সমকালীন ছোটগল্প |
সেই – সেইই
একদিন সে একটি জনপদ আবিষ্কার করল। কাঁচা পাকা পথের ওপরে খেলনার মতো
বসে আছে তন্দ্রাচ্ছন্ন একটি লোকালয়। একটি জঙ্গলা আগাছায় আচ্ছন্ন পথরেখার বাঁক। তারপরে নদী বাঁধ, নদী বাঁধের পার হয়ে গেলে একটি ধানকল – ধানকলের ওপাশে বন্যায় ভেসে আসা নানারকম
টুকিটাকির শুকনো সমাবেশ, যেমন-গরুর গাড়ির কাঠের চাকা, মাটির নানারকম ভাঙ্গাপাত্র,
বিস্তর খড় ও দরমার বিমূর্ত খণ্ড ও দলা, মৃত মানুষের ও পশুর কঙ্কাল, পাখির ডানা,
দোকানের সাইনবোর্ড, কয়েকটি খাল ও নদীর ভেসে আসা দাগ, সঙ্গীতের যন্ত্রপাতি, গানের
কলের ক্যাসেট ও সিডি, বেশ কিছু মনিহারি এবং জলের তোড়ে ভেসে আসা বেশ কিছু
গ্রামগঞ্জের একাকীত্ব ও বিষণ্ণতা।
কয়েকটি চালাঘর ও দালান প্রথমে তাকে প্রত্যক্ষ করল। মাঠের কাজে ব্যস্ত কৃষক, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, গ্রামসভার
কাছারিখানার মাতব্বর এবং সরকারি হাসপাতালের কর্মচারি, অঞ্চলের দোকানদার সবাই তাকে
প্রত্যক্ষ করল। কয়েকজন মানুষ, কেউ সাদা ধবধবে ফতুয়া পড়ে, কেউ আদুল গায়ে কাঁধে
গামছা ফেলে, কাদামাটি পায়ে মাঠকর্মী, বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই সবাই একসাথে একটি
চায়ের দোকানে। পরস্পর তারা কথা বলছিল। সে ওদের সামনে দাঁড়াল।
হ্যাঁ, মাস্টারমশাই গতবার ফকির খালের ওইদিকে পরিযায়ী পাখি
বেশ পালক ফেলে গেছিল। সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে গণেশ হাতপখা বানাল। বসে থেকে গড়িয়ে
কুড়িয়ে রোজগার করে নিল।
তা হলে বল পালকেরও বিপণন হয়। পাগল কোথাকার, কি করবে আর, এত
বড় ঘরের ছেলে, সব হারিয়ে এখন পথের ভিখারি। নুঞ্চে ওদের ঠকিয়ে সর্বস্বান্ত করে দিল।
তা না হলে, সারাদিন পাখুয়াদের তাড়িয়ে দিয়ে পাখিদের উড়িয়ে দেয়?
দেখছিস না তোরা ঈদগার ওইদিকে বাগানে এখন কত কাঠবেড়ালি,
কয়েকটা না কি সজারুও আছে। এখন নেউল ও পরিযায়ী জলডুব হাঁসের আস্তানা।
বন্যার পরে না কি কয়েকদিন পরে আবার সামুদ্রিক ঝড় আসে, তেমন
ঘোষণা আছে।
তাহলে?
আবার।
না, তেমন কিছু ভয়ের নেই।
এই নূপুর আজকে চায়ের দুধে জল মিশিয়েছিস কেন রে?
দুধ খুব ঘন ছেল। তাই।
চা পানসে লাগছে।
কতবার তোকে আর তোর মাকে বলেছি মাস্টারমশাইয়ের ঘন দুধের চা
না হলে চলে না।
একটি ছায়া চায়ের দোকানের বেঞ্চির কাছে। চায়ের গ্লাসে মুখ
ভেসে উঠল খসড়া একটি রেখার। ক্রমশ সোজা
কাছে সরে এসে মাস্টারমশাইয়ের বেঞ্চের যেখানে বসে আছেন সেই পাশটাতে। সবাই দেখল
তাকে, একজন বলল,
মাস্টারমশাই উনি বোধহয় আপনার খোঁজ করছেন?
আমার?
হ্যাঁ তাকিয়ে দেখুন, এই হরেন এদিকে সরে আয়। ওনাকে একটু বসতে
দে।
আপনি? গ্রামের কোন বাড়িতে যাবেন আপনি?
বেঞ্চের এক কোণে, কোনো রকমে দেহ ঠেসান দিয়ে, সম্পূর্ণ চায়ের
দোকানটির দিকে তাকিয়ে দেখল, পোড়া দরমা রঙয়ের বিন্যাস চুইয়ে চুইয়ে নেমে আসছে পা
মোছার চটের বস্তার কাছে। চটের বস্তার কাছে একটি দানবীয় জোঁকের পিঠে কাঁচা নুন ফেলে
দেওয়া হয়েছে। রক্ত নেমে গড়াচ্ছে। তার ওপরে মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। এক সস্পেন দুধের
ওপরে খড় ভাসছে, ডেঁয়ো পিঁপড়ে। দেখে মনে হচ্ছে কাঁচা দুধ।
সে ঢোক গিলল, পরের পর, কণ্ঠনালী দিয়ে থুতু নেমে গেল
শতবর্ষের ক্ষুধার যন্ত্রণাকে বিক্ষত করে। দুধের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে দিনের
আলোর মধ্যে দেখল কাঠ তক্তা ভাঙ্গা একটি জাহাজকে গিলে ফেলছে ক্ষুধার্ত দানব তিমি।
ক্ষুধা হাঁটে, ঘরে বসে, গাছের নিচে ঘুমোয়, ক্ষুধা হাসে ক্ষুধা কান্না করে। ক্ষুধা
ক্ষুধার মতো গল্প করে।
চায়ের দোকানের কাঠের তাকে, কাঁচের বয়ামে সারি সারি বিস্কুট।
সে কিছুক্ষণ বিস্কুটগুলির দিকে তাকিয়ে থাকল নিস্পলক। কেউ কেউ তাকে অবাক হয়ে দেখছে।
কারণ, এই গ্রামে অপরিচিত কেউ তেমন আসে না। আসলেও গ্রামের কোনো পরিবার ও বাড়ির
সঙ্গে একটি না একটি যোগসূত্র থাকে। তাই এক গ্রামবাসী তাকে প্রশ্ন করেছিল, -“কোন
বাড়িতে যাবেন”?
না। কারও বাড়িতে যাব না।
তাহলে কোন গ্রামে যাবেন আপনি? এখান থেকে সোজা পথ ধরে নিলে,
আপনি যাবেন সব থেকে কাছের গ্রাম জলসিঁড়ি তারপরে টুপাই। টুপাই অতিক্রম করে গেলে
পাবেন বহুদূরগামী হাইরোড। বাঁয়ে গেলে লখিনপুর। লখিনপুর পার হলে রুমকিনি নদী। মালোপাড়া। তারপরে সাগরের মতো বিশাল মোহনা। ডাইনে
গেলে পাবেন আমাদের গ্রামের খাস মাতব্বর জগদীশ হালদারের বিদ্যালয়। আপনি কোথায় যাবেন?
সে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থাকল গ্রামবাসীর দিকে। যেন কিছুই
তার বলার নেই।
চতুর মাস্টারমশাই বুঝতে পারল। ক্ষুধার জ্বালায় আক্রান্ত হয়ে
ভাগ্যহত ব্যক্তি। চায়ের দোকানি নূপুরকে বলল,- একটা বড় টিফিন কেক দে তো ওনার হাতে।
এই কথা শুনে সে কেমন জানি হয়ে গেল। তারপরে আস্তে আস্তে
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতে থাকল উদ্দেশ্যহীন। হাঁটতে থাকল একেবারে মাথা নিচু করে।
নিজের মনে নিজেই কি যেন বিড়বিড় করতে থাকল। অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পরে সে বুঝতে
পারল, গ্রামবাসীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
একজন গ্রামবাসী সে গ্রামের মাতব্বরদের ফড়ে। মাস্টারমশাই
তাকে বলল,-- অনুসরণ করতে। সে অনুসরণ করতে করতে অনেকটা দূর এগিয়ে গেল। তারপরে পায়ে
পা চালিয়ে তার পাশে এসে তাকে সন্দেহজনক চোখে দেখতে থাকল।
আপনি আগে কোথায় থাকতেন?
ক্ষুধা কথা বলে না।
কিছু বললেন আপনি?
না তো।
কি যেন বললেন?
একটি অতি সাধারণ গ্রাম আমাদের। এখানে সবার বসবাসের জন্য
ঘরবাড়ি। কারও আশ্রয়ের জন্য তেমন কোঠা বা বাড়ি আপনি কোথায় পাবেন? সবাই চাষকর্ম
করেন। মাঠের কাজের সাথে সবাই যুক্ত।
আমি কি আপনাদের গ্রামে আশ্রয় চাইলাম?
না। তা চান নি।
এই নির্জন পথ, আশেপাশের জলাশয়, গাছ গাছালি আমাদের উপস্থিতি
অনুমোদন করছে না। আমরা আমাদের পথ বেছে নিই।
আপনাকে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।
প্রতিটি ক্ষুধার্ত মানুষকে তাই মনে হয়। সন্দেহজনক।
আপনি কি ক্ষুধার্ত?
ক্ষুধা কোনো প্রশ্নকে অনুমোদন করে না। কারণ ক্ষুধা প্রশ্ন
করতে জানে না। তাই তার কাছে উত্তর নেই। বোধহয় আপনাদের গ্রামের সীমানা অতিক্রম
করছি। তাই আমি ও আমার ছায়া অন্য কারও উপস্থিতি চাইছে না। ক্ষুধা বড়ই নিঃসঙ্গ। আর
প্রতিটি মানুষের ক্ষুধা হল তার যন্ত্রণাময় উৎসব। আমরা সবাই ক্ষুধাকে উদযাপন করতে
জানি না।
অনুসরণকারী গ্রামবাসী নিজেই তার হাঁটার গতি থামিয়ে দিল।
কারণ সন্দেহজনক লোকটি যা বলছে তা থেকে এটাই স্পষ্ট লোকটি হয় উন্মাদ না হলে
অপ্রকৃতিস্থ।
অনেকটা হেঁটে আসার পরে সে বুঝতে পারল দিনের আলোর মতো একাকী
এই বিশ্বসংসারে আর কিছুই নেই। গ্রামবাসী কি যেন নাম বলে গেল গ্রামের? পিছনে ফিরে
তাকাল, বহুদূরের আলোর মতো টিম টিম করছিল কয়েকটি বাড়ি, পাকা ও মাটির বাড়ি। সে এক
অন্য গ্রামসীমানা। এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল, একটি সুপ্রাচীন বহু শাখা প্রশাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে বটগাছ। কেমন রহস্যময় অন্ধকার দলা পাকিয়ে আছে।
সে ক্ষুধার জ্বালায় অন্ধকারকে গিলে ফেলতে চাইল। বাতাসের গতি প্রবল। একটু একটু করে হাঁ করে অন্ধকারের শূন্যতা গিলে ফেলে, সে একটি মরা বিকেলের আলোতে পড়ে
থাকা পুকুরের দিকে তাকিয়ে পুকুরের জল গিলে ফেলল। সেই জলের কুচো পানা একপ্রকার
উদ্ভিদের গন্ধ এনেছে।
বট গাছের নিচে অন্ধকার অতিক্রম করে, সে এগিয়ে যেতে থাকল
আবার একটি কল্পনার মাটির পথের দাগ ধরে। অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পরে সে একটি পরিত্যক্ত
কাঠের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাড়িটির কাঠের দেওয়ালগুলি ভেঙ্গে গেছে, বেশ কিছু জায়গায় ফাঁকা দেওয়াল আর ফোঁকর।
পাশাপাশি দরজার একটি কপাট আছে তো আরেকটি নেই, আরেকটি দরজার কপাটের কব্জা খুলে হেলে
গেছে সামনের দিকে।
সে পা চেপে চেপে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। কয়েকটি ধূসর রঙয়ের
পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল ঘরের ভিতর থেকে। ঘরের ভিতরে কাঠের সিঁড়ি, উঠে গেছে ছাদ
বরাবর আরেকটি কোঠার দিকে। সে প্রথমে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে গিয়ে, সঙ্কোচ বোধ করছিল।
সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার আগে, কয়েকবার কাঠের পাটাতন পা টিপে টিপে
দেখে নেওয়ার পরে সাহস পেল। আস্তে আস্তে সে উঠে গেল, ওপরের ঘরে। ঘরের ভিতরে বহু পুরনো
খাদ্যবস্তুর গন্ধ পেল যেন। দেওয়ালের গায়ে কিছু ভাঙ্গা কাঁচের বয়াম। আর থেবড়ে
যাওয়া, চায়ের কেটলি। কেটলি এবং বাকি রন্ধনের সরঞ্জামের পাশে একটি কাঠের টেবিল।
টেবিলের ওপরে একটি সাদা রঙয়ের প্লেট। প্লেটের ওপরে কয়েকটি
মাকড়শা এবং শুকনো কয়েকটি মাংসের হাড়। হাড়ের পাশে কাঁচের জগে জল।
সে ক্রমাগত ঢোঁক গিলতে থাকল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন