মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

অর্ক চট্টোপাধ্যায়



কালিমাটির ঝুরোগল্প



জেনারেটর 

জেনারেটর। আগে আলো দিত। এখন স্মৃতি দেয়। ৯০এর লোডশেডিংয়ের শৈশবে ছিল হাতে টানা ডায়নোসরের মতো হোন্ডা কোম্পানীর জেনারেটর। এখন লোডশেডিং এবং জেনারেটর দুজনেই ডোডো পাখি। এখন ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমি, চাঁদের আলো, তবুও কেন যে এতো অন্ধকার! কেন দলিত বলে পিটিয়ে মারা, পুড়িয়ে মারা মানুষের কঙ্কাল চতুর্দিকে? অমনভাবে মরা একেকটা মানুষ কতটা অন্ধকার তৈরী করে বলুন তো পাঠক? পোড়া হাড় উজিয়ে অন্ধকার উঠে আসে, ভেসে আসে, তেড়ে ধরে, গিলে নেয়। তবে কি সত্যিই দরকার ফুরিয়েছে জেনারেটরের?

জেনারেটর এসেছিল মায়ের বাড়ি থেকে। দাদুর দেওয়া উপহার। লোডশেডিং হলে বারান্দায় গিয়ে সবার আগে অনাবৃত করা হতো তাকে। তারপর দড়ি ধরে মারো টান। কখনো একবারের টানেই স্টার্ট নিয়ে নিত। কখনো আবার একযুগ ধরে টানামানি করতে হত। সে জেনারেটরে একটা ঘরের আলো-পাখা চলে যেত আরকি। জেনারেটর চালানোর যুদ্ধের দায় সাধারণত বাবার কাঁধেই থাকতো। কখনো সখনো বাবা বাড়ি না থাকলে ছেলেও হাত লাগতো। জেনারেটরের দড়ি টানতে টানতেই কি ছেলে বড়ো হয়ে গেল, পুরুষ হয়ে উঠলো? 

ছেলে থেকে বাবা, বাবা থেকে ছেলে, ৯০ থেকে দশকের মোড় ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন শতাব্দী। প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রথমে ইনভার্টার এসে বাজার হাত করলো হোন্ডা জেনারেটরের। তারপর বিশ্বায়নের জেরে লোডশেডিংয়ের অন্ধকারখানই বিদায় নিল। সাথে নিয়ে গেল প্রাক-বিশ্বায়নযুগের রেলিকস্বরূপ সেই জেনারেটর।
ছেলেটা ততদিনে বড় হয়ে গেছে। অন্ধকার লোডশেডিং ভুলে অন্য পরিসরের নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছে। ছেলেটা বুড়ো হয়ে গেলেও বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কতবার দড়ি ধরে টান মারলে জেনারেটর চালু হবে। 

কতবার? আর কতবার?    

বয়েস বাড়লে সংখ্যার এক অন্য চেহারা সামনে আসে। চেনা জায়গা, চেনা লোকেদের সঙ্গে মোলাকাত হলেই মনে হয়, আর কতবার? আর কতবার দেখা? আর কতবার আড্ডা? কতবার গল্প-কবিতা? কতবার মধ্যরাত? কতবার রাজনীতি-প্রেম? কতবার মাঠ-ঘাট-ময়দান, ধোঁয়া-তরল? আরেকবার হল কিন্তু এরপর, আর কতবার?

সংখ্যামাত্রেই যখন কাউন্টডাউন হয়ে যায়, তখন মনে হয়, মেঘের ভেতরে মেঘ জমেছে, বছরের ভেতর বছর আর বয়েসের ভেতর বয়স। আর কতবার? সংখ্যারা উত্তর দেয় না। প্রতিধ্বনি ফিরে আসেঃ 'আর কতবার?'

বাতিল জেনারেটর দিয়ে কি সচল বোমা বানানো যায়? উড়িয়ে দেওয়া যায় লিনচারদের? তাতে কি অন্ধকার বাড়বে, না আলো? পুরনো ইলেকট্রনিক্সের ধ্যারধ্যারে দোকানের কোণে পড়েছিল অকেজো হোন্ডা কোম্পানীর জেনারেটর। জন্তুটার দিকে চোখ এক করে তাকিয়ে ছিল ছোটু। বছর ১৩ বয়েস। এই দোকানে হেল্পারের কাজ করে। পুড়িয়ে মারা মানুষের দেহ থেকে যে অন্ধকার বের হয় তা লেগেছিল ওর শরীরের সর্বত্র। কী ভাবছিল ও জেনারেটরটার দিকে ঠায় তাকিয়ে?

আর কতবার? আর কতবার?  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন