মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>





কালিমাটি অনলাইন / ৭৭



যে ভীষণ মহামারীতে সারা বিশ্ব আজ আক্রান্ত, তা থেকে কবে মুক্তি ঘটবে বা মুক্তি ঘটতে পারে, তার কোনো সদুত্তর এখনও পর্যন্ত কেউই দিতে পারছেন না। অথচ মানুষের অধ্যাবসায়, গবেষণা, প্রচেষ্টা ও শ্রমের কোনো ঘাটতি নেই। প্রাণপাত করে তাঁরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নিরন্তর এই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখেছেন। হ্যাঁ, এটা একটা যুদ্ধ, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের কঠিন যুদ্ধ। এর আগেও মানুষ এই ধরনের মহামারীর মুখোমুখি বহুবার হয়েছে। অসংখ্য জীবন  সমাপ্ত হয়ে গেছে মৃত্যুর করাল থাবায়। তবুও মানুষ পিছু হটেনি, লড়াই চালিয়ে গেছে এবং পরিশেষে জয়লাভও করেছে। কিন্তু এইসব মহামারী যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, তার বিস্তার ছিল অঞ্চল বিশেষে। আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষজন সংক্রামিত এবং বিপর্যস্ত হলেও সারা বিশ্বে তার বিস্তার ঘটেনি। কিন্তু এবার এই নতুন মহামারী বিশ্বের অনেকানেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে উন্মত্ত দাবানলের মতো। প্রতিদিন চলেছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। আক্রান্ত দেশগুলির সরকার, প্রশাসন, চিকিৎসক ও সেবাকর্মী, নিরাপত্তাবাহিনী এবং অত্যাবশ্যক পরিষেবার প্রতিটি মানুষ জীবন বাজি রেখে অব্যাহত রেখেছেন তাঁদের কর্তব্যকর্ম। মানুষের সেবায় তাঁদের অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টা অতুলনীয়। কিন্তু তবুও, এখনও পর্যন্ত এমন কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাতে মানুষ সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারে, মন থেকে এই মহামারীজনিত মৃত্যুভয় দূর হতে পারে, স্বাভাবিক সুস্থ  অভ্যস্ত জীবনে আবার ফিরে যেতে পারে। সেইসঙ্গে একথাও ঠিক, একমাত্র মানুষই পারে এই ভয়ংকর অন্ধকার দিনগুলিকে অতিক্রম করে আবার আলোর সন্ধান দিতে। একমাত্র মানুষই পারে মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জীবনের জয়গান ঘোষণা করতে। আমরা সবাই আছি সেই সোনালি দিনের অপেক্ষায়। এবং সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের যা কর্তব্যকর্ম, তা থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই। নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখতে হবে, সুস্থ রাখতে হবে পাড়া প্রতিবেশী এবং বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে। তাই অহেতুক জীবন নিয়ে কোনো বাজিখেলা নয়, কোনো অপ্রয়োজনীয় বিপজ্জনক কাজে নিজেকে জড়িত  করা নয়, কোনো হঠকারিতা নয়, এমন কি ভুল করেও কোনো বোকামি করা নয়। আমাদের কারও অধিকার নেই একান্ত অনাবশ্যকভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করা এবং অন্যদের জীবন বিপন্ন করা।

বাংলা নতুন বছরের আগমন ঘটল বড় দুঃসময়ে। তাকে প্রতিবছর যেভাবে সমবেতভাবে আমরা বরণ করি আনন্দে, খুশিতে, গানে, কবিতায়, মেলামেশায় – এবার তা সম্ভব হলো না। এই দুঃখ ও বেদনা রয়ে গেল আমাদের মনে। ঘরের কোণে একান্তে বসে শুধু এইটুকু কামনা করি, নতুন বছর আমাদের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসুক সেই আগের আনন্দ ও খুশির দিনগুলি। সহজ মেলামেশা ও ভালোবাসার দিনগুলি।

সবাইকে জানাই বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, প্রীতি এবং শ্রদ্ধা।  


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :    
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.

আলম তৌহিদ




জগত সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির গল্প   


         


 (২)


বিভিন্ন পুরাণে সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে আদিতে ঈশ্বর পুরুষ এবং প্রকৃতিতে বিভক্ত হন। প্রকৃতি স্তত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর প্রথমে মহতত্ত্ব বা বুদ্ধিতত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। মহতত্ত্বের সাথে দ্রব্য-ক্রিয়া-জ্ঞান সংযোজন করে অহংকার-তত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। তিনি সাত্মিক অহংকার থেকে দিক, বহ্নি, অর্ক, চন্দ্র, বায়ু, অশ্বিনীকুমার, ইন্দ্র, উপেন্দ্র, মিত্র ও প্রজাপতি এই দশ দেবতা সৃষ্টি করলেন। মন, দশ ইন্দ্রিয়, জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি সৃষ্টি করলেন রাজসিক অহংকার হতে। তামসিক অহংকার হতে সৃষ্টি হল ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ ও ব্যোম। এদের গুণ থেকে সৃষ্টি হল শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ। মহতত্ত্ব হতে পঞ্চ-মহাভূত পর্যন্ত সকল বস্তু মিলিত হয়ে একটি হিরণ্যময় অণ্ড বা ডিম্বে পরিণত হলো। এই ডিম্বে ব্রহ্মা অবস্থান করলেন। এই ডিম্ব থেকেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। ডিম্বের উপরিভাগ থেকে সপ্তলোক ও নিম্নভাগ থেকে সপ্ত-পাতাল সৃষ্টি হয়েছে। এরপর ব্রহ্মা ক্রমে ক্রমে দশ দিক, কাল, মন, বাক্য, কাম, ক্রোধ ও রতি সৃষ্টি করলেন। প্রজা সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা নিজ মানস হতে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ত্রুতু এবং বশিষ্ঠ এই সপ্তঋষি সৃষ্টি করলেন। এরপর তিনি বিদ্যুৎ, অশনি (অগ্নি), মেঘ, ইন্দ্রধনু, পক্ষীকুল ও পর্জন্য সৃষ্টি করলেন এবং যজ্ঞকার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করলেন বেদ।

ব্রহ্মার মানসপুত্রগণ প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারায় তিনি নিজ দেহ দ্বিখণ্ডিত করলেন। তাঁর দেহের একখণ্ড থেকে মনু নামক পুরুষ এবং অপর খণ্ড থেকে শতরূপা নামক নারীকে সৃষ্টি করলেন। মনু ও শতরূপা থেকেই মানুষের বংশবৃদ্ধি হতে লাগল।

ব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন আমরা তাঁর নাম পেয়েছি ব্রহ্ম বা ব্রহ্মা। নামটা যথাযত হলেও তিনি সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সয়ম্ভু নন। কারণ তাঁকে সৃষ্টি করেছেন বিষ্ণু (নারায়ণ)। বিষ্ণু পুরাণে আছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু ও সংহারকর্তা মহেশ্বরের (শিব) সাথে যুক্ত হয়ে এক ত্রিমূর্তি গঠন করেন। এখানে আমরা ব্রহ্মাকে পাই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে, বিষ্ণুকে পালনকর্তা এবং মহেশ্বর বা শিবকে ধ্বংসকারী হিসেবে। ব্রহ্মার জন্ম হয়েছে বিষ্ণু বা নারায়ণ থেকে। কল্পের সাগরে শীষনাগের অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণুর নাভি থেকে জাত ব্রহ্মা পদ্মের উপর বসে আছেন। সৃষ্টির আদিতে বিষ্ণু ছিলেন একা। সৃষ্টির কথা স্মরণ হতেই তাঁর নাভিজাত পদ্মে ব্রহ্মার জন্ম হয়। আর বিষ্ণুর বাম হাত থেকে উৎপত্তি হয় দেবী লক্ষ্মীর। ব্রহ্মা যখন একা সৃষ্টির কাজে অক্ষম হলেন, বিষ্ণুর পরামর্শে শিবের কাছে গেলেন। শিব যোগের মাধ্যমে শিব এবং শিবা এই দুই খণ্ডে ভাগ হয়ে গেলেন। এই শিবাই হলো আদি শক্তি। এরপর ত্রিদেবের একত্রিত শক্তি দিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র, জীব ও জড় তৈরি করলেন। বিষ্ণু যখন যোগনিদ্রায় মগ্ন থেকে ব্রহ্মাকে শক্তি দিচ্ছিলেন তখন তাঁর কান থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুটো অসুর জন্ম নিল। 

শতপথ ব্রাহ্মণে সৃষ্টিকর্তা হলো প্রজাপতি। তিনিও সৃষ্টির আদিতে একা ছিলেন। তাই তিনি নিজেকে পুরুষ ও স্ত্রী এই দুটি খণ্ডে বিভক্ত করেন। স্ত্রী ও পুরুষ ক্রমে ক্রমে প্রত্যেকটি প্রাণীর দুটি ভিন্ন  প্রজাতি তৈরি করলেন। পুরাণে এই প্রজাপতিকেই ব্রহ্মা বলে বর্ণনা করে হয়েছে।

হিন্দু পুরাণে সৃষ্টির একাধিক গল্প আছে। ঋগবেদের (১০.১২১) সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ডকোষ থেকে। পুরুষসূক্তের মতে (১০.৯০) মতে, দেবতাদের দ্বারা পরাজিত পুরুষ নামক এক অলৌকিক মানবের ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে নানা বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। পুরাণে আছে বরাহরূপী বিষ্ণু কল্পের জল থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় ঈশ্বর হল একজন দেবী (মাদার গডেস)। তিনি শিংযুক্ত ছিলেন। তাকে বলা হত উর্বরতার দেবী।

আমরা দেখলাম শাস্ত্র ভেদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে। মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জনের হাতে রচিত বলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের কল্পনারও বিবর্তন হয়, এগুলো তারই দৃষ্টান্ত। যাহোক আমরা আরও স্রষ্টা ও সৃষ্টির গল্পের খোঁজে অগ্রসর হবো। 

আমরা যদি প্রাচীন ইরানের দিকে তাকাই পেয়ে যাব আরও একজন সৃষ্টিকর্তার নাম। তিনি হলেন অহুর মজদা। তিনি জোরওয়াস্টার (Zoroaster) উপর নাযিল করেছিলেন জেন্দ আবেস্তা কিতাবটি। পণ্ডিতদের অভিমত একেশ্বরবাদী এই ধর্মটিতে জোরাওয়াস্টারের মৃত্যুর পরবর্তীতে অগ্নি পুজার কথা অভিযোজিত হয়েছে। এখানে অহুর মজদা হলেন সমস্ত শুভের সৃষ্টিকর্তা, আর আংরামাইন্যু বা আহরিমান অশুভের সৃষ্টিকর্তা। তারা উভয়ে স্বাধীনসত্তা। এখানে সৃষ্টি ক্রিয়ায় দ্বৈতনীতির কথা বলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চলছে অহুর মজদার সাথে আহরিমানের লড়াই। অর্থাৎ শুভশক্তির বিরুদ্ধে অশুভশক্তির লড়াই। যদিও শক্তির দিক দিয়ে অহুর মজদা ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তদুপরি আহরিমান বিনাশকারী শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অহুর মজদার সৃষ্টিশীলতাকে প্রতিহতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অহুর মজদা তার আলোকিত শক্তি দ্বারা পবিত্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে আহরিমান দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বার্ধক্য, অসুস্থতা ও মৃত্যু দ্বারা একে অপবিত্র করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জেন্দ আবেস্তা কিতাবে আছে-
"এই পৃথিবী ক্রমে ক্রমে ছয় বারে সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমে আকাশ সৃষ্টি হইয়াছিল; দ্বিতীয় বারে জল, তৃতীয় বারে পৃথিবী, চতুর্থ বারে বৃক্ষাদি, পঞ্চম বারে প্রাণি-সমূহ এবং ষষ্ট বারে মনুষ্য।"২ 

অহুর মজদা প্রথমে 'আমেসা স্পেন্টাস' নামে সাতটি বিমূর্ত স্বর্গীয় দেবতা সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন মন্দকে আটকে রাখার জন্য। অহুর মজদা ভাসমান ডিম্ব আকৃতির মহাবিশ্ব তৈরি করেছিলেন। তিনি একে দুইভাগে সৃষ্টি করেন। প্রথমে তিনি আত্মা (মেনোগ)কে সৃষ্টি করেন। এর তিন হাজার বছর পর সৃষ্টি করেন দেহ (গেটিগ)। এরপর অহুর মজদা প্রথম প্রত্নতাত্বিক নিখুঁত মানুষ 'গ্যায়োমার্ড'কে সৃষ্টি করলেন। তারপর তৈরি করলেন প্রথম ষাঁড়।

যখন অহুর মজদা মহাবিশ্ব এবং মানুষ সৃষ্টি করলেন, আহরিমানের প্রবৃত্তি হল সেসব ধ্বংস করার জন্য। তিনি সৃষ্টি করলেন অশুভ ইয়াজাদ, হিংস্র প্রাণীদের, সর্প, পিঁপড়া এবং মাছিদের। মানুষ ছাড়া প্রত্যেকটা বস্তুর বিপরীতে অশুভ সত্তা সৃষ্টি করেছিলেন আহরিমান। তিনি দেখেছিলেন মানুষের সাথে তার কোন মিল নেই।

আহরিমান আকাশের গোড়া দিয়ে মহাবিশ্ব আক্রমণ করেছিলেন এবং গ্যায়োমার্ড ও ষাঁড়কে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। মৃত্যুর পর আদিম মানুষ ও ষাঁড়ের দেহ থেকে বীজ নির্গত হল। ষাঁড়ের বীজ থেকে বিশ্বের সমস্ত উপকারী উদ্ভিদ এবং প্রাণী বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর মানুষের বীজ থেকে এমন একটি গাছ জন্মাল যার পাতাগুলো প্রথম মানব দম্পতিতে পরিণত হয়েছিল। শয়তানের ফাঁদে পড়ে মানুষকে দুটি ভাঁজ করা মহাবিশ্বের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছিল।   

নবী ইব্রাহীম এবং জোরওয়াস্টার দুজনেই ছিলেন ইরানের আরান বা হারান অঞ্চলের অধিবাসী। জোরওয়াস্টার ছিলেন জাতিতে স্পিতামা আর ইব্রাহীম ইহুদী। *ড. স্পিগেলের মতে উভয়ে সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। জোরওয়াস্টার স্থানীয়ভাবে ধর্ম প্রচার করলেও ইব্রাহীম ধর্ম প্রচারের জন্য দেশ ত্যাগ করেছিলেন। ধর্ম হিসেবে তিনি যা প্রচার করেছিলেন তার অনেক কিছু পাওয়া যাবে জেন্দ আবেস্তা কিতাবে। মূলত তার প্রচারিত মতবাদই ছিল জুডাইজম বা ইহুদীবাদ।
  
ফারাও রাজার সাথে বিরোধে জড়িয়ে নবী মুসা ইব্রাহীমিয় মতবাদকে আরও  উন্নত ও সুসংহত করেছিলেন। এটিই বর্তমানে হিব্রুধর্ম। এই ধর্মের নযিলকৃত কিতাবের নাম তাওরাত। এখানে নবী মুসা আমাদের নতুন কোন জগৎ সৃষ্টিকর্তার সাথে পরিচয় করান নাই। এমন কী ইরানে আমরা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যে অহুর মজদাকে পেয়েছিলেম, ঘুণাক্ষরেও তিনি তাঁর নাম মুখে নিলেন না। মুসা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যার নাম বললেন, তিনি ইয়াহওয়েহ (YHWH), ইংরেজীতে জেহোভা (YHOBHA)নামে পরিচিত। উনাকে আমরা পূর্ব থেকেই চিনি। আদিতে তিনি ছিলেন মাদিয়ানের (সিনাই পর্বতের কাছাকাছি আরবের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল) যুদ্ধ দেবতা। ধারণা করা হয় ইহুদীরা মিদিয়ানে ব্যবসা করতে গিয়ে জেহোভার মূর্তি কেনানে নিয়ে আসে এবং তাদের প্রধান দেবতায় অভিষিক্ত করে। ইহুদীবাদের শুরুর দিকে জেহোভার পিতার নাম ছিল 'এল' (EL), আর মাতার নাম আশেরাহ। কিছু সময়ের জন্য আশেরাহকে তার স্ত্রী হিসেবেও গণ্য করা হত। মুসা কর্তৃক একেশ্বরবাদ প্রচার করার সময়ে তার পিতামাতার মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে তাকে লা-শরিক করা হয় এবং দেয়া হয় সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা।


নবী ঈসা ছিলেন জাতিতে ইহুদী। তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাবের নাম ইঞ্জিল। ইঞ্জিলের প্রথম অংশ ওল্ড টেষ্টামেণ্ট্‌, যার বেশিরভাগ নবী মুসার উপর নাযিলকৃত তাওরাতের অংশবিশেষ। তিনি আমাদের নতুন কোনো স্রষ্টার নাম জানালেন না। মুসার স্রষ্টাকেই গ্রহণ করে নিলেন এবং দাবী করলেন তিনি জেহোবার পুত্র। খৃষ্টান সম্প্রদায় তাঁকেই প্রভু জ্ঞান করে থাকেন। ইহুদী ও খৃষ্টধর্মে স্রষ্টা ও সৃষ্টির গল্প অভিন্ন। আদি পুস্তকে আছে-
শুরুতে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। আদিতে পৃথিবী ছিল শূন্য। জলরাশি ছিল অন্ধকারে আবৃত। সেই জলরাশির উপর ভেসে বেড়াচ্ছিল ঈশ্বরের আত্মা। তারপর ঈশ্বর বললেন, 'আলো ফুটুক'! তখনই আলো ফুটতে শুরু করল। আলো দেখে ঈশ্বর বুঝলেন, আলো ভাল। তখন ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলো পৃথক করলেন। ঈশ্বর আলোর নাম দিলেন 'দিন' এবং অন্ধকারের নাম দিলেন 'রাত্রি'। সন্ধ্যা হল এবং সেখানে সকাল হল। এই হল প্রথম দিন।

তারপর ঈশ্বর বললেন, 'জলকে দুভাগ করবার জন্য আকাশমণ্ডলের ব্যবস্থা হোক'। তিনি আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি করে জলকে পৃথক করলেন। একভাগ জল আকাশমণ্ডলের উপরে এবং অন্যভাগ জল আকাশমণ্ডলের নিচে থাকল। ঈশ্বর আকাশমণ্ডলের নাম দিলেন 'আকাশ'। সন্ধ্যা হল তারপর সকাল হল। এটা দ্বিতীয় দিন।

তারপর ঈশ্বর বললেন, 'আকাশের নীচের জল এক জায়গায় জমা হোক যাতে শুকনো ডাঙা দেখা যায়'। এবং তা-ই হল। ঈশ্বর শুকনো জমির নাম দিলেন 'পৃথিবী' এবং এক জায়গায় জমা জলের নাম দিলেন ‘মহাসাগর'। ঈশ্বর দেখলেন  ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে। তখন তিনি বললেন, 'পৃথিবীতে ঘাস হোক, শস্যদায়ী গাছ ও ফলের গাছপালা হোক। ফলের গাছগুলোতে ফল আর ফলের ভেতরে বীজ হোক। প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করুক। এইসব গাছপালা পৃথিবীতে বেড়্রে উঠুক'। আর তা-ই হল।

পৃথিবীতে ঘাস আর শস্যদায়ী উদ্ভিদ উৎপন্ন হল। আবার ফলদায়ী গাছপালাও হল, ফলের ভেতরে বীজ হল। প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করল এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে। সন্ধ্যা হল এবং সকাল হল। এভাবে হল তৃতীয় দিন।

তারপর ঈশ্বর বললেন, 'আকাশে আলো ফুটুক। এই আলো দিনকে রাত্রি থেকে পৃথক করবে। এই আলোগুলো বিশেষ সভা শুরু করার বিশেষ বিশেষ সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আর দিন ও বছর বোঝাবার জন্য এই আলোগুলো ব্যবহৃত হবে। পৃথিবীকে আলো দেওয়ার জন্য এই আলোগুলো আকাশে থাকবে'। এবং তা-ই হল। তখন ঈশ্বর দুটি মহাজ্যোতি বানালেন। বড়টি বানালেন দিনের বেলা রাজত্ব করার জন্য আর ছোটটি বানালেন রাত্রিবেলা রাজত্ব করার জন্য। ঈশ্বর তারকারাজিও সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীকে আলো দেয়ার জন্য ঈশ্বর এই আলোগুলোকে আকাশে স্থাপন করলেন। দিন ও রাত্রিকে কর্তৃত্ব দেবার জন্য ঈশ্বর এই আলোগুলোকে আকাশে সাজালেন। এই আলোগুলো আলো আর অন্ধকারকে পৃথক করে দিল এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে। সন্ধ্যা হল এবং সকাল হল। এভাবে হল চতুর্থ দিন।

তারপর ঈশ্বর বললেন, 'বহু প্রকার জীবন্ত প্রাণীতে জল পূর্ণ হোক আর পৃথিবীর ওপরে আকাশে উড়বার জন্য বহু পাখি হোক'। সুতরাং ঈশ্বর বড় বড় জলজন্তু এবং জলে বিচরণ করবে এমন সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করলেন। অনেক প্রকার সামুদ্রিক জীব রয়েছে এবং সে সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি। যত রকম পাখি আকাশে উড়ে সেসবও ঈশ্বর বানালেন। এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটি ভাল হয়েছে। ঈশ্বর এই সমস্ত প্রাণীদের আশীর্বাদ করলেন। ঈশ্বর পাখিদের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেল এবং সকাল হল। এভাবে পঞ্চম দিন কেটে গেল।

তারপর ঈশ্বর বললেন, 'নানারকম প্রাণী পৃথিবীতে উৎপন্ন হোক। নানারকম বড় আকারের জন্তু জানোয়ার আর বুকে হেঁটে চলার নানারকম ছোট প্রাণী হোক এবং প্রচুর সংখ্যায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হোক'। তখন যেমন তিনি বললেন সবকিছু সম্পন্ন হল। তারপর ঈশ্বর বললেন, 'এখন এস, আমরা মানুষ সৃষ্টি করি। আমাদের আদলে আমরা মানুষ সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমাদের মত। তারা সমুদ্রের সমস্ত মাছের উপরে আর আকাশের সমস্ত পাখির উপরে কর্তৃত্ব করবে'। তাই ঈশ্বর নিজের মতই মানুষ সৃষ্টি করলেন। ঈশ্বর তাদের পুরুষ ও স্ত্রী রূপে সৃষ্টি করলেন। ঈশ্বর যাকিছু সৃষ্টি করেছেন দেখলেন সবকিছু ভাল হয়েছে। সন্ধ্যা হল তারপর সকাল হল। এভাবে হল ষষ্ট দিন। তারপর সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নিলেন।

(ক্রমশ) 
      
 

ফারহানা রহমান




ললিতা : ভ্লাদিমির নবোকভের জটিল মনস্তত্ত্বের কিংবদন্তী রূপ  



বহুবছর আগে রুশ-মার্কিন উপন্যাসিক ভ্লাডিমির নবোকভের (১৮৯৯-১৯৭৭) বিখ্যাত উপন্যাস ললিতাপড়েছিলাম আর সত্যি বলতে কী কখনই আর সে  উপন্যাসটি ভুলতে পারিনি। ভ্লাদিমির নবোকভের অনবদ্য গদ্যশৈলী  কিংবদন্তীয় রূপ ধারণ করেছিল তার জীবনকালেই। সাহিত্যচর্চার শুরুতে রুশ ভাষায় সাহিত্য রচনা  করলেও পরবর্তীতে তিনি ইংরেজিতে অভিনব গদ্যশৈলীতে উপন্যাস রচনার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেন। এছাড়া লেপিডপ্টেরোলোজিতে (Lepidopterology) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ও দাবাখেলার বিশেষ কিছু চালের সমস্যার সমাধান উদ্ভাবন করেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ললিতাসর্বপ্রথম ১৯৫৫ সালে প্যারিসে, ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়োর্কে এবং  ১৯৫৯ সালে লন্ডনে বের হয়। এটি নাবোকভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে পরিচিত। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর সেরা সাহিত্যকর্ম  হিসেবেও  খ্যাত। প্যারিসে বইটা প্রকাশ হবার পর পরই বিশ্বজোড়া সাড়া পড়ে যায়। তাঁর পেইল ফায়ার (১৯৬২) নামের উপন্যাসটিও বহুল পরিচিত। তিনি যে শব্দ নিয়ে  খেলতে ও খুঁটিনাটি বিস্তারিত বিবর দিতে ভালোবাসতেন সেটা তাঁর এই দুটি উপন্যাস পড়লেই বোদ্ধা পাঠকের বুঝতে আর কোন অসুবিধা হয় না

১৯৬২ ও ১৯৯৭ সালে দুদুবার এই বইটি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়। গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই এক নবযৌবনা কামাক্ষী কিশোরী ললিতাকে যে তার অর্ধনগ্ন শরীর দ্বারা নানা কামাতুর ভঙ্গিমায় তার বিপিতাকে চোখের ভাষাতে হাতছানি দিয়ে তাকে উত্তপ্ত ও উদ্ভ্রান্ত করে তুলছে।
কিন্তু ভেতরের প্রকৃত ছবিটা ছিল ঠিক উলটো। গল্পের নায়ক ফরাসি প্রোফেসর হামবার্ট হামবার্ট একজন ইউরোপীয় সাহিত্যের পণ্ডিত, তিনি তাঁর কিশোর  বয়সে কিশোরী প্রণয়ী এনাব্যালাকে অকালে হারান এবং সম্ভবত সে কারণেই পরবর্তীতে ৯-১৪ বছর বয়সী মেয়ে শিশুদের প্রতি তিনি একধরনের গভীর যৌন  আকর্ষণ বোধ করতে থাকেনপ্রোফেসর হামবার্ট এইবয়সি কিশোরীদের নিমফেট নামে আখ্যায়িত করেন। ভ্লাডিমির নাবোকভ তাঁর এই গল্পটিতে এমন  এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন যা পাঠকের চেতনাকে আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বাধা দেয়।

মাতৃহারা শিশু ললিতার শেষ ভরসা ছিল তার বিপিতা। যার অভিভাবকত্ত্বের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তার নিরাপত্তা। কিন্তু চিরকালের শিকারী পুরুষ, তাঁর নগ্ন ভোগাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্যেই নানারকম নীতিবাক্য উদ্ভাবন   করে এবং পাঠককে তাঁর পক্ষে দাঁড় করিয়ে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার  যথার্থ আয়োজনই করেছিলেন। এবং বলাবাহুল্য, বহুলাংশে সে অভীপ্সা পূরণে  সক্ষমও হয়েছিলেন। ১২ বছর বয়সী ললিতাকে দেখে তার বিপিতা হামবার্ট এতোটাই লোভাতুর হয়ে ওঠেন যে, তিনি ললিতা অর্থাৎ ডলরিজ হেযের বিধবা মা শার্লোট হেযকে বিয়ে করেন, শুধুমাত্র মেয়েটির সংস্পর্শ পাওয়ার আশাতেইপরবর্তীতে ললিতার মার মৃত্যুর পর প্রোফেসর হামবার্ট ললিতার অফিশিয়াল অভিভাবকত্ব লাভ করার দরুন কী নির্মমভাবে তিনি তাঁর লোভাতুর ও কামাতুর   চোখে ভোগের লালায়িত লিপ্সা দিয়ে প্রতিনিয়ত ললিতাকে বলাৎকার করেন,  সেই বর্ণনাই আমরা দেখতে পাই উপন্যাসটি জুড়ে

উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ললিতাযদিও তার প্রকৃত নাম ডলরিস হেজ।  ৩৭-৩৮ বছর বয়স্ক ফরাসি সাহিত্যের প্রফেসর, কবি ও গবেষক ড. হামবার্ট ললিতার সৎ বা বিপিতা। ললিতানামটি তারই দেয়া। হামবার্ট একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। তিনি তাঁর লেখালেখির কাজে অ্যামেরিকার র‍্যামসডেলের ছোট  শহর নিউ ইংল্যান্ডে এসে একটি বাসা ভাড়া নেন। র‍্যামসডেলে এসে হামবার্ট দেখতে পান যে তাঁদের বাড়িটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। সার্বিক অবস্থা  দেখে হামবার্ট দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং নিউ ইংল্যান্ড ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। সেসময় শার্লোট হেয নামক একজন বিধবা মহিলা তাঁকে বিচলিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য হামবার্টকে তার বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য  অনুরোধ করেন। প্রথমে হামবার্ট শার্লোটের অনুরোধ উপেক্ষা করলেও যেই না  তিনি ললিতাকে লক্ষ্য করেন সেমুহূর্তেই তিনি মেয়েটির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং বাসাটি ভাড়া নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন
. হামবার্ট,  যিনি নিমফেটমেয়েদের প্রতি আকর্ষণ  এড়াতে না পেরে নিজেকে  প্রায়ই অসুস্থ বলে সন্দেহ করতেন এবং চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝেই স্যানিটোরিয়ামে যেতেন। তিনিই কিনা আবার একসময় তাঁর কন্যা  সমতুল্য  বিধবা বাড়িওয়ালী শার্লোট হেযের ১২ বছর বয়সি কন্যা ডলরিস হেয বা ললিতার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন, আর এজন্য তিনি সমাজকে পর্যন্ত অস্বীকার করতে দ্বিধা করেন না. হামবার্ট প্রথম দর্শনেই ভীষণভাবে ললিতার প্রতি আকৃষ্ট হনএবং ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ললিতার কাছাকাছি থাকার জন্য। আর সেকারণেই তিনি ছলনার আশ্রয় নিয়ে ললিতার বিধবা মাকে বিয়ে করতেও কিন্তু পিছুপা  হন না। এদিকে ললিতার প্রতি তাঁর দূর্বার আকর্ষণ ও  অসম প্রেম দিনদিন সীমাহীন হয়ে উঠলে বিষয়টি হামবার্ট একসময় তাঁ ব্যক্তিগত ডাইরিতে লিখতে থাকেনডাইরিতে তিনি আরও লেখেন যে তিনি ললিতার মাকে অর্থাৎ শার্লোটকে ভীষণভাবে ঘৃণা করেন, কার তিনি মনে করেন শার্লোট তার ও ললিতার মধ্যকার প্রেমের সম্পর্কে বাধা হিসেবে কাজ করছেতবে সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন ললিতার মা অর্থাৎ  ড. হামবার্টের স্ত্রী শার্লোট হেযের কাছে ডাইরিটা ধরা পড়ে যায় আর শার্লোট ব্যাপারটিকে কিছুতেই মেনে নিতে না পেরে রাগে-দুঃখে-অপমানে ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার পথে বেসামাল অবস্থায় একটি চলন্ত ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে নিহত হন
স্ত্রীর এই মৃত্যুতে হ্যামবার্ট একধরনের স্বস্তিবোধ করেনফলে সামার ক্যাম্প  থেকে তিনি নিজেই ললিতাকে আনতে যান এবং সেখানে তিনি ললিতার বায়োলজিক্যাল পিতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন সামার ক্যাম্প থেকে তিনি ললিতাকে নিয়ে বাসা না ফিরে বরং অ্যামেরিকার বিভিন্নস্থানে নিজেদের পরিচয়  গোপন রেখে ভ্রমণ করতে থাকেন। হামবার্ট  ললিতার কাছে তার মার মৃত্যুর কথা প্রথমে গোপন করলেও পরে একসময় প্রকৃত সত্য স্বীকার করেন
এভাবেই প্রোফেসর হামবার্ট ললিতাকে নিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত সারাদিন ঘুরে বেড়াতে লাগলেনসারাদিন ড্রাইভ করে শেষে রাত হলে কোন হোটেল বা মোটেলে থাকা শুরু করলেন যাতে ললিতা কোনভাবে পালাতে না পারে বা কোনভাবে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে না পারে। এভাবেই একবছর ধরে নানারকম টর্চারের মাধ্যমে তিনি ললিতার উপর কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেনসুযোগ পেয়ে ললিতাও একসময় ক্ল্যার কুইল্টি নামক এক পর্ণগ্রাফির পরিচালকের সাথে পালিয়া যায়। প্রোফেসর হামবার্ট অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ললিতার আর কোন সন্ধ্যান পান না। এদিকে প্রায় দুবছর পর  হামবার্টের কাছে কিছু টাকা চেয়ে ললিতা একটি চিঠি পাঠায়। ১৭ বছর বয়সের বিবাহিত ললিতাকে দেখে তিনি আবারো তার প্রেমে পড়ে যান এবং  ললিতাকে তার সাথে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করতে থাকেনকিন্তু ললিতা আর ফিরে আসে না। এদিকে ললিতার কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানায় গিয়ে হামবার্ট ক্ল্যার কুইল্টকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় খুঁজে বের করে তাকে হত্যা করেন। এরপর তিনি নিজেকে আইনের হাতে সমর্পণ করেন এভাবেই কিছুদিন পর একসময় জেলখানায় করনারি থম্বসিসে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি আত্মজীবনীতে তাঁর সব কথা লিখে যান। এর কয়েকমাস পর ললিতাও একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যায়। হামবার্টের নিজের জবানিতে ললিতাকেন্দ্রিক তাঁর পুরো জীবন-উপাখ্যান তুলে ধরেন।
একজন বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষের কিশোরী বালিকার প্রতি যৌন আকর্ষণকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হলেও এর মূল উপাদান কিন্তু মানবজীবনের নানাবিচিত্র সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে রচিত হয়েছে। নবোকভ তাঁর   অসাধারণ লেখনীতে, প্রতিটি বাক্যে তাঁর উচ্চ রসবোধের চমৎকার ছোঁয়ার  মাধ্যমে সম্পূর্ণ কাহিনীকে এক অসামান্য বোধের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন শিল্প-সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার যে সীমারেখা, তা শিল্পীর তুলিতেই আঁকা হয়,    সাধারণের পক্ষে সেটা কতটুকু গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা শিল্পীর বিবেচ্য বিষয় নয়শিল্পীর কাজ শিল্প সৃষ্টি করা আর  ললিতা নবোকভের এমনই এক অসাধারণ গদ্যশৈলীর উপন্যাস যাকে তিনি এক অভিনব উচ্চ পর্যায়ের শিল্পে পরি করেছিলেন যা গত শতাব্দীতে সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস হিসেবে বিবেচ্য হয়েছিলো। এটিকে একইসাথে একটি আদর্শ মনস্তাত্ত্বিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবেও গ্রহণ করা হয়েছে বলে বোদ্ধা পাঠক মনে করেন
১৮৯৯ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবারগে ভ্লাদিমির নবোকভ জন্মগ্রহন করেন। ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে  ফ্রান্স ও রাশয়ান লিটারেচারের উপর পড়াশোনা শেষ করে তিনি বার্লিন ও প্যারিসে সাহিত্যের উপর তাঁর ক্যারিয়ার  শুরু করেন ১৯৪০ সালে তিনি ইউনাইটেড স্ট্যাটস চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্যারিসের অলিম্পিয়া প্রেস থেকে তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ললিতা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছে  যান এটি যে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস তাতে কারো কোন সন্দেহের অবকা নেইএই একটা বই তাঁকে নিয়ে এসেছে পরিচিতির শীর্ষে ও  সাফল্যের শীর্ষচূড়ায়। দিয়েছে নাম, যশ, অর্থ, খ্যাতি, দুর্নাম সবকিছুই।  নবোকভ প্রথমে ইংরেজিতে ললিতা উপন্যাসটি লেখেন পরে তিনি এটি রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন। টাইম ম্যাগাজিনের লিস্টে ১৯২৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ১০০টি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে ললিতা স্থান  করে নেয়। এছাড়াও ১৯৯৮ সালের মডার্ন লিটারেরি লিস্টে ২০ শতকের চতুর্থস্থান দখল করা উপন্যাস হিসেবে এবং ২০০২এ বুক্লুবেন ওয়ার্ল্ড লিটারেরিতে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সেলিব্রেটি বই হিসেবে ললিতা স্থান করে নেয়।  আর এতকিছুর পর এটি যে একটি অসাধারণ উপন্যাস এতে পাঠকের মনে অন্তত সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।




শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি – 8






"যদি কোনোদিন যাই মেঘের ওপারে
তোমাকেও নেওয়া যেতে পারে।
তারপরে, পথ নেই। ফুটে আছে ফুলের প্রদীপ
তুমি কি পোড়াবে কিছু? জ্বালিয়ে নেবে না সন্ধ্যাদীপ?
আরো কিছুক্ষণ যেতে হবে
পথ বড়ো সংকীর্ণ, কঠোর

তারই মধ্যে যাওয়া এলোমেলো-
বলে, শান্ত, কে এখানে এলো?"

কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু, প্রায় তিনহাজার ফুট পাহাড়ের উপর দুটো ছোট্টো শৈলবসতি। সেল কোম্পানির লোহাখাদান ঘিরে বসবাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে সিংভূমের শেষ। অন্য পারে পাহাড় পেরিয়ে কেঁদুয়াঝাড় জেলা। সারান্ডা অরণ্যের কেন্দ্র এই শিখর শহর দুটি। হো ভাষায় 'সারান্ডা' মানে সাতশো পাহাড়। এটা সাতশো পাহাড়ের দেশ। সঞ্জীবচন্দ্রের দৌলতে ইংরিজি জানা বাঙালির কাছে পলামুর বনজঙ্গল পরিচিতি পেয়েছিলো উনিশ শতকেই। বেতলা, লাতেহার, ছিপাদোহর, মহুয়াডাঁড়, গাড়োয়া, গারু, কুটকু, বড়াসাঁড়, নানা ফরেস্টরেঞ্জ। পূর্বদিকে নেতারহাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মির্জাপুর। উত্তরে হান্টারগঞ্জ, চাতরা থেকে দক্ষিণে গুমলা, সরগুজা। সে তুলনায় বাঙালির কাছে সারান্ডা ছিলো অচেনা। উত্তরে পোড়াহাট আর কোলহান অরণ্য, সারান্ডা জঙ্গলে রেঞ্জ আছে চারটি। সামটা, কোয়না, সসাংদা আর গুয়া, এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ। এইঅরণ্যের হৃদয় দেশে দু'টো বনবাংলা, আজ তারা অতীত, থলকোবাদ আর কুমডি। বড়াজামদার দিক দিয়ে গেলে কিরিবুরু'র কাছে পড়তো কুমডি। আরো পনেরো-কুড়ি কিমি এগিয়ে গিয়ে থলকোবাদের সেই পুরনো বনবাংলা। যা'কে বিভূতিভূষণ চিনিয়েছিলেন বাঙালিদের কাছে। বহুদিন আগে শক্তি আর সন্দীপনকে নিয়ে গিয়েছিলুম কুমডিবাংলায়। তাঁদের রাত জেগে কখনও ঘুম, কখনো নেশা, কখনও পাগলামি, আর এতোল বেতোল প্রমত্ত প্রলাপের অভিনীত অপ্রকৃতস্থতা থেকে উঠে আসা পরবর্তীকালের লেখালেখির বীজ, শুনেছিলুম আমরা। রাতের বেলাও সব জায়গায় কোনওরকম  শব্দদূষণ একেবারে মানা। তাই টেনশন নিয়ে পাহারা দিতে হয়েছিলো রাতভর। কিন্তু সেবার অন্ধকারে হরিণের সবুজ চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি।

এবার অবশ্য অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে যাওয়া। গিট্টি-বালির লরি'র উপর বসে, সতত সতর্ক চোখে নেমে আসা গাছের ডালের দিকে নজর রেখে, আশেপাশের সবুজ অমল'কে খুঁজে যাওয়া এখন রীতিমতো অতীত হয়ে গেছে। রিমার মতো-ই, এখন সে মধুরিমা। পটুয়াদের গোটানো পটখোলা, আবার জড়িয়ে ফেলা, মধ্যলয়ে গেয়ে যাওয়া মনসামঙ্গলের গীতের মতো। পুরনো সময় কখনও খোলে, আবার গুটিয়ে যায় নিজের মতো, বীথোফেনের ফিফথ সিম্ফনি, শব্দহীন, তিনি নিজে যেভাবে তা'কে খুঁজে পেতেন, শুনে যেতেন মনে মনে। আমিও শুনি সেইসব ছবি। সেই কিশোরী, এক পূর্ণানারী, একজনমা, গৃহিনী, কয়েকজন মানুষের বেঁচে থাকার বাতিঘর।
স্তব্ধতা ভাঙি,
- কীরে, অমন মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস কেন?ভালো লাগছে না ?
 -না তো, আমি ভাবলাম তুমি বিরক্ত হয়ে আছো বোধহয়...
-ওফ, শুধরাবি না আর...
-আপেল খাবে?
-দে একটা... তোর ছেলেটা খুব মিষ্টি হয়েছে, ক'বার আসে বছরে?
এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে যে কোনও মা'য়ের মতন। মসৃণ ঝর্ণায় অনর্গল আত্মজের গল্প ঝরে পড়ে। তার একেবারে ইচ্ছে নয়, ছেলেকে অতোদূরে রেখে পড়ায়। কিন্তু এ তল্লাটে তো কোনও ব্যবস্থা নেই। ভালো ইশকুল সেই জামশেদপুর।  সে'ও খুব একটা কাছে নয়। আর সেখানে ভালো হস্টেল পাওয়া যায় না। কুন্তলের এক ভাই দার্জিলিঙে পড়তো। তার ছোটোবেলার স্বপ্ন ছিলো  ঐসব ইশকুল। নিজের হয়নি, ছেলেকে দিয়ে উপরসাধ মেটাচ্ছে।

এতোক্ষণে সে যেন স্বাভাবিকতায় ফিরে এলো। যা'কে চিনতুম, সেই মেয়ে। স্পষ্ট বড়ো হয়েছে, শরীরে, মনে। কাঁঠাল কাঠের চৌকি বদলে এসেছে খাট, কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়াকপাট, এখন অনেক বড়ো হয়েছে...
চুপ করে শুনি তার উচ্ছল জলতরঙ্গের শব্দভাষ। তাকে বলি,
-একটা কথা বলবো?
-নিশ্চয়, বলো...
-নাহ, থাক, আফটারঅল, ইউ আর আ পরস্ত্রী...
-ন্যাকামি করতে হবে না, এসব কবে থেকে শুরু করলে...
-তবে বলি?
-না, বোলো না...
-তবে বলেই ফেলি, কী বল?
এবার সে ভেঙে পড়ে হাসির সেই শব্দে, পিয়ানো'র বাঁদিক থেকে ডানদিকে দ্রুত গড়িয়ে দেওয়া আঙুল থেকে যে ঝংকার বেজে ওঠে, শালপাতায় ঝরে পড়া বৃষ্টির প্রথম পশলার মতো ধ্বনি, শুনতে পাই, বলি,
-তোকে দেখতে খুব সুন্দর হয়ে গেছে...
একটু লজ্জা পায় হয়তো, কিন্তু স্পষ্টতঃ খুশি হয়, তোমার আজ কী হয়েছে?
-না রে, কিছু হয়নি আলাদা করে, ভাবি বলি, তোকে দেখতে গণেশ পাইনের রানির মতো লাগছে...
-তোমার মতলবটা কী বলো তো ?
-আমার তো ওটাই মুশকিল… কখনও কোনও মতলব আঁটতেই পারলুম না…
-এবার আমি তোমায় একটা কথা বলি?
-বল...
-পর্ণা কোথায় আছে?
-ঠিক জানি না রে, ও দেশেই কোথাও হবে...
-খোঁজোনি?
-খুঁজবো কখনও, ইচ্ছে হলে...
-আরো কুড়ি বছর পর?
-তার বেশিও হতে পারে...
-ধ্যুৎ...
--
"ঝড়ে হঠাৎ ভেঙে পড়লো তোমার মুখের জলপ্রপাত
স্মৃতি? নাকি স্মৃতির মতন নিরুদ্বিগ্ন বিষণ্ণতার
একটি করুণ মূর্তি, নাকি ভেঙে পড়লো পূর্ণিমারাত?
বুকের খড়ে মুখটি গোঁজা আধবোজা কোন স্বর্ণলতার
ভ্রূ মধ্যে টিপ সন্ধ্যাপ্রদীপ যদি দেখাও দুয়ারপ্রান্তে
অনেক দূরের একা পথিক – আজো আমায় ডেকে আনতে
তোমার ছেলেবেলার পাশে আর কি আছে সেই তামাশা-
বলো এবং বলো আমার জীবনমরণ ভালোবাসার
ভাষার অধীন, বিপর্যস্ত – স্থাপন করি মুখটি হাতে।"
-----------------------------------

গাড়ি ততোক্ষণে নেমে পৌঁছে গেছে কোয়েল উপত্যকায়। মাঝে মাঝে সমতল, কিন্তু ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই। অরণ্য কখনও ঘন, কখনও ছোটো ছোটো গ্রামের কাছে এসে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। কোন প্রাকইতিহাস কাল থেকে সিংভূমের এই শালের জঙ্গল, পিয়াল, জারুল, আমলকী, বট, কাঁঠাল, সেগুন, মানুষের নির্বাণভূমি হয়ে জেগে আছে , কে জানে? একটা পাকখাওয়া রাস্তার চড়াই উঠে আমরা থলকোবাদ বনবাংলা পৌঁছে যাই। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুধিয়া তামসোয় বেরিয়ে আসে। পিছনে আরো দুজন লোক। কুন্তলের পাঠানো স্কাউট পার্টি। দুজনে নেমে আসি। হাত-পা খেলাই। রোদ বেশ বেড়ে গেছে, কিন্তু হাওয়া ভারি স্নিগ্ধ। টালির ঢালু ছাদের বনবাংলা। সাহেবরা বানিয়ে ছিলো এই রম্য অরণ্য-আবাসটি সেই ১৯০২ সালে। একেবারে কাছে থেকে বন্য জন্তুদের দেখবে বলে। বিভূতিভূষণ এখানেই এসে রাত কাটিয়েছিলেন। তারপর সেই অনন্য জার্নাল, 'থলকোবাদে একরাত্রি'। বাঙালিদের কল্পভ্রমণ মানচিত্রে তখন থেকেই এই জায়গাটা নিজের স্থান করে নিয়েছে। যদিও অতিথিরা আসেন এখানে নিয়মিত ভাবে, কিন্তু বনবিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ যে কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো-ই ম্লান। বুধিয়া একদিন আগে এসে অবস্থা যতোটা শুধরানো যায়, তার ব্যবস্থা করেছে। আমি তো অনেক এসেছি সড়কছাপ লফঙ্গার উদাসীনতা সঙ্গে করে। এবার ব্যতিক্রম হলো। একেবারে সাহেবি অতিথিটাইপ, উন্নাসিক, ধন্য করে দেওয়া চালচলন নিয়ে। হাসি পায়, কিন্তু হাসি না এখন আর।
"আজ আমার সারাদিনই সূর্যাস্ত, লালটিলা – তার ওপর
গড়িয়ে পড়ছে আলখাল্লা-পরা স্মৃতির মেঘ
গড়িয়ে পড়ছে উস্কোখুস্কো ভেড়ার পাল, পিছনে পাঁচন
জলও বা হঠাৎ-ফাটা পাহাড়তলির
কিংবা বৃষ্টি-শেষের রাতে যেমন আসে কবিতার আলুথালু স্বপ্ন,
সোনালি চুল..."

দু'জনকে দুটো পাশাপাশি ঘরের দিকে নিয়ে যায় বুধিয়া, সেই গাঢ় সবুজ রং দরজা জানালা চৌকাঠ। অ্যাজবেস্টসের ফলস সিলিং। নিরাভরন বিছানা, মশারি, জুটের কালীন। নতুন দেখলুম, জানালায় মশার জাল লেগেছে। এতো সরল, ভানহীন আয়োজন; পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মসৃণ মিশে আছে। চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরে আসি। বারান্দায় প্রাতরাশ সাজানো আছে। প্রাতঃকাল তো কখন কেটে গেছে, কিন্তু অল্পস্বল্প খিদে পাচ্ছে এই নির্মল অক্সিজেন আবহে। বেতের কুর্সিতে বসি। রিমাও বেরিয়ে আসে তখনই।
-এতো খাবার?
-খা না যা ইচ্ছে...
-বুধিয়া একটু চা হবে?
-হ্যাঁ ম্যাডাম, এখুনি দেবো?
-দাও, গলাটা ভেজাই... হ্যাঁ, একটাই দাও, ইনি খান না...
-তোর মনে আছে তাহলে...
-আছে, আমার সব মনে থাকে...
-তা বেশ... শোন,  আমার সবকিছু হয়তো মনে থাকে না, কিন্তু তুই একবার একটা কিছু চেয়েছিলি, অনেক অনেকদিন আগে... কিন্তু কখনও নিতে আসিসনি... কিছু মনে আছে তোর?
-হুঁ, আছে, শক্তি... কিন্তু তখন তোমার সময় হয়নি...
-সময়? বোধহয় গিয়েছে চলে ঝুড়িঝুড়ি বছরের পার...
-তবে?
-তবে শোন, এই কবিতাটা, জানি না পড়েছিস কিনা?
-কোনটা?
-অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে...
-পড়েছি...
বারান্দা থেকে নেমে আমরা ঢালের দিকে শালবীথির ছায়ায় এগিয়ে যাই। এখান থেকে অনেক নিচে কারো নদীর বাঁক নিয়ে বনের আরো ভিতরে গড়িয়ে যাবার দৃশ্যটা পরিষ্কার দেখা যায়।

(ক্রমশ)

(সৌজন্য - গুরুচণ্ডালি)