মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি – 8






"যদি কোনোদিন যাই মেঘের ওপারে
তোমাকেও নেওয়া যেতে পারে।
তারপরে, পথ নেই। ফুটে আছে ফুলের প্রদীপ
তুমি কি পোড়াবে কিছু? জ্বালিয়ে নেবে না সন্ধ্যাদীপ?
আরো কিছুক্ষণ যেতে হবে
পথ বড়ো সংকীর্ণ, কঠোর

তারই মধ্যে যাওয়া এলোমেলো-
বলে, শান্ত, কে এখানে এলো?"

কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু, প্রায় তিনহাজার ফুট পাহাড়ের উপর দুটো ছোট্টো শৈলবসতি। সেল কোম্পানির লোহাখাদান ঘিরে বসবাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে সিংভূমের শেষ। অন্য পারে পাহাড় পেরিয়ে কেঁদুয়াঝাড় জেলা। সারান্ডা অরণ্যের কেন্দ্র এই শিখর শহর দুটি। হো ভাষায় 'সারান্ডা' মানে সাতশো পাহাড়। এটা সাতশো পাহাড়ের দেশ। সঞ্জীবচন্দ্রের দৌলতে ইংরিজি জানা বাঙালির কাছে পলামুর বনজঙ্গল পরিচিতি পেয়েছিলো উনিশ শতকেই। বেতলা, লাতেহার, ছিপাদোহর, মহুয়াডাঁড়, গাড়োয়া, গারু, কুটকু, বড়াসাঁড়, নানা ফরেস্টরেঞ্জ। পূর্বদিকে নেতারহাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মির্জাপুর। উত্তরে হান্টারগঞ্জ, চাতরা থেকে দক্ষিণে গুমলা, সরগুজা। সে তুলনায় বাঙালির কাছে সারান্ডা ছিলো অচেনা। উত্তরে পোড়াহাট আর কোলহান অরণ্য, সারান্ডা জঙ্গলে রেঞ্জ আছে চারটি। সামটা, কোয়না, সসাংদা আর গুয়া, এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ। এইঅরণ্যের হৃদয় দেশে দু'টো বনবাংলা, আজ তারা অতীত, থলকোবাদ আর কুমডি। বড়াজামদার দিক দিয়ে গেলে কিরিবুরু'র কাছে পড়তো কুমডি। আরো পনেরো-কুড়ি কিমি এগিয়ে গিয়ে থলকোবাদের সেই পুরনো বনবাংলা। যা'কে বিভূতিভূষণ চিনিয়েছিলেন বাঙালিদের কাছে। বহুদিন আগে শক্তি আর সন্দীপনকে নিয়ে গিয়েছিলুম কুমডিবাংলায়। তাঁদের রাত জেগে কখনও ঘুম, কখনো নেশা, কখনও পাগলামি, আর এতোল বেতোল প্রমত্ত প্রলাপের অভিনীত অপ্রকৃতস্থতা থেকে উঠে আসা পরবর্তীকালের লেখালেখির বীজ, শুনেছিলুম আমরা। রাতের বেলাও সব জায়গায় কোনওরকম  শব্দদূষণ একেবারে মানা। তাই টেনশন নিয়ে পাহারা দিতে হয়েছিলো রাতভর। কিন্তু সেবার অন্ধকারে হরিণের সবুজ চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি।

এবার অবশ্য অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে যাওয়া। গিট্টি-বালির লরি'র উপর বসে, সতত সতর্ক চোখে নেমে আসা গাছের ডালের দিকে নজর রেখে, আশেপাশের সবুজ অমল'কে খুঁজে যাওয়া এখন রীতিমতো অতীত হয়ে গেছে। রিমার মতো-ই, এখন সে মধুরিমা। পটুয়াদের গোটানো পটখোলা, আবার জড়িয়ে ফেলা, মধ্যলয়ে গেয়ে যাওয়া মনসামঙ্গলের গীতের মতো। পুরনো সময় কখনও খোলে, আবার গুটিয়ে যায় নিজের মতো, বীথোফেনের ফিফথ সিম্ফনি, শব্দহীন, তিনি নিজে যেভাবে তা'কে খুঁজে পেতেন, শুনে যেতেন মনে মনে। আমিও শুনি সেইসব ছবি। সেই কিশোরী, এক পূর্ণানারী, একজনমা, গৃহিনী, কয়েকজন মানুষের বেঁচে থাকার বাতিঘর।
স্তব্ধতা ভাঙি,
- কীরে, অমন মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস কেন?ভালো লাগছে না ?
 -না তো, আমি ভাবলাম তুমি বিরক্ত হয়ে আছো বোধহয়...
-ওফ, শুধরাবি না আর...
-আপেল খাবে?
-দে একটা... তোর ছেলেটা খুব মিষ্টি হয়েছে, ক'বার আসে বছরে?
এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে যে কোনও মা'য়ের মতন। মসৃণ ঝর্ণায় অনর্গল আত্মজের গল্প ঝরে পড়ে। তার একেবারে ইচ্ছে নয়, ছেলেকে অতোদূরে রেখে পড়ায়। কিন্তু এ তল্লাটে তো কোনও ব্যবস্থা নেই। ভালো ইশকুল সেই জামশেদপুর।  সে'ও খুব একটা কাছে নয়। আর সেখানে ভালো হস্টেল পাওয়া যায় না। কুন্তলের এক ভাই দার্জিলিঙে পড়তো। তার ছোটোবেলার স্বপ্ন ছিলো  ঐসব ইশকুল। নিজের হয়নি, ছেলেকে দিয়ে উপরসাধ মেটাচ্ছে।

এতোক্ষণে সে যেন স্বাভাবিকতায় ফিরে এলো। যা'কে চিনতুম, সেই মেয়ে। স্পষ্ট বড়ো হয়েছে, শরীরে, মনে। কাঁঠাল কাঠের চৌকি বদলে এসেছে খাট, কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়াকপাট, এখন অনেক বড়ো হয়েছে...
চুপ করে শুনি তার উচ্ছল জলতরঙ্গের শব্দভাষ। তাকে বলি,
-একটা কথা বলবো?
-নিশ্চয়, বলো...
-নাহ, থাক, আফটারঅল, ইউ আর আ পরস্ত্রী...
-ন্যাকামি করতে হবে না, এসব কবে থেকে শুরু করলে...
-তবে বলি?
-না, বোলো না...
-তবে বলেই ফেলি, কী বল?
এবার সে ভেঙে পড়ে হাসির সেই শব্দে, পিয়ানো'র বাঁদিক থেকে ডানদিকে দ্রুত গড়িয়ে দেওয়া আঙুল থেকে যে ঝংকার বেজে ওঠে, শালপাতায় ঝরে পড়া বৃষ্টির প্রথম পশলার মতো ধ্বনি, শুনতে পাই, বলি,
-তোকে দেখতে খুব সুন্দর হয়ে গেছে...
একটু লজ্জা পায় হয়তো, কিন্তু স্পষ্টতঃ খুশি হয়, তোমার আজ কী হয়েছে?
-না রে, কিছু হয়নি আলাদা করে, ভাবি বলি, তোকে দেখতে গণেশ পাইনের রানির মতো লাগছে...
-তোমার মতলবটা কী বলো তো ?
-আমার তো ওটাই মুশকিল… কখনও কোনও মতলব আঁটতেই পারলুম না…
-এবার আমি তোমায় একটা কথা বলি?
-বল...
-পর্ণা কোথায় আছে?
-ঠিক জানি না রে, ও দেশেই কোথাও হবে...
-খোঁজোনি?
-খুঁজবো কখনও, ইচ্ছে হলে...
-আরো কুড়ি বছর পর?
-তার বেশিও হতে পারে...
-ধ্যুৎ...
--
"ঝড়ে হঠাৎ ভেঙে পড়লো তোমার মুখের জলপ্রপাত
স্মৃতি? নাকি স্মৃতির মতন নিরুদ্বিগ্ন বিষণ্ণতার
একটি করুণ মূর্তি, নাকি ভেঙে পড়লো পূর্ণিমারাত?
বুকের খড়ে মুখটি গোঁজা আধবোজা কোন স্বর্ণলতার
ভ্রূ মধ্যে টিপ সন্ধ্যাপ্রদীপ যদি দেখাও দুয়ারপ্রান্তে
অনেক দূরের একা পথিক – আজো আমায় ডেকে আনতে
তোমার ছেলেবেলার পাশে আর কি আছে সেই তামাশা-
বলো এবং বলো আমার জীবনমরণ ভালোবাসার
ভাষার অধীন, বিপর্যস্ত – স্থাপন করি মুখটি হাতে।"
-----------------------------------

গাড়ি ততোক্ষণে নেমে পৌঁছে গেছে কোয়েল উপত্যকায়। মাঝে মাঝে সমতল, কিন্তু ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই। অরণ্য কখনও ঘন, কখনও ছোটো ছোটো গ্রামের কাছে এসে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। কোন প্রাকইতিহাস কাল থেকে সিংভূমের এই শালের জঙ্গল, পিয়াল, জারুল, আমলকী, বট, কাঁঠাল, সেগুন, মানুষের নির্বাণভূমি হয়ে জেগে আছে , কে জানে? একটা পাকখাওয়া রাস্তার চড়াই উঠে আমরা থলকোবাদ বনবাংলা পৌঁছে যাই। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুধিয়া তামসোয় বেরিয়ে আসে। পিছনে আরো দুজন লোক। কুন্তলের পাঠানো স্কাউট পার্টি। দুজনে নেমে আসি। হাত-পা খেলাই। রোদ বেশ বেড়ে গেছে, কিন্তু হাওয়া ভারি স্নিগ্ধ। টালির ঢালু ছাদের বনবাংলা। সাহেবরা বানিয়ে ছিলো এই রম্য অরণ্য-আবাসটি সেই ১৯০২ সালে। একেবারে কাছে থেকে বন্য জন্তুদের দেখবে বলে। বিভূতিভূষণ এখানেই এসে রাত কাটিয়েছিলেন। তারপর সেই অনন্য জার্নাল, 'থলকোবাদে একরাত্রি'। বাঙালিদের কল্পভ্রমণ মানচিত্রে তখন থেকেই এই জায়গাটা নিজের স্থান করে নিয়েছে। যদিও অতিথিরা আসেন এখানে নিয়মিত ভাবে, কিন্তু বনবিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ যে কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো-ই ম্লান। বুধিয়া একদিন আগে এসে অবস্থা যতোটা শুধরানো যায়, তার ব্যবস্থা করেছে। আমি তো অনেক এসেছি সড়কছাপ লফঙ্গার উদাসীনতা সঙ্গে করে। এবার ব্যতিক্রম হলো। একেবারে সাহেবি অতিথিটাইপ, উন্নাসিক, ধন্য করে দেওয়া চালচলন নিয়ে। হাসি পায়, কিন্তু হাসি না এখন আর।
"আজ আমার সারাদিনই সূর্যাস্ত, লালটিলা – তার ওপর
গড়িয়ে পড়ছে আলখাল্লা-পরা স্মৃতির মেঘ
গড়িয়ে পড়ছে উস্কোখুস্কো ভেড়ার পাল, পিছনে পাঁচন
জলও বা হঠাৎ-ফাটা পাহাড়তলির
কিংবা বৃষ্টি-শেষের রাতে যেমন আসে কবিতার আলুথালু স্বপ্ন,
সোনালি চুল..."

দু'জনকে দুটো পাশাপাশি ঘরের দিকে নিয়ে যায় বুধিয়া, সেই গাঢ় সবুজ রং দরজা জানালা চৌকাঠ। অ্যাজবেস্টসের ফলস সিলিং। নিরাভরন বিছানা, মশারি, জুটের কালীন। নতুন দেখলুম, জানালায় মশার জাল লেগেছে। এতো সরল, ভানহীন আয়োজন; পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মসৃণ মিশে আছে। চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরে আসি। বারান্দায় প্রাতরাশ সাজানো আছে। প্রাতঃকাল তো কখন কেটে গেছে, কিন্তু অল্পস্বল্প খিদে পাচ্ছে এই নির্মল অক্সিজেন আবহে। বেতের কুর্সিতে বসি। রিমাও বেরিয়ে আসে তখনই।
-এতো খাবার?
-খা না যা ইচ্ছে...
-বুধিয়া একটু চা হবে?
-হ্যাঁ ম্যাডাম, এখুনি দেবো?
-দাও, গলাটা ভেজাই... হ্যাঁ, একটাই দাও, ইনি খান না...
-তোর মনে আছে তাহলে...
-আছে, আমার সব মনে থাকে...
-তা বেশ... শোন,  আমার সবকিছু হয়তো মনে থাকে না, কিন্তু তুই একবার একটা কিছু চেয়েছিলি, অনেক অনেকদিন আগে... কিন্তু কখনও নিতে আসিসনি... কিছু মনে আছে তোর?
-হুঁ, আছে, শক্তি... কিন্তু তখন তোমার সময় হয়নি...
-সময়? বোধহয় গিয়েছে চলে ঝুড়িঝুড়ি বছরের পার...
-তবে?
-তবে শোন, এই কবিতাটা, জানি না পড়েছিস কিনা?
-কোনটা?
-অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে...
-পড়েছি...
বারান্দা থেকে নেমে আমরা ঢালের দিকে শালবীথির ছায়ায় এগিয়ে যাই। এখান থেকে অনেক নিচে কারো নদীর বাঁক নিয়ে বনের আরো ভিতরে গড়িয়ে যাবার দৃশ্যটা পরিষ্কার দেখা যায়।

(ক্রমশ)

(সৌজন্য - গুরুচণ্ডালি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন