সমকালীন ছোটগল্প |
ডেমেন্টোফোবিয়া
বৃষ্টি
তো নয়, যেন হাজার ছুঁচ পড়ছে গায়ে। শিরশির শব্দে সেই পুরনো স্মৃতি ঘুরে আসতে চাইছে বারবার। এই বুড়ো অশত্থ গাছটা শহরের চৌরাস্তার ধারে। ব্যস্ত ট্রাফিক।
অবিরাম গাড়ির স্রোত। তবু পার হয়ে যেতে কেমন
গা ছমছম। আর যতবার সেখানে দিয়ে পার হই, কবে দেখা পুরনো স্বপ্নটা দুম করে মাথা কামড়ে ধরে। ওই স্বপ্নটা শুধু একবার নয়, তিন তিনবার দেখেছি। সেটাও আবার একটা রহস্য। অনেকে বলে, একই স্বপ্ন তিনবার দেখলে নাকি সেটা ফলে যায়। কথাটা বলেওছি আমি অনেককে। দু’চারজন
বলেছে, শনি ধরছে তোকে। কালো গরুর ছায়া মাড়িয়ে যাবি। দোষ কেটে যাবে। আবার
একজন বলেছে, আমার নাকি প্রাপ্তিযোগ আছে। কিন্তু স্বপ্নটা এমন যে ওসব কোনোটাতেই ঠিক যুত্সই ম্যাচ
করে না।
দূর
থেকে দেখি ট্রাফিক জ্যাম। এই মোড়ে কোনো সিগন্যাল
নেই। আর একটা পুলিশও নেই। অজান্তেই একটা বড়সড় স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক ভীড়ের মাঝ দিয়ে স্যাট করে পার হয়ে যাবো। নো টেনশন। মনে মনে সংকল্প, ফালতু এত টেনশন ভালো নয়, একটু
দেরি হয় হোক,এই রাস্তা দিয়ে আর আসবো না। পাঁচজনের
একটা পথচারী পল্টন ফ্যামিলির মাঝে ঢুকে গিয়ে হাঁটতে লাগলাম। মনে বেশ সাহস এলো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এখন
গা সওয়া। একটু গুনগুন করে গান গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গাইতে গাইতে পাশের মানুষদের দিকে তাকালাম। পলকহীন চোখে ওরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওদের সবার রেনকোট। আমিই
উদোম ভিজছি। দেখলাম পাঁচজনই মেয়ে। প্রত্যেকে ঝকঝকে দাঁত খুলে হাসছে। ওরা
একই রকম দেখতে লাগছে কি? হ্যাঁ
তো! বিলকুল এক দেখতে। সবকিছু বেমালুম ভুলে হাঁ করে তাকিয়েই রইলাম। ভুলেই গেলাম তড়বড়ে বৃষ্টির ঠোনা খেতে খেতে গাছটার ঠিক মাঝে
সেই মোটা ডালের কাছাকাছি চলে এসেছি। চেতন
ফিরতেই দেখি কোথায় ট্রাফিকের ভীড়? ওই
মেয়েগুলো বাদে কেউ কোত্থাও নেই। বৃষ্টির ধারাতে সব আবছা, কেবল আমি ও ওই মেয়েগুলো। সব ফাঁকা অনুভব হতেই স্যাত্
করে পিছলে সেই স্বপ্নটা মাথায় চলে এলো।
ছায়া
মেয়েটি তখনো মারা যায়নি। স্পষ্ট দেখছি শুয়ে রয়েছে
মৃত্যুশয্যায়। বড়বড় শ্বাস টানছে। সো সো শব্দ। ঘোমটা টেনে খাটের বাজু ধরে মহিলাদের ভীড়। ওরা সবাই একই রকমের শাড়ি পরা কেন? লাল পাড় সাদা শাড়ি? সবাই এক দেখতে কেন? ওদের
পুরনো কেল্লার মতো বাড়ির ছাদ থেকে নিচে উঁকি মেরে দেখি দুর্গাবাড়ির চত্বরে খুব ভিড়। আমি অবাক! ছায়াদের বাড়ি থেকে দুর্গাবাড়ি প্রায় পাঁচ মাইল দূর। কিন্তু স্বপ্নে কোনো যুক্তি চলে না। ভিড়ের মাঝ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো নাককাটি বুড়ি ।সাদা থান পরা লম্বা
ঢ্যাঙা ধবধবে ফর্সা। আমি পরিষ্কার বুঝলাম ও বলছে, ‘ছায়া আর কি বাঁচবে বাছা? ওর
ফোপোস(ফুসফুস) ওই বুড়ো অশত্থ গাছের মগডালে পাতা দিয়ে মুড়ে রেখেছি পরে খাবো বলে। যদি
পিপড়ে না ধরে থাকে তো পেড়ে আন। তাইলে
ও যদি বাঁচে ত বাঁচে’। খুব
কাছ থেকে অশত্থ গাছটা দেখলাম। স্বপ্নেই
উড়ে উড়ে গাছের মগডালে চেপে দেখি, পাতায়
মোড়া কিছু রাখা আছে ঠিক মাঝের মোটা ডালের ওপর। দলে দলে পিপড়ের সারি এঁকেবেঁকে গাছের উপর উঠছে। নিচে দাঁড়িয়ে ভিড়ের ক্রন্দন। সবাই
দু’হাত তুলে রয়েছে।
এই
অব্দি স্বপ্ন। হুবহু এমনটি তিন তিনবার দেখার পর যখনই এই
বুড়ো অশত্থ গাছের তলায় আসি ওমনি গা শিরশির করে স্বপ্নটা হুবহু মনে পড়ে যায়। যেমন
এখন। ভিজতে ভিজতে কাঁপতে কাঁপতে উপরে তাকিয়ে
দেখছি আমার মাথার ওপর অশত্থ গাছটার মোটা ডালটা যেন আমার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। সেখান থেকে লাল জল আমার মাথায় পড়ছে টপ টপ টপ। আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওই পাঁচজন নারী। ওমা!
ওরা কালো রেনকোটের হুড খুলে উপরে তাকিয়ে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে। ওরা সেই স্বপ্নে দেখা ছায়া মেয়েটির বয়েসী।
সবকটিই ওর মতই দেখতে। ওরা আমাকে ঠেলছে। ওই জলের ফোঁটা ওরা মুখের উপরে নিতে চায়? জিভ বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। আমি সরে দাঁড়াই। মুখ নিচু করে দেখি বুড়ো
অশত্থ গাছের গোড়া থেকে চওড়া ফিতের
মত বড় বিষ পিপড়ের সারি উঠছে উপরে। আমি আমার বশে নেই এখন, এমনই অবাধ্য হয়ে সেখান থেকে দৌড়ে এগিয়ে যাই গাছের গোড়ায়। শহরের মাঝে এই গাছ।
প্রশাসন কাটতে পারেনি, কিন্তু নানা ব্যারিকেড
দিয়ে ফুটপাথ থেকে দূরে রেখেছে। গাছের
নিচে বেদি। গোড়ায় সিঁদুর লেপা। অদম্য ইচ্ছের বশে গাছটার কাছে পৌছে ওপরে চড়ার জন্যে উপায় দেখতে পিছনে গিয়েই
দেখি, গাছের গোড়ায় গভীর গর্ত। এতো বড় ফাটল নিয়ে এই ভারী গাছটা দাঁড়িয়ে আছে কি করে? ফুটপাথ থেকে দূরে রেখেছে। গাছের নিচে বেদি। গোড়ায় সিঁদুর লেপা। অদম্য ইচ্ছের বশে গাছটার কাছে পৌছে ওপরে চড়ার জন্যে উপায়
দেখতে পিছনে ঘুরে গিয়ে দেখি, গাছের
গোড়ায় মস্ত গভীর গর্ত। গাছটা পুরোটাই খোকলা। ফাটল থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে লাল কাঠপিপড়ের সারি।
(২)
সত্যি
বলতে কি, আমি যখন ক্লাস প্রমোশনে ফোরে
উঠি, তখন সেই ক্লাসে থেকে যাওয়া দু’বছরের পুরনো একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। মাগারাম মাহাতো।
পিরিয়ডের ফাঁকে পিছনের বেঞ্চে কয়েকজন ওকে ঘিরে বসতো গল্প শোনার জন্যে। সেই সুত্রে নাককাটি ডাইনি বুড়ির সাথে কাল্পনিক পরিচয়। আমাদের
গ্রাম জঙ্গল ঘেরা। মাগারামের এক কমবয়েসী বিধবা মাসি একদিন
নিশুতি রাতে জঙ্গলে ডাইনিবিদ্যা শিখতে গিয়ে ধরা পড়ে। তখন গাঁয়ের সবাই ওর নাক কেটে ঘর থেকে বার করে দেয়। তাই ওর নাম ছিল নাককাটি।
মাগারামের বর্ণনায় বিদেশী মেমদের মত ফর্সা নাককাটি বুড়িকে আমি কখনো দেখিনি। চোখ ছিল নাকি ঢুলুঢুলু। এর ওর দুয়ার থেকে তাড়ানি খেয়ে শাপ শাপান্ত খেয়ে প্রায় না খেতে পেয়েই দিন
কাটতো। কিন্তু চেহারার লাবণ্য দিন দিন যেন ঠিকরে
পড়ত। খুব সুন্দর মুখ কিন্তু বীভত্স নাকের ফোকর
দেখে অনেকেরই ত্রাস হতো। মাগারাম খাতার পাতায় কখনো
স্লেট পেন্সিল দিয়ে নাককাটি মাসির গমন পথ আঁকতো আর ফিসফিস করে তার কর্ম বিবরণের
ব্যাখ্যান করতো। খাতার পাতায় পেন্সিল যেমন যেমন এগোতো, নাককাটি বুড়ি ছমক ছমক হাঁটতো আর আমাদের গা শিরশির করে উঠত।
একদিন
কি কারণে হাফ স্কুল হতে আমার পিছনের বেঞ্চের সাথীদের সাথে ঘরে ফিরছিলাম। স্কুলের পথে একটা সমকোণী মোড় পড়ে। সেখান থেকে শুরু শাল পলাশের জঙ্গল। মোড়ের ঢালু জমি প্রচুর কাশফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেই চকচকে সাদা পটভূমিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ন কালো কঙ্কালসার একটি মেয়ে। মাগারামের দিদি। আগেও ওকে দেখেছি। বাজার হাটে ঘুরে বেড়াত। গায়ে একরত্তি মাংস নেই। হনুর কোটরে চোখজোড়া চকচক করতো। বুকের আঁচল আধখোলা। পাঁজরগুলোর উপরে শুধু
চামড়া ঝুলে থাকতো। চুপচাপ। কথা বলতো না। আমরা যেমন যেমন ওর কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কাশফুলের রূপোলী আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। ওকে একটা শীর্ণ কালো মরা গাছের ডালের মত মনে হচ্ছিল। কিন্তু
আমরা যেই কাছে গেছি অমনি সে টুপ করে কাশের ঝাড়ে ডুবে গেল। আমরা দৌড়ে সেখানে গেলাম, তন্ন
তন্ন করে খুঁজলাম। নেই।
মাগারাম অস্ফুট গলায় দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল, ‘দিদির মাস আঁত চামড়া সব তো চুষে নিলে মাসি, ইবারে তুমাকে কে বাঁচায়’। আমরা
কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তার দিন কয়েক পর একদিন স্কুলে
মাগারাম এলো সেজেগুজে পালিশকরা জুতো পায়ে ফর্মাল ড্রেসে। হাতে একটা তাজা গোলাপ ফুল। কারো
সাথে কথা না বলে ক্লাস টিচারকে ফুলটা ধরিয়ে বলল, ‘স্যার আজ আমার জন্মদিন’। স্যার যথারীতি তাকে উইশ করলেন।
মাগারাম পিছনের বেঞ্চে নিজের সিট অধিকার করে ফিসফিস করে আমাদের আসল কথাটা বলে দিল। জন্মদিন নয়, নাককাটি
বুড়ি আর ইহলোকে নাই। তাই আজ তার আনন্দের দিন। আমাদের প্রশ্ন, -আর তোর দিদি? –সে তো মাস দুই আগেই গত হয়েছে। আমার
শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম ।-কিন্তু
সেদিন যে স্কুলের মোড়ে কাশের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে দেখলাম? মাগারাম গম্ভীর চুপচাপ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরে বলল, -ওটা
তুই ভুল দেখেছিস।
তারপর
মাগারাম অসম্ভব সিরিয়াস ছাত্র হয়ে গেল।
সামনের বেঞ্চে বসতো। আর কল্পনায় তার
পেন্সিলের আঁকিবুকি চলতো না। বছর
পাঁচের মধ্যে এক দুবারই তার নাককাটি মাসির নিয়ে কথা হয়েছিল মাত্র। মনে পড়ে, দুবারই
ভাসাভাসা একটি কথাই বলেছিল, মাসি
বিদ্যেটা কাকে দিয়ে গেল? তারপর
অনেক বছর পার হয়েছে। দেশের বাড়ি একরকম ছাড়া
হয়ে গেছে। স্কুলের বন্ধু মাগারামকে দেখলে এখন আর হয়তো
চিনতেই পারবো না। কোথায় আছে কি করছে আমার জানা নেই। কিন্তু কখনো আধো অন্ধকারে কোনও ঘরের নির্জন একান্তে থাকলেই
তার ফিসফিস কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। কোনো
সাদা কোরা কাগজ খুলে পেন্সিল হাতে ধরলেই কাল্পনিক সাদা পোশাকের ফর্সা মেমের মত
নাককাটি বুড়ি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে তার গমন পথের অঙ্কনের অপেক্ষায়।
(৩)
এই কাঠ
পিপড়ে আমি চিনি। মাথাটা বড়, শক্ত দাঁড়া, কামড়ে বিষ। আমাজন নদীর ধারে এমনিই পিপড়ে থাকে, শুনেছি যারা একটা ছুটন্ত ঘোড়াকে নিমেষে শেষ করে হাড়ের কঙ্কাল বানিয়ে ফেলতে
পারে। গাছটাকে তবে এরাই খোকলা করে ফেলেছে? ফোকর থেকে বেশ কয়েকটা সারি পিলপিল করে গাছটাকে পেঁচিয়ে
ওপরে উঠছে। যেন গাছটাতে বেশ কয়েকটা ফিতে জড়ানো। এখনো
সেই মোটা ডাল অব্দি পৌছয়নি।
তক্ষুনি স্বপ্নের কথা ধাঁ করে মনে পড়ে গেল। যেন
চাক্ষুস দেখলাম ওই মোটা ডালের উপরে পাতায় মোড়া রয়েছে ছায়ার ফুসফুস। ওটাকে পিপড়ের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। গাছের চারপাশে ভিড়। সবার হাত তুলে কাতর
আর্তনাদ। ক্ষণিকের জন্যে মনে হল ওই ভিড় আমাকে তুলে
উপরে ডালটার দিকে ছুঁড়ে দেবে। আমি
শূন্যে ঝুলে আছি। মাথা ঝাঁকিয়ে নিতেই দেখি কেউ কোত্থাও নেই, ফাঁকা। এমনকি
সেই কালো রেনকোট পরা পাঁচটা মহিলাকেও দেখতে পেলাম না। আর আমি একেবারে গাছের সাথে লেপ্টে আছি। আমার
নাকের পাশ দিয়ে বিষপিপড়ের সারি ওপরে উঠছে। ওর
আমার গায়ে ছড়িয়ে যেতে পারতো।
কিন্তু আমি যেন ওদের লক্ষ্যবস্তু নয়। ওরা
একটুপরেই উপরের ওই ডালটায় পৌছে যাবে। ওদের
যেকোনো উপায়ে আটকাতেই হবে।
ছায়াকে বাঁচানো দরকার। কিন্তু ছায়া কে? সে কোথায় থাকে? এই মুহূর্তে স্বপ্ন ও বাস্তব একাকার
হয়ে গেল। সেই বাল্যকালের কাল্পনিক নাককটি ডাইনি মাগারামের স্লেটে তার রূপচলন এখন আমার কাছে অতি প্রয়োজনীয় বাস্তব
হয়ে দাঁড়াল। ওই উপরের ডালে চড়তেই হবে।
আমি
একটু সরে এসে পিছন ঘুরে দেখলাম যদি সাহায্য করার কেউ থাকে তো। বৃষ্টি তখন তুমুল। আমাকে বারবার চোখ মুছতে
হচ্ছে। একটু পিছিয়ে চারপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম
বাঁশ ডান্ডা ভারী লোহার রড জাতীয় কিছু পাই তো। সেরকম কিছুই পেলাম না। কিন্তু একটা ঝোপের আড়ালে দেখলাম কালো কাপড়ের মত কিছু। টানতেই দেখলাম ওই মেয়েগুলোর রেনকোট। কেন
এখানে খুলে রেখেছে, কোথায় গেল তারা এই কথা
এখন ভাবার সময় নয়। যে দ্রুতগতিতে পিপড়ের সারি ওপরে উঠছে, দেরি না হয়ে যায়। কালো রেনকোটের একটা
রিবন টানতেই সেটা চওড়া ফিতের
মত খুলে আসতে লাগলো। যত টানি তত লম্বা ফিতে
খুলে আসে। ফিতের
আগায় একটা বড়সড় পাথর বেঁধে সেটা ডালের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। একটু ঢিল দিতেই পাথরটা সরসর করে আমার হাতে চলে এল। আমার কেমন যেন ঝোঁক চেপে গেছে। কোনো
কারণ জানতে ইচ্ছে করছে না, না
কোনো প্রশ্ন। করতেই হবে এই পণ। ফিতেটা মজবুত করে কোমরে বেঁধে ঝুলে পড়লাম। আসতে আসতে দড়ি বেয়ে উপরে উঠে
নিচে তাকাতেই দেখি ওই পাঁচটা মহিলা একেবারে উলঙ্গ, দু’ হাত
উপরে তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আর
গাছের গুঁড়িতে পিপড়ের সারি? গেলো
কোথায়? হাপিশ হয়ে গেল? বৃষ্টি যেন এবার সরাসরি আমার মাথার উপরে ঝরে পড়ছে। আমি হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে গিয়ে পেলাম মুঠো ভর্তি পিপড়ে। সর্বনাশ! আমি নিশ্চিত জানি এই ডালের উপরই
রাখা আছে একটা বড় অশত্থ পাতার উপর একদলা মাংস। আমি নিশ্চিত জানি। আমি বহুদিন ধরে মনশ্চক্ষে দেখে এসেছি। ওই রিপিটেড স্বপ্নই আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে স্পষ্ট। ছায়ার ফুসফুস রাখা আছে এই অশত্থগাছের উপরেই। কিন্তু কোথায়? আঃ। পিপড়েগুলো কানের ভিতরে ঢুকতে চাইছে। চোখের পাতা ঢেকে দিচ্ছে। কি
করে আটকাই। আমি অন্ধের মত ডালের আগা অব্দি ঘষটে ঘষটে
এগিয়ে যেতে লাগলাম। কোত্থাও নেই। আর একটু ডালের ডগার দিকে এগোতেই দেখি একটা কালো গর্ত। পিপড়েগুলো এবার আমাকে ছেড়ে ওই গর্তের ভিতরে ঢুকতে লাগলো। নিচের দিকে নজর পড়লো। দেখি
ওই নগ্ন মেয়েগুলো দাঁত জিভ বের করে চিত্কার করছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। ওরা হাত বাড়িয়ে আছে, আর আশ্চর্য আমি যে শাখাতে বসে, তার
ডালপালা ওদের নাগালে? ওরা ক্রমশ নিচের দিকে
টানছে। ডালটা অসম্ভব নুয়ে পড়ছে। আমার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। পিপড়েরা ডালের যে ফাটলে ঢুকছে সেটার ভিতরে মরিয়া হয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। আমি নিশ্চিত, ওইখানেই
রয়েছে ছায়ার ফুসফুস। পুরো হাত ফস করে ঢুকে গেল। ক্রমে ক্রমে আমি পুরোটাই ঢুকে গেলাম। আরো নিচে... আরো
নিচে তল পাচ্ছি না কেন? আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি কোথায়?
(৪)
স্লেটের
উপর চক পেন্সিলের গুঁড়ো এতো বেশি যে নাককাটি বুড়ি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই ওর পরনে সাদা ধুতি। তাছাড়া মাগারামের পেনসিল মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে কেন? ওর সাথে আরো কজন হাঁটছে। ওরা
কি ছায়ার বাড়ি যাচ্ছে? তবে কি ওকে বাঁচানো
যাবে না? এসব ভাবতে আমার মাথা ভারী হয়ে আসছে কেন? ওহো, আমার
মাথায় এখনো অনেকগুলো পিপড়ে।
মাথাটা একটু ঝেড়ে ফেলতেই সেই ঝিমমারা স্বপ্ন আবেশ কেটে গেল। কি আজেবাজে ভাবছি। কবে সেই ক্লাস ফোরে
মাগারামের স্লেট পেন্সিল নিয়ে কাল্পনিক খেলা, তার সাথে হালে স্বপ্নে দেখা ছায়ার বাঁচা মরা সমস্যা, তার ওপর অশত্থ গাছের পিপড়ে। পিপড়ে? আমি আমি কি গাছে সত্যিই উঠেছিলাম? স্বপ্ন কল্পনা স্মৃতি ঘটনা একসাথে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ওঃ ভগবান! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
আবার
মাথা ঝাঁকিয়ে নিতেই পূর্ণ চেতনা ড্রপ খেল। চোখ
মেলেই ছিলাম কিন্তু কিছু নজরে আসছিল না। এবার
দৃষ্টি ফিরল। দেখলাম সাদা এপ্রোন পরা নার্স আসা যাওয়া করছে। সাথে ডাক্তারেরা। ভিজিট চলছে। মানে আমি হাসপাতালে। এটা কেমন কেবিন? এখানে তো স্যালাইনের
বোতল নেই ক্যাথিটার নেই?
নার্সটা হিলের খটখট শব্দ তুলে আমার দিকে আসছে। আমি জানি না
আমার কি হয়েছে। সিরিয়াস কিছু? তবে কি ওই গাছের কোটর দিয়ে গলে গিয়ে...? আবার মাথায় স্বপ্নটা হুশ করে তাজা হয়ে এলো। ছায়ার ফুসফুস গাছের ডালে রাখা। ওই নাককাটি রেখেছে।
পিপড়েরা সারি বেঁধে উঠছে গাছ বেয়ে। আমি
সামনে তাকাতেই দেখি ফর্সা মেমের মত নার্সটা মুখে মাস্ক পরা হাতে ইঞ্জেকশন সিরিন্জ
নিয়ে আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। আমার
কাছে এসে মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে দ্রুত ফিসফিস করে বলতে লাগলো, ‘ডক্টর সিজার সিজার হি ইজ সিংকিঙ্গ...’। আমি ডক্টরকে দেখতে পাচ্ছি না গলা শুনতে পাচ্ছি। চকখড়ির সাদা গুঁড়োয় মুছে যাচ্ছে। ‘ডোন্ট
উওরি। ওর কিছু হবে না আর। এখন ডিরিয়ালাইজেশন ডিসর্ডার সিম্পটমস দেখা যাচ্ছে বটে। ও কিছুদিনের ভিতরেই কেটে যাবে। অনেক
খারাপ ধরনের ডেমেন্টোফোবিয়া ছিল।
ক্রনিক। বহুবছর ধরে পুষে রেখেছে। তুমি এখনি ইনজেকশনটা দিয়ে দাও’।
ডাক্তারের
কথা আমার কানে ঢুকছে ঠিকই।
কিন্তু আমার চোখ আছে নার্সের দিকে। ওর
মুখ আমার মুখের খুব কাছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ওর নাক নেই। তার
বদলে দুটো গভীর গর্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন