কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৪ |
সেই সময়
তখন আমাদের ফ্রক-পরা বয়স। আমরা মানে মিলি, দূরদানা, লোপা, ফারজানা,
রূপা, লিনেট এবং আমি। তখন বিজয়ার ফুলকো-লুচি, লাবড়া কিংবা শবেবরাতের হালুয়া-রুটিধর্মের
বেড়া টপকে পৌঁছে যেত এবাড়ি-ওবাড়ি। লিনেটদের বাড়িতে মোরব্বা জড়ানো ক্রিস্টমাস-কেইক
চেটেপুটে সাবাড় করতাম নিঃসংকোচে।
তবে ছবিদিদিরা আসার পরেই আমাদের জীবনের সেরা ঘটনাটি ঘটেছিল এবং সেবারই প্রথম
বৌদ্ধমন্দিরে ফানুস ওড়ানো দেখেছিলাম আমরা।
বাড়ির লাগোয়া মাঠটাতেই খেলতাম আমরা। জানতাম কোথায় ঘাসে হাত
ছোঁয়ালেই ফড়ফড়িয়ে উড়বে প্রজাপতি। আকাশে মেঘেদের গল্প খোঁজাও ছিল
আমাদের প্রিয় খেলা। অথচ এই
আকাশেই ক’দিন আগে গোত্তা মেরেছে বোমারু-বিমান। সেইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি আমরা ভুলেও মনে
করতাম না। মাঠের পূব-কোণের বাড়িটার পাঁচিল পেরিয়ে লেবুফুলের গন্ধ ভেসে এলেই আমাদের
মন কেমন করত। মাঠের ওদিকটায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না আমাদের।
বাড়িটার আদি মালিক ছিলেন দেবেশ সেন। পঞ্চাশের দাঙ্গায়, সীতাকুণ্ড
স্টেশনের সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডে নিহত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে দেবেশবাবুর স্ত্রী এবং কন্যাও
ছিল। দেবেশবাবু দেশ ছেড়েছিলেন। বাড়িটার দখল নিয়েছিল অবাঙালি ইসহাক খান। আশ্চর্য কী
বড়োরাও আমাদের মতোই এইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি এড়িয়ে যেত। কেবল ছোটো-মাছের চচ্চড়িতে কাঁচা
লঙ্কা মেশাতে মেশাতে ঠাম্মা
বলতেন, ‘ঐ বাড়ির দুইখানা লেবুপাতা দিলেই বুঝতা সোয়াদ কী!’
ইসহাক খানের সঙ্গে কারো খাইখাতির ছিল না। তাই যেদিন পাড়াতে
মালপত্র বোঝাই ট্রাকটা থামল, সেদিনই জানা গেল বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। এরা ভাড়াটে।
নতুন মালিক অন্য শহরে থাকেন। আমরাও খেলা ছেড়ে ভিড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওদের। মায়ের
গলা আঁকড়ে থাকা ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আমাদের আর চোখ সরে না! কিন্তু আমাদের চেয়ে
একটু উঁচু মেয়েটা যেই চোখ মেলাল অমনি লেবুগন্ধী হাওয়া উড়ে এসে জানিয়েছিল, এদিকে
আসার অনুমতি নেই আমাদের। আমরা তক্ষুনি হাওয়ার বেগেই বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম।
পরদিনই আমাদের মায়েরা সকল বৃত্তান্ত জেনে এসেছিল। আমরা গিয়েছিলাম
আরও পরে। মেয়েটা ততদিনে আমাদের ছবিদিদি।
বাচ্চাটার নাম বিজয়, দেশ স্বাধীনের ঠিক চারদিন পরেই ওর জন্ম।
সেদিন পুরো বাড়িটা ঘুরে
দেখেছিলাম আমরা! চকমেলানো মেঝে। উঁচু সিলিং। পেছনের লেবুবাগানে পা দিয়েই আমরা থমকে
দাঁড়িয়েছিলাম। ডাল-পাতা জড়াজড়ি করে কী সুন্দর সামিয়ানা বানিয়েছে! হাওয়ায় ভাসছে সুবাস! ঠাম্মার জন্য
দুটো পাতা চেয়ে নিয়েছিলাম আমি। পাতা হাতে দিতেই ঠাম্মার চশমার কাচ পেরিয়ে জল
গড়াচ্ছিল।
অতঃপর এই লেবুতলাই আমাদের খেলাঘর বনে গিয়েছিল। দুপুরের রোদ্দুর কী
সুন্দর আলোছায়ার সুজনী বুনতো! সেই আলিম্পনের নকশা ছেঁকেই আমরা গল্প শোনাতাম বিজয়কে...
আমাদের আনন্দময় দিনগুলো বেশিদিন টেকেনি। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট কাকিমার
চিৎকারে ঘুম
ভেঙেছিল : ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাকে ছবিদিদির
বাবা নেই হয়ে গেছেন! আমরা তখনও জানিনা, একই সময়ে রাজধানীতে
পিতৃহন্তার কলঙ্কে হাত রাঙাচ্ছে জাতি।
ক’দিন পরেই বাড়িটা ফের হাতবদল হলো। এবার মাঠসহ। ছবিদিদিরা চলে
গেল।
এরপরে হাওয়াতে আর লেবুর সুবাস নয় বালি ভাসত এবং আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে নির্মিত হলো এক বিশাল
মার্কেট।
একসময় আমাদের চারপাশটাই বদলে গেল। বদলালাম আমরা; এমনকি সংবিধানও...
একটা ঝুরো গল্পে কী করে কত ইতিহাস চলে এলো। ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়লো আবেগের দেয়াল, দেখিয়ে দিলো বিভেদের নগ্ন রূপ।
উত্তরমুছুনসাদিয়া কী জানি কতটা পারলাম! ভালোবাসা ।
মুছুনআপনার লেখা বড্ড মন্থর করে দেয়। পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত বিষন্ন আরাম ঘিরে ধরে আর যখন শেষ হয়ে পড়ে পড়া, অঙ্গবিহীন সেই আলিঙ্গন রেশ রেখে যায়।
উত্তরমুছুনকী সুন্দর করে যে বললেন! অতটা প্রশংসার যোগ্য আমি নই তবুও নত হই।
মুছুনসাদিয়া কী জানি কতটা পারলাম! ভালোবাসা ।
উত্তরমুছুনসময়ের গান। যুগের পর যুগ শুনলেও যা পুরনো হয় না।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুন