কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৫ |
উত্থানপর্ব
শোবারঘর থেকে ভেসে আসছে বাংলা সিনেমার ডায়লগ। বিরক্ত মুখে হাত ধুতে গিয়ে
রিনা দেখল বেসিনের পাশ দিয়ে কালো পিঁপড়ের দীর্ঘ লাইন। খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে,
ফ্রিজের পিছনে একটা আধমরা আরশোলা। ঝাড়ু মেরে ওটাকে বিনে ফেলল। তারপর দু’হাতে
সাবান মাখলো খুব করে। আজ কি বৃষ্টি হবে? যা গরম পড়েছে! আগুনের আঁচে
মুখটা লালচে হয়ে আছে। রান্নাঘরের মেঝেও তেতে উঠেছে। ঘামে জবজবে শরীর। বৃষ্টি হলে
সেও একটু শীতল হত। হঠাৎ রিনা জলের কল বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। মনের ভেতরের
পুরনো অস্থিরতাটা ফিরে আসে।
সময় হয়ে গেল? আজই কি...
তড়িঘড়ি গ্যাস বন্ধ করে। চচ্চড়ি ধরে গেছে। মাছের ঝোলটা ঢালে বাটিতে। এ
বাড়িতে সময়ের খাবার সময়ে দিতে হয়। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। এবং তা রিনাকেই করতে
হয়। আর কেউ তাতে হাত লাগায় না। কেউ বলতে অবশ্য একজনই আছে। অবসরপ্রাপ্ত এক মিলিটারি
পুরুষ। রিনার ভেতরটা শুকিয়ে খটখটে এখন, হয়তো আজই সে বলবে কথাটা। সাবানজলে কেবল হাত
নয়, হঠাৎ রিরি করে ওঠা মনটাকেও ধুয়ে নিতে ইচ্ছে করে ওর। ততক্ষণে টেবিলের সামনে
পুরুষটি।
-হয়নি? আর কতক্ষণ?
রিনা তার শুকনো মুখের চেয়েও অধিক শুকনো ছোট মাছের চচ্চড়ি টেবিলে এনে রাখে।
ডালের বাটি, মাছের ঝোল এগিয়ে দেয়। লোকটা খেতে গিয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে, এটা কি চচ্চড়ি
না ছাতুর ডেলা? পুরো চচ্চড়িটাই ধুপ করে মাটিতে গিয়ে পড়ে। লোকটা ডাল নিতে গিয়ে
টেবিলে ডাল ফেলে। জল ফেলে। মাছ দিয়ে ভাত মাখে। অর্ধেক খায়, বাকিটা মেঝেতে ছিটায়।
তারপর হাত ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ঢোকার আগে বলে যায়, স্নান হলে ঘরে এসো।
গলার স্বর কিছুক্ষণের জন্য ধারালো থেকে নিচের দিকে নামে।
ঠিক যা ভেবেছিল রিনা... খাবারের ওপর রাগ দেখানোটা কেবল ইশারা। এই পঁয়ষট্টিতেও মাসে চার-পাঁচদিন রিনাকে তার চাই।
সাড়া না দিলেই রাগ... লোকটা ডাকলে ঘিনঘিন
করে মন অথচ ফুঁসে উঠতে গিয়ে পারে না। আজও পারল না। লোকটাকে চচ্চড়ির মতই ছুঁড়ে
মারার ইচ্ছেটা মনে পুষে রেখে রিনা টেবিল
মুছল। মেঝে মুছল। উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ জল, ডাল, চচ্চড়ি, দু-চার-ছ
দানা ফেলাছড়া ভাত, ঝোল, মাছের কাঁটাগুলোকে মুখে পুরে চিবুতে শুরু করল। মুখ লাল।
চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তারপর ডাস্টবিনের
ঢাকা খুলে হড়হড় করে বমি করল। টগবগ ফুটতে থাকা রাগগুলো নাড়ি মুচড়ে টকজল হয়ে বেরিয়ে আসার পর
অবসন্ন শরীরে সেখানেই ঝিম মেরে থাকে ও। দুর্গন্ধময় উচ্ছিষ্ট আর বমির মাঝে সেই
আরশোলাটা চোখে পড়ে তখন। মরেনি তো! দিব্য চেয়ে আছে জুলজুল করে। বিন ছেড়ে সুড়সুড় করে
বেরিয়েও আসছে ।
অভুক্ত, অবসন্ন রিনা এখন মেঝেতে শুয়ে। প্রবল ঘুম পাচ্ছে। আর সারাশরীরে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আরশোলাটা। ঘুমের গাঢ়তার দিকে যেতে যেতে কখন যেন রিনার শরীরও জেগে
ওঠে।
রিনাও একটা আরশোলা হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন