক্ষেপে শরকাঠি মুষল হয়ে গেল, তখন থেকে বাংলা ভাষায় স্বানীত সংকটের সব চেয়ে কবিপ্রসিদ্ধ, বিবর্ণ বর্ণক মুষলপর্ব। আমি এর নাম দিচ্ছি ধূসরপর্ব। কবে থেকেই Jean Baudrillard-র কথামতো পৃথিবীর সেই ওরিজিন্যাল আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আছে কেবল তার নকল (copy) বা simulacrum। সেই নকল, যাকে বলা যাবে ধূসর অ-পাণ্ডুলিপি তা মানুষের অনেক অত্যাচারের প্রকোপ সহ্য ক’রে শেষে এক ভাইরাসের চাপে ধুঁকছে। কিম্বা হয়তো গ্রিক গে বা হিন্দু শাস্ত্রের ধরিত্রী দেবীর মতো পৃথিবীর মূল পাণ্ডুলিপি হারানো পৃথিবীর নকল নয় তার মহাকীট মানুষরাই ধুঁকছে। তাতে গে-র কিছু আসে যায়ই না। এই সময়ের যুগবাণী বাজছে, ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন, ভালো থাকুন, আর হাত ধোন। ঘরে থাকাটাই সভ্যতার প্রতি আপনার শ্রেষ্ঠ অবদান। আর আমরা সম্পন্ন বৃদ্ধরা নিজেদের বানিয়ে ফেলেছি নন্দলাল। যার সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন। এই আত্মসর্বস্বতাকে নিয়ে লেখা  ব্যঙ্গকবিতাটি একসময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনবিমুখ মানুষের সম্বন্ধে লোকের মুখে মুখে ঘুরতো। পরে ছাত্রপাঠ্য  কেতাবে স্থান পায়। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা আন্দোলনবিমুখ নন্দলালদের রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্তির যুগে এই কবিতাটির খবর সমসময়ের অনেকে হয়তো রাখেন না।

নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-

স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।

সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?

নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?

আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’

তখন সকলে বলিল - ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ!’

 

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেবা!

সকলে বলিল, ‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা।

নন্দ বলিল, ‘ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-

না হয় দিলাম, - কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?

বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারি দিক্।

তখন সকলে বলিল - ‘হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক!’

 

নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,

গালি দিয়া সবে গদ্যে পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;

পড়িলো ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;

লেখে যতো তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;

খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,

তখন সকলে বলিল - ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।

 

নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;

সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;

নন্দ বলিল, “আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,

কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?

বলো ক’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা

তখন সকলে বলিল - “বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!”

 

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;

চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,

নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিশনহয়;

হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়,

তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল

সকলে বলিল - ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।

আমরা যারা এই কোভিডক্লান্ত যুগে অপনায়কের নন্দলালবৃত্তি গ্রহণ করেছি, তারা নিজেদের বাড়িকে বানিয়েছি দুর্গ। বাইরে না গিয়ে, ফোনে অনলাইনে রসদ আনিয়ে, বাইরে থেকে ব্যাগে ক’রে ফেরিওয়ালা-ঠ্যালাওয়ালাদের জিনিস তুলে  নিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখছি। কিন্তু বাইরে আছে উন্মুক্ত কারাগার। সেখানে পেটের দায়ে আবদ্ধবিচরণে আটক হাজার মানুষ, যাঁদের অন্ন আসে কেবল এই সম্পন্ন নন্দলালদের জিনিস যুগিয়ে। আমরা জীবনধারণশিল্পীরা বুঝে গেছি যে  একটা সময়ে যে মানুষরা সমাজে, ইতিহাসে বীরনায়কের ভূমিকা পালন করতেন না, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলা হতো এরা দেশের জন্য কেবল মলমূত্র ত্যাগ করেছেন।  কিন্তু এখন অপনায়কদের যুগে তাতেও চলবে। আমরা নন্দলালরা বলব ‘আমরা কত করছি দেখ!/মলদ্বারে স্বার্থত্যাগ’। সকলে বলবে আহা! ‘যদি করো প্রস্রাব,/ ঘরে ও নিভৃতে/ তাতে রবে ঢের ছাপ/ নব পৃথিবীতে’। 


বন্ধু, এই লেখা এক উদ্ভ্রান্ত বৃদ্ধের, যে করোনাগমনকালে যাবতীয় সাবধানতা অবলম্বন ক’রে এখন উত্তর চব্বিশ পরগণার এক অনভিজাত কিন্তু সম্পন্ন এলাকায় চতুর্দিকে করোনাক্রান্তদের বাড়ির মাঝখানে বসে আছে। একটি মৃত্যুর ছায়াও পড়েছে। সে অবাক হয়ে দেখছে ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল’ পংক্তিটি তার ব্যঙ্গবিষ হারিয়েছে। কারণ বীরত্বের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। দেশের জন্য যুদ্ধে, বিপ্লবে স্বার্থত্যাগ আর তার সংজ্ঞা নয়। তার জন্য কেবল দরকার ‘তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে’ থেকে ফোনে অনলাইনে আ-মাজন যাবতীয় কেনাকাটা করা যাতে অর্থব্যবস্থার সংকোচন আটকানো যায়। কিন্তু চতুর্দিকে যা ঘটছে মানুষের উপর অন্যায় যোগীরাজ্যে, দিদিরাজ্যে, মোদীরাজ্যে তার সম্বন্ধে ভাববেন না। আমরা কেবল বলে যাবো, ‘দেশের জন্য করছি দেখ,/ মলদ্বারে স্বার্থত্যাগ’; ‘নিজগৃহে পেচ্ছাপ,/ তাহাতেও ঢের ছাপ,/ থেকে যাবে পৃথিবীতে,/ বেঁচে থেকে যাও জিতে’। সকলে বলবে ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।

কিন্তু তবু এই আত্মনিগ্রহের পরও সবাইকে আসন্ন মহাপূজার শারদ অভিনন্দন জানিয়ে বলবো এই পূজায় বাইরে প্রতিমা দর্শনে বেরোবেন না। বাইরে পানভোজন করবেন না! এর ফলে করোনাক্রমণ সুনামি হয়ে উঠতে পারে। অপনায়ক থেকে আবার খলনায়ক হবো নাকি?            

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২  




আগের বার বলেছিলাম, এই কোভিড আবহে আরো কয়েকটা মহামারী সম্বন্ধিত সিনেমার কথা লিখব, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। এই ছবিগুলো মূলত সাইকোলজিকাল। সমাজে কোন মহামারী হলে মানুষ মনের দিক থেকে কীরকম  বদলে যায়, সেই নিয়ে ছায়াছবি। অবাক ব্যাপার, আমার লেখা যখন এগোবে, দেখতে পাবেন এইসব সিনেমাতেও কী অদ্ভুতভাবে যেন আজকের পৃথিবীর জলছাপ  উঠে এসেছে। প্রথম ছবির নাম ‘ব্লাইন্ডনেস’ (২০০৮), দ্বিতীয় ছবির নাম ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ (২০১৫) ও তৃতীয় ছবির নাম ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’ (২০১৭)। তবে একটা ব্যাপার শুরুতেই জানিয়ে রাখি, মহামারী দেখালেই হিন্দি-ইংরাজি বাজার চলতি ছবির একটা কমন ফর্মূলা আছে... গোটা শহর ফাঁকা, মরে যাওয়া মানুষগুলো ভূতুড়ে জম্বি টাইপ বাঁকা শরীর নিয়ে এগোয়, আর বেঁচে থাকা মানুষদের কামড়ে তাদেরও জম্বি বানানোর চেষ্টা করে। এইসব হাস্যকর ছবির কোন উপাদান আমার লেখায় নেই। 


‘ব্লাইন্ডনেস’ সিনেমার ঝুলিতে বেশ কিছু পুরস্কার রয়েছে। এমনকি এই ছবি ২০০৮ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন পাম’ পুরস্কারের জন্য সেরা ছবির দৌড়েও প্রথম সারিতে ছিল। ছায়াছবির পরিচালক ফার্নান্দো মিরেলেস। মুখ্য চরিত্রে জুলিয়েন মুর
(এখনকার একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী, ২০১৪ সালে ‘স্টিল অ্যালিস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছেন) ও মার্ক রাফেলো (‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’ সিনেমার সেই বিখ্যাত হাল্ক)এক পোর্তুগিজ উপন্যাসের ছায়ায় তৈরি এই সিনেমা শুরু হচ্ছে অদ্ভুতভাবে। কোন এক ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক সিগনালে এক ব্যক্তি হঠাৎ বুঝলেন, তিনি আর দেখতে পাচ্ছেন না। তার চোখের সামনে সব সাদা হয়ে গেছে। অচেনা একজন তাকে তার গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়িতে ছেড়ে আসার পর সেই ব্যক্তির স্ত্রী তাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারের ভূমিকায় রাফেলো। তো, রাফেলোর কাছেও এই ধরনের কেস নতুন। তিনি রুগিকে হাসপাতালে রেফার করে দিলেন। কয়েকদিন পর রাফেলোর আরেক রুগিও হঠাৎ এই রোগে আক্রান্ত হল। এবং এরপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাফেলো বুঝলেন তার চোখের সামনেও সবকিছু সাদা হয়ে গেছে। শহরে এই ছোঁয়াচে অন্ধত্ব রোগ মহামারীর মত হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। ভয়ে মানুষ বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। এর নাম দেওয়া হল ‘হোয়াইট ব্লাইন্ডনেস’। এই রোগে সদ্য অন্ধ হয়ে যাওয়া আক্রান্তদের, সুস্থ মানুষদের থেকে আলাদা রাখার জন্য, প্রশাসন এক পরিত্যক্ত মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায় সেখানে তাদের চরম দুর্দশার একমাত্র সাক্ষী হল রাফেলোর স্ত্রীর ভূমিকায় জুলিয়েন, যে অন্ধ না হয়েও নিজের স্বামীর খেয়াল রাখার জন্য অন্ধের অভিনয় করে স্বামীর সঙ্গেই সেই মানসিক হাসপাতালে থাকতে আসেতার সাহায্যেই অন্যরা লাইন দিয়ে বাথরুম যেতে শেখে। এরপর সেখানে প্রতিদিন নতুন আক্রান্তদের আনা হয়, রোজ এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে অসামাজিক ও শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর অতাচার শুরু করে। বেশ কিছু বাজে কার্যকলাপ শুরু হয়। পুলিশের গুলিতে অনেকে মারা যায়। একদিন জুলিয়েন সাতজন এইরকম অন্ধকে নিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ভাইরাস বিধ্বস্ত শুনশান  শহরের মধ্যে দিয়ে তারা এসে ওঠে রাফেলোর নিজের বাড়িতে। হঠাৎ একদিন সেই ব্যক্তি, যে গাড়ি চালাতে চালাতে অন্ধ হয়ে গেছিল, সে দৃষ্টি ফিরে পায়। বাকিরা আবার নতুন করে আশার আলো পায়।

এই সিনেমার সবথেকে নজরকাড়া অংশ হচ্ছে ঐ মানসিক হাসপাতালে অনেক রুগি হয়ে যাবার পর কীভাবে শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করছে,  হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ভাগে বেশি পাবার জন্য অসামাজিক কাজকর্ম শুরু  করছে। এমনকি অন্ধ হয়েও বাকিদের ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালাচ্ছে। এবার আসুন বাস্তবের মাটিতে। গোটা ভারত কোভিড আতঙ্কে ভুগছে। যে কোন সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। অথচ মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হতেই মাস্কের দাম হাতের বাইরে চলে গেল, প্যারাসিটামল অপ্রতুল হয়ে গেল, স্যানিটাইজার আর ডায়াবেটিসের ওষুধ উধাও হয়ে গেল। যে হ্যান্ড-ওয়াশের দাম পঞ্চাশ টাকা, সেটা দেখলাম দুশ টাকায় বিক্রি হচ্ছেদশ টাকার মাস্ক চল্লিশ টাকায়। বাধ্য হয়ে  সাধারণ মানুষ সেগুলো কিনছে। প্রাইভেট হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার নামে পাঁচ-ছ’লাখ টাকার প্যাকেজ চালু হয়ে গেল। এগুলো অসামাজিক নয়? আরেকটু এগিয়ে আসুন। গত কয়েকমাস হল নিউজ চ্যানেলে দেখছি কোথাও কোভিড আক্রান্তর স্ত্রী ফ্ল্যাটের ছাদে কাপড় মেলতে উঠলে তাকে মারধর করা হচ্ছে, কোথাও আবার আক্রান্তর পরিবারকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে বা হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোথাও সংক্রামিতকে ৬ কিলোমিটার নিয়ে যাবার জন্য ৯০০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে, কখনো মৃত ব্যক্তিকে দাহ করার জন্য বা তার মুখ দেখানোর জন্য তার ছেলে- মেয়ের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে। তার মানে ভাইরাস আক্রান্ত একই সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ, আরেক শ্রেণীর দুর্বল মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছে।  মনোযোগ সহকারে ব্লাইন্ডনেস দেখুন – এই মুহূর্তের অনেক কিছুই চোখে পড়বে। 



১৯৭৪ সালে একই নামের বিখ্যাত উপন্যাসের ছায়ায় তৈরি ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ ছবির পরিচালক ক্রেগ জোবেল। এই ছবিকে ফিনিক্স ফিল্ম ক্রিটিক সোসাইটি ২০১৫ সালের ‘ওভারলুকড ফিল্ম অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত করেছিল। সিনেমার প্রধান চরিত্রে চিওয়েটেল এজিওফোর। নায়িকার চরিত্রে মার্গট রবি। সহচরিত্রে ক্রিস পাইন। দুজনেই এজিওফোরের তুলনায় জুনিয়র। এজিওফোর অভিনীত ‘টুয়েলভ ইয়ারস এ স্লেভ’ ২০১৩-য় সেরা ছবির অস্কার পেয়েছিল। এজিওফোর বেশ
রিণত অভিনেতা। পকেটে বেশ কয়েকটা বেস্ট অ্যাক্টর পুরস্কার।  তবে বহু বছর আগে দেখা এজিওফো্রের প্রথম যে ছবি আমার মনে দাগ কেটেছিল সেটা হল ‘ডার্টি প্রেটি থিংস’ (২০০২)। যাইহোক, ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ প্রসঙ্গে আসি। এই ছবি ভাইরাস ঘটিত কারণে নয়, রেডিও-অ্যাক্টিভ দূষণের জন্য প্রায়  গোটা শহরের মৃত্যুর পর শুরু হচ্ছে। মার্গট জনপদ থেকে বহুদূরে পাহাড়ের ওপর তার পূর্বপুরুষের ফার্ম হাউসে একাই থাকে। চাষবাস করার চেষ্টা করে। চাষ যা হয়, সেই খেয়েই দিন কাটায়। তার বাবা-মা-ভাই মহামারীর পর এই ফার্ম হাউস ছেড়ে জনপদে গেছিল যদি কেউ বেঁচে থাকে, তাদের উদ্ধার করতে। কিন্তু এদের কেউ আর ফিরে আসে নি। সেই থেকে মার্গট একা। একদিন এক ইঞ্জিনীয়র (এজিওফোর) বহুদূর থেকে ওষুধপত্র আর রেডিয়েশন স্যুট পরে (অনেকটা  এখনকার পিপিই কিটের মত) মার্গটের পাহাড়ে আসেসেখানে উপত্যকার দূষিত ঝর্ণার জলে স্নান করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবশ্য মার্গটের সেবায় আবার ভাল হয়ে ওঠে। এই দুজন মিলে ফার্ম হাউসের চাষবাস অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়, ট্রাক্টর সারিয়ে আবার কর্মক্ষম করে তোলে। এমনকি এজিওফোর জলবিদ্যুতের সাহায্যে ফার্ম হাউসে আলো আনার কথাও ভাবতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই দুজনের রসায়ন খুব কাছাকাছি আসে এবং মার্গট এজিওফোরকে ভালবাসতে শুরু করে। এই অব্দি  ঠিকঠাক। তারপর শুরু হয় সমস্যা যেই তৃতীয় এক ব্যক্তি, ক্রিস, সেই ফার্মহাউসে এসে হাজির হয়। এজিওফোর ক্রিসের অতীত জানতে চাইলে ক্রিস সেইসব প্রশ্ন এড়িয়ে যায় অথচ মার্গটকে জানায় সে ক্যাথলিক। ফলে এজিওফোর ক্রিস-কে নিয়ে সন্দিহান হলেও মার্গট তাকে অভ্যর্থনা জানায় যেহেতু সে নিজেও ক্যাথলিক। এরপর অনেক নাটকীয় মোড় আছে এই সিনেমায় যা সিনেমার প্রয়োজনেই এসেছে। এবং একসময় দেখা যায় এজিওফোর ও ক্রিস জলবিদ্যুতের জন্য ঝর্ণার ওপর বিশাল এক কাঠের চাকা সারাচ্ছে। ক্রিস দড়ি ধরেও পিছলে খাদে পড়ে যাবার মুখে এজিওফোর দড়ির অন্যপ্রান্ত চেপে রেখে দুজনে দুজনের চোখের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে আছে। এখান থেকে সিন কাট করে পরিচালক চলে যান পরের সিনে, যেখানে এজিওফোর মার্গটকে জানাচ্ছে যে ক্রিস তাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং মার্গট অনেক খুঁজেও ক্রিসকে না পেয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। এরপর ফার্ম হাউসে বিদ্যুৎ আসে। মার্গট ও এজিওফোর তাদের দৈনন্দিন জীবনে আবার অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এবং আমরা বুঝতে পারি যে এজিওফোরের চোখে অপরাধবোধের গ্লানি লুকিয়ে।

এই ছবি দেখে অনেকের মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে জাকারাইয়া-র সঙ্গে ১৯৫৯ সালের ছবি ‘দি ওয়ার্ল্ড, দ্য ফ্লেশ অ্যান্ড দ্য ডেভিল’-এর অনেক মিল আছে। অ্যাটম বোমার বিষাক্ত ছোবলের ফলে এক শহরের জনশূন্য হয়ে যাওয়া, মাত্র দুটি পুরুষ  ও একটি নারীর বেঁচে থাকা, দুই পুরুষের লড়াই আর সবশেষে একসাথে তিনজনের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলা। যদিও আমার মনে হয়েছে, মোটিভ ও ফিনিশিংয়ের দিক থেকে ‘জাকারাইয়া’ অনেকটাই জটিল। এখানে মনস্তত্ব নিয়ে খুব সূক্ষ্ম দিক ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন রিসোর্স সীমিত, তখন প্রত্যেকজন অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। কার কাল কী হবে, কেউ জানে না। কে বেঁচে থাকবে, কেউ জানে না।  ফলে সবাই চাইবে, সে নিজে বেঁচে থাকুক আর প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক। এবার ভাবুন, আজ আমাদের সমাজের জটিল অবস্থান কোথায়সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে। সবাই শুধু নিজে বেঁচে থাকতে চায়, অন্যের বিষয়ে কেউ জানতে চায় না। প্রত্যেকেই নিজের বাড়িতে একেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে বেঁচে আছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বনগাঁয় এক কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার বদলে চালক পিপিই কিট পরে পাশ থেকে মজা দেখছিল, কোন একজন মোবাইলে এই ঘটনার ভিডিও তুলছিল, কিন্তু এদের কেউ সেই ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয় নি বলে সে রাস্তাতেই মারা যায়। ভালভাবে দেখুন, ‘জাকারিয়া’ এই ঘটনাই অন্যভাবে দেখিয়েছে।  




তৃতীয় ছবি ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’-এর পরিচালক এক তরু, ৩২ বছর বয়সী ট্রে এডওয়ার্ড শাল্টসএইমাত্র যেটা বল্লাম, সেটাকে একটু ঘুরিয়ে যদি এভাবে বলি যে সবাই চায়, সে নিজে তার পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকুক আর প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে সেই পরিবার প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক – যার শেষ ধাপ হল ডারউইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’, তাহলে সেই নৈরাজ্যের সার্থক রূপায়ন এই  সিনেমা। এই ছবির ট্যাগ ‘ফিয়ার টার্নস মেন ইনটু মনস্টারস’। ইট কামস অ্যাট নাইট – অন্ধকারে কে আসে? কী আসে? ভয়। আর সেই ভয় থেকেই মানুষ অন্যকে  মেরে ফেলতেও পিছপা হয় না। ছবির শুরুতেই এমন একটা দৃশ্য আছে যা আপনাকে ধাক্কা মারবেই। আমি এই ছবি দেখার পর দু’রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। খালি মনে হত, আমার যদি একদিন ঐ হাল হয়! সুতরাং আমি শুরুতেই  একটু সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখি যে নরম হৃদয়ের পাঠক-পাঠিকা এই মুভি দেখবেন না। এটাও বলে রাখি, এই মুভি বেশ কয়েকটা ফিল্ম ক্রিটিক সোসাইটির সেরা হরর মুভি পুরস্কার পেয়েছে।

সিনেমা শুরু হচ্ছে অন্য মুভির মতই, এক ছোঁয়াচে অতিমারীর প্রকোপে দেশের পর দেশ জনশূন্য। এখন যারা বেঁচে আছে, তারা গভীর বনে-জঙ্গলে অন্যের ছোঁয়া  এড়িয়ে, লুটপাট এড়িয়ে থাকে। জঙ্গলে যা পাওয়া যায়, তাই খায়। এরকম এক পরিবারে সিনেমার প্রথম নায়ক জোয়েল এডগার্টন তার বউ, কিশোর ছেলে আর শ্বশুরকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকে। শুরুতেই আমরা দেখি জোয়েলের শ্বশুর সেই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য জোয়েল তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির একটু দূরে গিয়ে গুলি করে শ্বশুরকে মেরে ফেলে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এর কিছুদিন পর ছবির দ্বিতীয় নায়ক ক্রিস্টোফার অ্যাবট তাদের বাড়িতে খাবারের খোঁজে এসে জোয়েলের হাতে আটক হয়। যদিও অ্যাবটকে নিয়ে জোয়েল তাদের বাড়িতে যায় ও অ্যাবটের বউ ও ছোট বাচ্চাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর অনেক টানটান উত্তেজনা আছে, ভয় আছে, নাটকীয়তা আছে, অবিশ্বাস আছেপ্রায় শেষে, অ্যাবটের ছোট বাচ্চার রোগ হয়েছে সন্দেহে জোয়েল তাদের পুরো পরিবারকে গুলি করে মেরে ফেলে। সবশেষে, জোয়েলের ছেলে সেই ছোঁয়াচে রোগে মারা যায়।    

আজকাল আমরা টিভি চ্যানেলে মাঝে মাঝেই দেখি, রাস্তায় কোন একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে কিন্তু করোনার ভয়ে কিন্তু কেউ তার ধারেকাছে যাচ্ছে না। সারাদিন পড়ে থাকার পর সন্ধেবেলা যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে সে আর নেই। অথবা ফাঁকা শুনশান রাস্তায় কোন বৃদ্ধ রেশন নিয়ে যখন  আসছিলেন, তখন একদল মুখঢাকা যুবক তার ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। অথবা আরো শকিং ঘটনাও শোনা যায় – বয়স্ক গৃহকর্তা অফিস থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে জ্বর-কাশি নিয়ে ভুগছেন, নিঃশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু তার নিজের বউ-ছেলে-মেয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না করোনার ভয়ে, বরং বাইরে থেকে ঘরের দরজায় ল্যাচ টেনে তারা পুলিশে খবর দিচ্ছে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। পুলিশ এসে দরজা খুলে দেখছে সেই ব্যাক্তি ততক্ষণে মারা গেছেন। এর একটাই অর্থ। এই সমাজের ভেতর এক ঘুণপোকা ঢুকে গিয়ে আমাদের সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রয়োজন হলে পরোক্ষভাবে অন্যকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছি না। আমরা সবাই চাই যদ্দিন সম্ভব নিজে বেঁচে থাকতে কার আমরা জানি আমাদের প্রত্যেকের জীবন অনিশ্চিত। এটাই তো এই ছবি জোর দিয়ে দেখাতে চাইছে। তাহলে কে বলে যে সিনেমা শুধুই রিল? কে বলে সিনেমা বাস্তবের ছায়ায় উঠে আসে না? আসলে এই তিনটে ছবিই এক সূতোয় বাঁধা – যখন সামাজিক বিপর্যয় আমাদের ঘিরে ধরে, তখন আমরা কী রকম বদলে যাই, আমাদের মনস্তত্ব কোনদিকে চালিত হয়,  অস্তিত্বের বিপন্নতা আমাদের কীভাবে স্বার্থপর হতে শেখায়, আমাদের ভেতরের  রাক্ষসটা কীভাবে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ যেন হুবহু জীবনানন্দের ১৯৪৬- ৪৭ – ‘মানুষ মেরেছি আমি – তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে / পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি’।

যাইহোক, ভাইরাস আর মহামারী নিয়ে অনেকগুলো সিনেমার কথা লিখলাম। উৎসাহী পাঠক বাকিটা নিজেরা খুঁজে পেতে দেখুন। এরপর আমি আগামীতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বা মহামারী নিয়ে কোন সিনেমার কথাই আর কলমের ডগায় আনব না। বরং পরের বার জীবন ও তার উপভোগ্যতা, এই নিয়ে কয়েকটা ক্লাসিক সিনেমার কথা বলব। মন ভাল করব।  

 


ফারহানা রহমান

 

বাহমান ঘোবাদি ও তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই 




আব্বাস কিরোস্টামির পর বাহমান ঘোবাদিকেই ইরানের সবচেয়ে প্রতিভাবান, আধুনিক ও ভিন্নধারার একজন চলচ্চিত্রকার মনে করা হয়। একইসাথে তিনি একজন ইরানী-কুর্দি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং লেখক।  ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুর্দিস্তানের বানেহে প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঘোবাদি ইরানি সিনেমাগুলোতে এক নতুন মাত্রা বা তরঙ্গ এনে দিয়েছেন বলেই ক্রিটিকরা মনে করেন। ঘোবাদি এমন একটি সীমান্ত শহরে জন্মগ্রহণ করেন যেটিকে নিয়ে ইরান প্রায়শই ইরাকের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তো। শহরটির নাম বানেহ এবং এটি ইরানের ভিতর অবস্থিত একটি কুর্দি শহর যা ইরান নিজেদের বলে সবসময় দাবি করে আসছে। ১৯৮১ সালে ঘোবাদির পুরো পরিবার সানন্দাজে স্থানান্তরিত হয়। তিনি ইরানের ব্রডকাস্টিং কলেজ থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনার উপর ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনি মোট ১০টি শর্টফিল্ম তৈরির পর তিনি ২০০০ সালে তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘এ টাইম ফর ড্রাঙ্কেন হর্সেস’ তৈরি করেন।  আর্ট ফটোগ্রাফির সংক্ষিপ্ত  কর্মজীবনের পর, ঘোবাদি ৮ মিলি মিটারের শর্টফিল্ম তৈরি করা শুরু করেন। তাঁর ডকুমেন্টারি ‘লাইফ ইন ফগ’ অসংখ্য পুরষ্কার জিতে নেয়। আব্বাস কিরোস্তামির ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ ছবিটির সহকারী পরিচালক হিসেবে  বাহমান ঘোবাদি কাজ করেন। ২০০০ সালে তিনি মিজফিল্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ইরানের  বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী সম্পর্কে চলচ্চিত্র উৎপাদনের লক্ষ্যে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছরে অর্থাৎ ২০০০ সালেই তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘এ টাইম ফর ড্রাঙ্কেন হর্সেস’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে বাহমান ঘোবাদি পৃথিবীর  মানচিত্রে প্রথমবারের মতো কুর্দিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করেন ।  আমরা কেমিক্যাল আলীর কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ১৯৮৮ সালে কুর্দি শহর হলাবচেহের উপর ভয়াবহ রাসায়নিক আক্রমণের বিষয়ে আমাদের অধিকাংশই কিছুই জানি না। সেখানে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে মারা যাওয়া মানুষের চেয়ে, হাজার  হাজারের  চেয়েও বেশি মানুষ চোখের পলকে মৃত্যুবরণ করেছিলো। তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘মারুনড ইন ইরাক’এ ঘোবাদির তৈরি করা   চরিত্রগুলি  হালাবচেহের ঘটনায় বলি হওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের জন্য যাত্রা শুরু করেছিল। ইরান-ইরাক সীমান্তের এই প্রাত্যহিক বাস্তবতাগুলির ভয়াবহতার উপর অতিশয়োক্তি মন্তব্য করাকে ঘোবাদি ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করেন এবং তিনি মনে করেন এতে করে তাঁর প্রতিভাকেই আসলে ছোট করে দেখা হবে।  ঘোবাদির পরিচালিত মুভিগুলো যে কারণে সবার চেয়ে কিছুটা আলাদা তা হচ্ছে তিনি ফিল্মের কাহিনী এবং চরিত্রগুলো অর্থাৎ অভিনেতাকে বাস্তবতার অন্তঃস্থল থেকে তুলে আনেন। ঘোবাদি মনে করেন, “ইরানে ফিল্ম তৈরি করা মানেই নানা মিথ্যে দিয়ে ফিল্মটি আগাগোড়া সাজানো। কোন সত্য বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মুভি তৈরি করার কোন সুযোগ বা পারমিশন ইরানে কখনই পাওয়া সম্ভব নয়। ইরানে ভিসা, পাসপোর্ট ও ডকুমেন্ট পেতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এখানে মিউজিককে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা হয়। তরুণ প্রজন্ম যাতে মিউজিক থেকে উদ্ভূত যে শক্তি সেটা দ্বারা একত্রিত ও শক্তিশালী হতে না পারে সেজন্যই কর্তৃপক্ষ মিউজিককে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চায়। মুসলিম দেশগুলো থেকেই কেন সবচেয়ে বেশি মিথ্যাচার বেড়িয়ে আসে আর মধ্যপ্রাচ্য ও এই মুসলিম দেশগুলোতেই কেন সবচেয়ে বেশি সামাজিক  অনাচার, পাপাচার হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে বাহমান ঘোবাদি বলেন, “আপনি  যখন কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন, কোনো কিছু দমন করবেন, মানুষ  তখন অন্য কোন পথ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা চালাবে। কোনো শিশুকে আপনি যদি কয়েকবার কোনো জিনিস ধরতে বারণ করে দেন, দেখবেন, স্রেফ সেই বারণ অমান্য করার জন্যই শিশুটি জিনিসটিকে ধরার অন্য কোনো উপায় বের করে নেবে। জগতের সব ধরনের মিথ্যাচার আর পাপাচারের দেখা আপনি ইরানি সমাজে পাবেন; আর আপনি যদি বিবাহিতা নারীদের ওপর গবেষণা করেন তাহলে দেখবেন, তাদের অনেকেই আপনাকে জানাবে, পাপাচারের নিয়ম ভেঙেই তারা প্রচুর আনন্দ পেয়েছে; কেননা তারা নিয়ম ভেঙেছে স্রেফ সিস্টেমের বিরোধিতা করতেই”।   

তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘এ টাইম ফর ড্রাংকেন হর্সেস’ (২০০০) ইরানে তৈরি  করা প্রথম কুর্দি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ক্যামেরা ডি'অর পুরস্কারটি জিতে নেয়। এ ছবিটিতে আমরা দেখি, একটি ছেলে বাধ্য হয় আর্থিক পরিস্থিতি ও পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী চোরাচালান ব্যবসার সাথে  নিজেকে জড়াতে, যে একই ব্যবসা করতে গিয়ে একদিন তার বাবাও নিহত হয়েছিলো।  এদিকে তার বোন তার চাচা দ্বারা নির্বাচিত একজন পুরুষকে এমন প্রতিশ্রুতি  দিয়ে বিয়ে করে, যেন তার বরের পরিবার তার অন্য একজন ভাইয়ের অপারেশনের জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে। আবার ‘টারটেলস ক্যান  ফ্লাই ছবিটিতে মূল চরিত্র হিসেবে নানাভাবে বিপর্যস্ত অগ্রিনকেই দেখতে পাই। তাঁর দ্বিতীয় ফিচার ফিল্মের নাম ছিল ‘মারুনড ইন ইরাক’(২০০২) যা তাঁকে  শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে গোল্ড প্লাংক পুরষ্কারটি এনে দেয়। ছবিটিতে আমরা দেখি  মির্জার প্রাক্তন স্ত্রী হানরেহকে তার পরিবার এবং তার কাজের মধ্যে যে কোন একটি বিষয়কে নির্বাচন করতে বাধ্য করা হয়েছে। এরপর তিনি ২০০৪ সালে ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটি তিনি তৈরি করেন যা তার সাফল্যের ঝুড়িতে সব মিলে ১২টি পুরষ্কার এনে দিয়েছিলো। এরপর ২০০৬ সালে, ঘোবাদির ‘হাফ মুন’ ছবিটি সান সেবাস্টিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র  উৎসবে গোল্ডেন শেল জিতে নেয়। ইরানের গুলশিফ্তাহ ফারহানি, হাসান পোরশিরাজি এবং হাদীহ তেহরানির মতো বিখ্যাত অভিনেতারা এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ইরানের সংগীতশিল্পী  হোসেন আলিজাদেহ এই চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন। ইরান, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও ইরাকের সহযোগিতায় প্রযোজিত ‘হাফ মুন’ ফিল্মটি ইরানী কুর্দিস্তানেই সম্পূর্ণভাবে শুটিং করা হয়। যাহোক, ছবিটিতে ইরানি কুর্দি সঙ্গীতশিল্পীদের একটি গ্রুপের বিবরণ বর্ণনা করা হয়, যারা ইরাকি কুর্দিস্তানে ভ্রমণ করতে এবং সেখানে একটি কনসার্ট পরিবেশন করতে ইচ্ছুক। ২০০৬ সালে, সেন্সরশীপের সূচী ঘোবাদিকে তাঁর ফিল্ম  ‘টার্টলস ক্যান ফ্লাই’য়ের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান  রাখার  জন্য ইনডেক্স ফিল্ম এওয়ার্ড প্রদান করে।  ২০০৯ সালের মে মাসে, তাঁর চলচ্চিত্র ‘নো ওয়ান নোজস এবাউট পার্সিয়ান ক্যাটস’ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রিমিয়ারে একটি আন সার্টেন রেগার্ড স্পেশাল জুরি এওয়ার্ড জিতে নেয়। এই মুভিটিতে ঘোবাদি নিজেই বাস্তব মিউজিশিয়ান ও ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখানে চরিত্রগুলোর  ভিসা পাওয়ার প্রচেষ্টা এবং নিজ দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ খোঁজার আইডিয়াটির বিস্তার ঘটাতে পুরো সময়টি জুড়ে তাদেরকে ঘোবাদি  ক্যামেরা দিয়ে অনুসরণ করেছেন । চলচ্চিত্রটির কাহিনী মূলত দুজন অল্প বয়সী সঙ্গীতশিল্পী আশকান ও নেগারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে , তারা একটি ব্যান্ড গঠন করে এবং কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই ইরান ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়। এই শিল্পী জুটি নাদের (হামিদ বিনদাদ) নামক একজনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। নাদের ছিলেন একজন গুপ্ত সংগীতপ্রেমী এবং প্রযোজক। যিনি তাদেরকে তেহরান এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভ্রমণ করতে সাহায্য করে যাতে তারা অন্যান্য আন্ডার গ্রাউন্ড সঙ্গীতশিল্পীদের সাথে পরিচিত হতে পারে এবং ইরান ত্যাগ করার পর সকলে মিলে একটি মিউজিক্যাল ব্যান্ড তৈরি করতে পারে। এই চলচ্চিত্রটিতে ইরানী সঙ্গীত শিল্পীদের কঠোর শাস্তিগুলির মুখোমুখি হওয়ার যে ধারাবিবরণী  বর্ণনা করা হয়, সেখানে দেখানো হয় কী উপায়ে আসলে তারা সেন্সরশিপ এড়াতে চায়। 

‘নো ওয়ান নোজস এবাউট পার্সিয়ান ক্যাটস’ মুক্তি পাওয়ার পরেই তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,  “জোরের সঙ্গে  জানাতে চাই, ইরানে আর ফিরতে না পারার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম; আর ফিল্মটি বানানোর ঝুঁকি নিয়েছি সব জেনে-বুঝেই। তবে এ কথাও বলতে চাই, দেশ ছেড়ে চলে আসার উদ্দেশ্যে আমি ফিল্মটি বানাইনি। আমি এবং আর যত মিউজিশিয়ান ও আর্টিস্ট এ মুহূর্তে দেশের বাইরে আছেন, তার নেপথ্য কারণ, তারা নির্বাসনে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের। আমি বাধ্য হয়েছি, কেননা আমি আর মিথ্যাচার করতে চাইনি। আপনি যদি সৎ এবং সত্যবান থাকতে চান, তাহলে সেই (ইরানি) সমাজে ও সেই সিস্টেমে টিকে থাকার কোনো উপায় পাবেন না। আমি জানতাম, দেশত্যাগ না করলে আমাকে বরণ করতে হতো জাফর পানাহির (ইরানি ফিল্মমেকার) ভাগ্য। আমি বলতে চাই, স্রষ্টা সবাইকে স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আমরা সবাই জন্মগতভাবেই স্বাধীন; আর আমরা এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে রয়েছি, যেখানে মানুষকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা নিশ্চয়ই স্বয়ং স্রষ্টাও চান না। মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় তার নিজস্ব নিয়মে। কিন্তু এখন আমরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি অন্য মানুষদের হাতে, যারা কিনা আমাদের তা হতে বাধ্য করছে”।

প্রকৃতপক্ষে ঘোবাদির প্রত্যেকটি সিনেমাই এক একটি অনবদ্য সিনেমা। তবু ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটিই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।  এটি  আমার দেখা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রিয় ছবি।  নাটক বা সিনেমার মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখে কাঁদা আমার পুরনো অভ্যাস। তবে কিছু কিছু সিনেমা আছে  যেগুলো প্রত্যেক দর্শককেই কাঁদায়। বাহমান ঘোবাদির ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই ছবিটি সেরকমই একটি ছবি। ২০০৪ সালে কুর্দি যুদ্ধের সময় ইরাক আর তুর্কি বর্ডারের একটি ছোট্ট গ্রামের  রিফিউজি  ক্যাম্প নিয়ে তৈরি করা ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ফিল্মটি বাহমন ঘোবাদির লেখা ও পরিচালনা করা একটি ড্রামা  ফিল্ম। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর এটি ইরাকের প্রথম ছবি ছিলো। এটি ইরাকের এমনই একটি মোহিত করা চলচ্চিত্র যা শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত শিশুদের নৃশংসভাবে ভেঙ্গে পড়া জীবন  নিয়ে  তৈরি করা হয়েছিলো। ফিল্মটি স্বৈরাচারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের উভয়ের পতনের সাথে সম্পর্কিত একটি ফিল্ম। যুদ্ধ ব্যাপারটা এমনই যা নারী ও শিশুর জীবনকে একেবারে তছনছ করে দেয়। যুদ্ধ মানুষের জীবনকে একেবারেই বিপন্ন, বিপর্যস্ত ও অসহায় করে  তোলে। শান্তিপ্রিয় মানুষ মাত্রই যুদ্ধকে ঘৃণা করতে বাধ্য। কিন্তু পৃথিবীর যে সমস্ত যুদ্ধবাজ মোড়লরা ক্ষমতার দম্ভে শোষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারাই পৃথিবীজুড়ে  কোথাও না কোথাও যুদ্ধের দামামা বাজিয়েই চলেছে। আর এইসব যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় একের পর মর্মস্পর্শী সিনেমা। তেমনই  একটি মর্মবেদনার ছবি এই  ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’।  যুদ্ধের যে কোন ছবি দেখা মানেই আসলে মনকষ্টের  মধ্যে দিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া আর বিশেষ করে ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই ছবিটি যারা দেখেছেন তারাই শুধু জানেন এটি দর্শককে কী নিদারুণ মনঃযন্ত্রণার মধ্যে  ফেলে দেয়। ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে ইরাকি-তুর্কি সীমান্তে কুর্দি শরণার্থী ক্যাম্পে শিশুদের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার ঘটনা। আর বুঝতে পারি যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জীবনকে কিরকম বিপর্যস্ত করে তোলে, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জীবনকে। এটি ইরাক-তুর্কি সীমান্তের এমনই একটি  হতদরিদ্র গ্রাম যেখানে বিদ্যুৎ বা পানি সরবারহের কোন ব্যবস্থা নেই।  এমনই একটি গ্রামের শিশুদের যুদ্ধ পরবর্তী জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ফিল্মটির পটভূমি। তের বছর বয়সী স্যাটেলাইট (সোরান ইব্রাহিম) গ্রামের একটি বাড়ির ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা প্রতিস্থাপন করে। কুর্দির রিফিউজি ক্যাম্পের সাধারণ জনগণ যারা সাদ্দাম হোসেনের খবর জানতে চায় এবং জানতে আগ্রহী কখন আমেরিকা ইরাককে আক্রমণ করবে? তাদের সমস্ত কৌতূহল মেটাতে সক্ষম শুধুমাত্র স্যাটেলাইট। ফলে সে তাদের কাছে একজন  ভীষণ জনপ্রিয় মানুষ। স্থানীয় লোকের কাছে তার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হচ্ছে সে অল্পবিস্তর ইংরেজিও জানতো। স্যাটেলাইট ছিল অত্যন্ত চটপটে প্রগ্রতিশীল এবং বুদ্ধিমান একটি বালক। সে স্থানীয় শিশুদের নিয়ে খুব বিপদজনক কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ মাইনফিল্ডের মাইন অপসারণের কাজ শুরু করে। এই শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই কোন না কোনভাবে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। স্যাটেলাইট স্থানীয় বাজারে অবিস্ফোরিত মাইন বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করে।  সে অন্যান্য বাচ্চাদের উপর নানাভাবে ওস্তাদি করতো এবং  তাদেরকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহারও করতো। যদিও এই বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের সময় ল্যান্ডমাইন ব্লাস্টের ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছিল, তবু তারা প্রতিনিয়ত স্যাটেলাইটকে খুশী করার চেষ্টা  করতো। এবং যখনই সুযোগ পেতো স্যাটেলাইটের নানা কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে পিছুপা হতো না। গ্রামের লোকজন যারা ইংরেজি বুঝতো না অথচ ভীষণ কৌতূহলী ছিল জানার জন্য যে কখন অ্যামেরিকা ইরাকের উপর হামলা করে তাদেরকে উদ্ধার করবে তারাই সবচেয়ে বেশী স্যাটেলাইটের উপর নির্ভর করতো। এদিকে এক পা ওয়ালা সাদ্দাম হোসেন ফেইসাল এবং দুঃখী শির্কো (আজিল জিবারি) এই দুই বন্ধু সবসময় স্যাটেলাইটের সহযোগী হিসেবে তার আসেপাশে ঘুরঘুর করতো। তারাই আবার রিফুইজি বাচ্চাদের কাজ পেতে এবং কাজের মজুরী আদায় করতে সাহায্য করতো। বহুদিন থেকে  একাই রাজত্ব করা রিফিউজি বাচ্চাদের সর্দার  স্যাটেলাইট হঠাৎ একদিন খেয়াল করে যে একটি অপরূপা সুন্দরী কিশোরী মেয়ে অর্গিণ অন্ধ শিশু বাচ্চা রেগা (আব্দুল রহমান কারিম) কে কোলে নিয়ে এবং যুদ্ধে বোম ব্লাস্টে দুহাত হারানো ছোট ভাই হ্যাঙ্গাও (হিরেস ফেইসাল রাহমান) কে নিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে এসে হাজির হয়েছে। স্যাটেলাইট যখন দেখে হাতহীন হ্যাঙ্গাও মুখ দিয়ে পিন বের করে ল্যান্ডমাইনগুলোকে অকার্যকর করে চলেছে তখন সে খুশী না হয়ে বরং হ্যাঙ্গাওকে শুত্রু ভেবে তাঁকে হিংসা করতে থাকে। হাতহীন হ্যাঙ্গাওয়ের আরেকটি গুণ ছিল আর সেটা হচ্ছে সে ভবিষ্যৎবাণী  করতে পারত। হ্যাঙ্গাও স্যাটেলাইটকে সাবধান করে  দিয়ে বলেছিল যে, সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পুরো এলাকাটা বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই বাচ্চাগুলোকে ট্রাকে লোড করে নিয়ে অন্য কোন এলাকায় চলে যায়। যেহেতু সবাই বুঝতে পারছে যে এই সমগ্র এলাকাটা ভীষণ বিপদজনক তাই সে  আবারও মনে করিয়ে দেয় যে কুর্দিরা তাদের কাছে কিছুদিন আগে কেমিক্যাল এটাক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্যাস মাস্ক বিলি করেছে ফলে তার বোঝা উচিত যে এই এলাকাটি খুবই বিপদজনক।  মাস্ক হাতে পেয়ে প্রথমেই স্যাটেলাইট সুন্দরী কিশোরী অগ্রিনকে একটি মাস্ক উপহার দেয় এবং প্রমিস করে তার অন্ধ বাচ্চার জন্যও একটি গ্যাস মাস্ক  জোগাড় করে আনবে। এরমাঝে একদিন দেখা যায় যে অ্যামেরিকান হেলিকপ্টার রিফিউজি ক্যাম্পের উপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে এবং তারা হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ফেলছে যেটিতে লেখা আছে “আমরা তোমাদের সব সমস্যার সমাধান করে তোমাদের দেশকে প্যারাডাইস বা স্বর্গে পরিণত করবো । আমরা পৃথিবীর সেরা জাতি। অ্যামেরিকান সৈন্যদের এসব কথা কিশোর স্যাটেলাইট ও তার সাগরেদের কাছে সত্যি বলে মনে হতে থাকে।  ছবিটির মূল চরিত্র ১৩ বছর বয়সের শিশুকন্যা অগ্রিন, সে যুদ্ধের সময় যখন তার বয়স ছিল ১০ বছর, ইরাকী মিলিটারি দ্বারা  তার চোখের সামনে বাবা-মাকে হত্যা হতে দেখে এবং সে  নিজেও গণধর্ষিতা  হয়। সেই গণধর্ষণের ফলেই অন্ধ শিশু রিগার জন্ম হয়। অগ্রিন রিগাকে তার  ছোটভাই হিসেবে সাবার কাছে পরিচয় দেয়  কিন্তু মনে মনে সবসময় সত্য ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকে। সে মনে করে তার সব দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী রিগা। আর গ্রামবাসী যদি রিগার জন্মবৃত্তান্ত ও আসল পরিচয় জেনে যায় তাহলে তাকে তারা ভীষণ ঘৃণা করবে এবং সবকিছুর জন্য তাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে। ফলে সে রিগাকে মনে মনে খুব অপছন্দ করতো এবং নানাভাবে চেষ্টা করতো রিগার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। এদিকে হ্যাঙ্গাও বোনের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে সবসময়  রিগাকে পাহারা দিতে থাকে এবং  বোন যেন কোন অঘটন ঘটাতে না পারে সেদিকেও নজর রাখে। তাই বোনকেও  চোখের আড়াল হতে  দেয় না। কিন্তু যেহেতু তার নিজের দুটি হাত নেই ফলে সে সবসময় তাঁর বোন ও বোনের ছেলেকে সাহায্য করতে পারে না বলে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। এদিকে অগ্রিন অন্ধ শিশু রিগাকে কী করে তার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলবে সারাক্ষণ সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। এভাবে  বহুবার চেস্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরও সে হাল ছাড়ে না। আর তাই একদিন সুযোগ বুঝে সে রিগাকে তুর্কীর বর্ডারের একদম কাছে যেখানে অসংখ্য মাইন পোঁতা আছে সেখানে ফেলে আসে। সে ভেবেছিল মাইন ব্লাস্ট হয়ে রিগা মারা যাবে আর তার রিগাকে নিয়ে ভোগ করা সমস্ত যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এ যাত্রায়  রিগা বেঁচে যায় এবং একজন তুর্কী গার্ড তাকে উদ্ধার করে স্যাটেলাইটের কাছে হস্তান্তর করে।  স্যাটেলাইট রিগাকে অগ্রিনের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এবং নানাভাবে তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। এমনি করে একদিন দেখা যায় যে সে অগ্রিনকে তার প্রতি আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করার জন্য একটি  গভীর পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে লাল মাছ ধরে এনে তাকে উপহার দিতে চায় কিন্তু দুঃখী ও নিরাশ  অগ্রিন স্যাটেলাইটের আসার আগেই দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। সে কিছুতেই তার চোখের সামনে তার বাবা-মার হত্যা হতে দেখা এবং ইরাকী সৈন্য দ্বারা গণভাবে ধর্ষিত হওয়ার কথা ভুলতে পারে না। ১৩ বছর বয়সী যুদ্ধবিদ্ধস্ত অগ্রিনের মধ্যে আমরা একটি  আশাহত দরিদ্র ও অসহায় হতবিহ্বল    কিশোরীকে দেখতে পাই যা আমাদেরকে শিশুদের অসহায়ত্ব নিয়ে ভাবিত করে।   অগ্রিন নানা উপায়ে রিগাকে তার জীবন থেকে সরাতে না পেরে শেষপর্যন্ত তাকে একটি বড় পাথরের সাথে বেঁধে লেকের গভীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং নিজে  পাহাড়ের উঁচু চূড়া থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।  এদিকে হ্যাঙ্গাও স্বপ্নে তার প্রিয় মানুষকে ডুবে যেতে দেখে ঘুম থেকে চমকে ওঠে।  তৎক্ষণাৎ সে তাঁবু থেকে বেরিয়ে অগ্রিন ও রিগাকে খুঁজতে থাকে। হ্যাঙ্গাও রিগার বিপদ বুঝতে পেরে  লেকের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং রিগাকে  পাথরের সাথে বাঁধা অবস্থায় জলের নিচে খুঁজে পায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার দুটি হাত না থাকায় অনেক চেষ্টা করেও  পাথরের সাথে শক্ত করে বাঁধা রিগার বাঁধন আলগা করতে পারে না এবং তাকে বাঁচাতেও পারে না। এরপর সে অগ্রিনকে খুঁজতে খুঁজতে পাহাড়ের চূড়ার কাছে এসে দেখে অগ্রিন সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। এসব ঘটনার  মধ্যেই দেখা যায় অ্যামেরিকার সৈন্যরা গ্রামে ঢুকে গেছে। অথচ এতদিন থেকে প্রতীক্ষারত হতবিহ্বল স্যাটেলাইট এতসব ঘটনা চোখের সামনে দেখার পর  জীবনের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে বসে।  

এই হচ্ছে মূলত বাহমান ঘোবাদির পরিচালিত বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০০৫এর পিস ফিল্ম এওয়ার্ড সহ ১টি এওয়ার্ড পাওয়া ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটির মূল কাহিনী।  বাহমান ঘোবাদি 'টারটেলস ক্যান ফ্লাই' ছবিটিতে পানির নীচের একটি সংক্ষিপ্ত পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে একটি কচ্ছপ তার নিজের পরিসীমায় ধীরে ধীরে হেঁটে যায় এবং এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ অনায়াসেই তার ভয়ানক ওজনের খোলসকেও বহন করতে পারে। তিনি কুর্দিদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কীভাবে অভিবাসন ও গণহত্যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপর ক্যারাটিনের বর্মের  মত জড়িয়ে থাকে।  কিন্তু কচ্ছপের মতো তারাও কীভাবে এই বোঝার দায়  থেকে নিজেদেরকে উত্তরণ করেছিলো।  ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ কোন রাজনৈতিক ছবি নয়, আবার এটি কোন কিশোর-কিশোরীর মধ্যেকার প্রেমের ছবিও নয়।  বরং এটি হ্যালাবচেহ গ্রামে বেঁচে  থাকা ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিছু শিশু-কিশোরের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে তৈরি একটি মর্মস্পর্শী ছবি। এটি একটি অত্যাচারের ও স্বৈরশাসনের গল্প যেখানে রাষ্ট্র নিজেই তার পৃষ্ঠপোষকদের উপর নিপীড়ন চালায়। এবং কুর্দিস্তানের উদ্বাস্তুরা এক নিদারুণ অসহায়ত্বের মুখে পড়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করে। এসব বিষয়ই তখন ঘোবদির চলচ্চিত্রগুলির অতি সাবধানে তৈরি করা প্লটগুলোতে আরও নিষ্ঠুর শক্তির আবির্ভাব হতে সাহায্য করে যা মূলত একসময় তার ফিল্মগুলোর অনুপ্রেরণারই বিষয় হয়ে ওঠে।  বাহমান ঘোবাদির মুভি দেখা মানেই জীবনের নিদারুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করা তার একেকটি ছবি দেখা মানেই একটি নতুন মাত্রার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার অনুভূতি। মুভি দেখার ভক্ত দর্শকদের নিঃসন্দেহে তাঁর পরিচালনা করা প্রত্যেকটি ফিল্মই যে ভালো লাগবে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।