সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

অচিন্ত্য দাস



কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৫



জংশনস্টেশন


মহা ঝামেলায় পড়ে গেছি। যে চাকরিটা করছিলাম সেটা খারাপ ছিলো না, কিন্তু  এরা আপিস উঠিয়ে জয়পুর নিয়ে যাচ্ছে। বলেছে যারা যেতে চাও তারা লিখে জানাও। তার মানে বাকিরা গেল। এই অবস্থায় কী করব? বউ একটা ইস্কুলের লাইব্রেরিতে কাজ করে। ছেলেমেয়ের মোটে ক্লাস সেভেন আর নাইন। মরিয়া হয়ে নানা জায়গায় দরখাস্ত করেছি, দু-একটা জবাবও এসেছে। কাজ কিন্তু কলকাতার বাইরে।

শনিবার ছুটি থাকে, টলিগঞ্জের দিকে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল আর্যদার সঙ্গে দেখা করে যাই।

আর্যদা কলেজে দু’বছর উঁচুতে পড়ত। ক্যান্টিনে বসে মাঝেমাঝেই ভীষ্ম পিতামহের  মত প্রতিজ্ঞা করত যে জীবনে কখনো চাকরি বা বিয়ে করবে না। ক্লাসেফ্লাসে খুব একটা যেত বলে মনে হত না, তবে সুযোগ পেলেই আমাদের হয় সাহিত্য নয় আর্ট  নয় ফিলোজফি নিয়ে ওর বিচিত্র সব ধারণার কথা বলত। তবে হ্যাঁ, আর্যদা কথা রেখেছে, না বিয়ে না চাকরি। একটা চায়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে এখন একটা মাঝারি ধরনের খাওয়ার ঠেক করেছে। ভালো চলে।

দোকানে বসেছিল – আমাকে দেখেই বলল, “কী রে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। ঝগড়া? বউ না বস?”
কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বুঝিয়ে বললাম। আর্যদা শুনল, কিন্তু তেমন পাত্তা দিলো না। মনোযোগ টানতে বললাম, “জানো আর্যদা, সেদিন রাতে বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। তুমি তো অনেক কিছু জানো, মানেটা বলে দাও দেখি!”
এতক্ষণে আর্যদা যেন নড়েচড়ে বসল। -“বল!”
-“স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা বিরাট জংশন স্টেশনে দাঁড়িয়ে। আমাকে কোথায় যেন যেতেই হবে। কিন্তু বড় বড় বোর্ডের  ডিজিটাল লেখাগুলো অজানা অক্ষরে। পড়তে পারছি না।  ঘোষণাও শোনা যাচ্ছে, কিন্তু তাও অজানা ভাষায়। জিজ্ঞেস করার মতো  কেউ নেই, সবাই ছুটছে, কারুর সময় নেই। কোন প্ল্যাটফর্মে আমার গাড়ি ছাড়বে? ক’টার সময়? এত বড় স্টেশনে কী করে তা খুঁজে পাব! হয়রান হয়ে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে গেল…”
আর্যদা বলল, “এ তো স্বপ্ন নয় বৎস, তুই সত্যিই এখন সেই জংশন স্টেশনে…  এই স্টেশনে সবাইকেই কখনো কখনো দাঁড়াতে হয় রে। তখন মনে হয় সবই তো নিয়মমতো চলছে, কিন্তু আমার ট্রেন কোথায় কে বলে দেবে!”
উফ্, আর্যদার সেই বিজ্ঞবিজ্ঞ ভাবটা এখনো যায়নি। এত যদি জানে তো কী করতে হবে বলুক!
মনের কথা পড়ে নিয়েই যেন আর্যদা বলল, “যে কোনো একটা ট্রেনে উঠে পড়, তবে যেটাতেই চড়িস, সাহস করে চড়বি।”
গা জ্বলে গেলো। এরকম অবস্থায় তো পড়েনি! বললাম, “তুমিও সে স্টেশনে এসেছ কখনো?”
একটু হেসে আর্যদা বলল, “সে স্টেশনেই তো বসে আছি রে। আমার কোনো ট্রেন ধরার তাড়া নেই। বসে বসে চা বিক্রি করি আর দেখে যাই… কত লোক আসছে, থমকে দাঁড়াচ্ছে তারপর কতদিকে চলে যাচ্ছে… এই হল মানবজন্ম, বুঝলি… কফি খাবি?… আরে খেয়ে যা… কী এমন রাজকার্য আছে তোর…”




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন