জরাসন্ধ
আর গণেশ পাইনের রানি - ৭
"...তোমার
হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
এ
কথা কি খুশি করে মন?
এ
কথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয়
বসন্ত বাতাসে!
দুলে
ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা
গেলো – বুকে রক্তপাত
বাগানে
কি ধরেছিলে হাত
বাগানে
কি ধরেছিলে হাত? "
দফতরে
বসে মাথা গুঁজে দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটছিলুম। পার্থ বলে, দ্যাখো, কে এসেছে? দেখি কুন্তল
হাসিমুখে সামনে এসে বসলেন।
-শুনুন
থলকোবাদ ফরেস্টবাংলো বুক হয়ে গেছে শুককুরবার রাতের জন্য। পার্থ বলছে আপনি বৃহস্পতির
মধ্যে এখানে গুটিয়ে নেবেন। আমরা শুককুরসকালে বেরোবো, এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে রাতে ওখানে
থাকা। পরদিন সকালে আরামসে উঠে ফিরে আসবো। এগ্রিড?
-পার্থ,
তুমি যাবে?
-আরে
না, আমার ফুরসত নেই, তোমরা যাও...
-ঠিক
আছে, থ্যাংকস...
-আজ
আসি, এরমধ্যে একদিন আসুন না!
-যাওয়া
যেতো... আজ খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে, সময় পাচ্ছি না...
-ঠিক
আছে, বৃহস্পতিবার আমি একবার এসে বাকি ডিটেলসগুলো পাকা করে নেবো, আসি...
কুন্তল
চলে যা'ন।
তাড়াহুড়ো
করে কাজ শেষ করে নিচ্ছিলুম সেদিন। রিপোর্টটাকে একটা মোটামুটি জায়গায় আনতে হবে। সংখ্যাতত্ত্বের চাপে বেশ ত্রাহি মধুসূদন
অবস্থা। যে কোনো ব্রাঞ্চ ক্লোজ করার সময় এই চাপটা থাকে।
-নমস্কার!
দেখি
কুন্তল দাঁড়িয়ে আছেন। বলি, বসুন; আর একটুক্ষণ লাগবে, শেষ হয়ে এলো...
কিন্তু
তিনি বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়েই রয়েছেন,
একটু
অবাক হই, কিছু ঘটলো নাকি ?
-একটা
মুশকিল হয়ে গেছে, আজ রাতে আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে...
-বেশ
তো, তাতে কী হয়েছে ?
-নাহ,
আমি কাল যেতে পারবো না। আজ রাতেই আমাকে কলকাতা বেরিয়ে যেতে হবে, কাল ওখান থেকে দিল্লির
ফ্লাইট...
-জরুরি
কাজ নিশ্চয়...
-অত্যন্ত,
মার্চ মাসেই আমাদের পরের বছরের বাজেট অ্যালোকেশনটা করিয়ে নিতে হয়... ভেবেছিলুম ডাকটা
পরের সপ্তাহে আসবে, কিন্তু...
-কিন্তু
কীসের?
-থলকোবাদ...!
-ধ্যুৎ
মশাই, ওটা কি আর কোনো ব্যাপার হলো...? নিশ্চিন্তে যান। পরেরবার আসবো যখন, তখন হবে...
-ওটাই
তো বলতে এলুম, আপনি কালই যাবেন... আমার লোক চলে গেছে ওখানে... সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে...
শুধু আমি যেতে পারছি না... যা তা ব্যাপার...
-
না না, আমি একা একা গিয়ে আর কী করবো, বহুবার গেছি, পরে যাবো না হয় আপনাদের সঙ্গে...
-একা
কেন যাবেন? রিমা যাবে তো...
-তো...
-আপনিও
যাবেন...
-পাগল
হলেন নাকি?
তারপর
অনেকটা সময় ধরে চললো একটা অসম্ভব রকমের দরাদরি। এভাবে তো যাওয়া যায় না। পূর্ব পরিচিতি
অনেক ধূসর হয়ে গেছে কালের ধুলো সরে। তার উপর রাতে থাকার একটা ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু
অনুভব করি এই ঘটনাক্রমটি ইতোমধ্যেই নিঃশব্দে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যাবতীয়
সংলাপ বৃথা এবং সদিচ্ছা বাহুল্য বোধ হচ্ছে। পার্থ'কে আরো একবার যেতে অনুরোধ করি, লাভ
হয় না। এতো দ্বিধা নিয়ে তো আমি দেবমন্দিরেও যাই না। অসহায় লাগে...
"...একপ্রান্তে
জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য
দুদিকেই
কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন -
দুটো
জন্মই লাগে
মনে
মনে দুটো জন্মই লাগে।..."
----------------------------------------------
"...যেতে-যেতে
ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন
তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে
থাকলে নিরাত্মীয়; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে
পড়বার জন্য? হবেও বা। স্বাধীনতাপ্রিয়
ব'লে
কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি..."
সমস্ত
সুন্দরেরই একটা নির্মাণ থাকে। তা'কে গড়ে উঠতে হয়। কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দকে
পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, তিনি শুধু কবিতাই লেখেন। কবিতা ছাড়া
আর কিছু লেখেন না। এই 'শুধু কবিতা লেখা' বলতে বুদ্ধদেব কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? জীবনানন্দ
বিহান যামিনী কেবল কবিতার 'ঘোরে' থাকেন। তাঁর সব চিন্তা, সব কাজ, প্রার্থনার সকল সময়,
শুধু কবিতার ভাষাতেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে? বুদ্ধদেবের মতো বাংলাভাষার একজন ধীমান মনস্বী
কি তবে সত্যিই বিশ্বাস করতেন কবিতায় শ্রমের স্থান নেই। জানি, দেশে-বিদেশে অনেক মনস্বীই
সেরকম ভেবে থাকেন। কবিতাট্র্যান্স থেকে, ঘোর থেকে উঠে আসা স্বয়ম্ভূ ব্যক্তিগত উচ্চারণ
শুধু। কিন্তু যখন তা মুদ্রিত অক্ষরে লক্ষ মানুষের দরবারে গিয়ে পড়ে, তখন তার অবস্থান
কী হবে? এই মোড়টিতে এসে বহু জিজ্ঞাসু থমকে যা'ন। পাঠক কি কবির জুতোয় সমান মসৃণতায় স্বচ্ছন্দ
হয়ে থাকতে পারেন? স্পর্শ করতে পারেন কবির সব অভিমান। নয়তো তাঁর কাছে কবি নিজের পসরা নিয়ে যা'ন কেন?
বুদ্ধদেব
জীবিত থাকতে যদি ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের সব পান্ডুলিপির খাতা উদ্ধার করতে পারতেন,
তবে বুদ্ধদেব কি নতুন ভাবতে পারতেন 'ঘোর' আর শুদ্ধ সচেতন 'শ্রম' ব্যবহার করে জীবনানন্দ
কেউ কেউ 'কবি'দের মধ্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। যে জীবনানন্দ ছাত্রপাঠ্য 'ইতিহাস চেতনার
কবি' ন'ন, ন'ন 'অবক্ষয়ের প্রতীক' পদ্যকার, তিনি কে? কৃতার্থ পাঠকের কাছে তাঁর সৃষ্টির
স্বরূপটি কী হতে পারে?
প্রতীক,
রূপক, কিংবদন্তি, মিথস্ক্রিয়া, জীবনানন্দের সবকিছুই ছিলো একটু অন্যরকম। যদি কবিতার
আত্মার কথা ভাবি, তবে তিনি একজন ইংরেজ। কিন্তু কবিতার শরীর বাঙালি মেয়ের মতো। আর্দ্র,
শ্যামল, নমনীয়, অলংকৃত, রহস্যময়। শক্তি নিজের কবিতায় জীবনানন্দের কাব্যশরীর'টিকে নিজের
মতো করে গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাঁর পদ্যে জীবনানন্দের উপস্থিতি বড্ডো প্রত্যক্ষ। কিন্তু
শক্তির অনুভবের জগৎটি রবীন্দ্রনাথের বেশি কাছাকাছি। অতোদিন আগে যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন,
"আমি শুধু ঐ বুড়োটার চ্যালা", তখন আমারও বেশ বিস্ময় লেগেছিলো। জীবনানন্দের
সঙ্গে শক্তি'কে, সমর সেনের সঙ্গে সুনীল'কে যুক্ত করে বিচার করার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিলো।
তার কিছু রেশ এখনও রয়েছে।
শক্তি
কবিতা'র ক্ষেত্রে শ্রম স্বীকার করার পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন "অনুশীলন করে প্রথমে ছন্দোবদ্ধ লেখা তৈরি করা
কবিতা রচনার প্রথম ধাপ।" কবি যশোপ্রার্থীদের জন্য তাঁর নির্দেশ ছিলো " অনুশীলনকামী
মাত্রের প্রতি আমার সাদর নির্দেশ হলো- অন্তত একশোটা সনেট লিখুন। তারপর নিজের পথ চোখের
সামনে খুলে যাবে।" প্রথম জীবনে তাঁর অনুশীলন পর্বে প্রচুর সনেট লিখেছিলেন। তাঁর
প্রথম প্রকাশিত কবিতাটি একটি সনেট, 'যম’, যে'টি
'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি এই কবিতাটিকে প্রত্যাখ্যান
করেছিলেন, "ওটি বাজে পদ্য" এই অভিযোগে। কোনও কাব্যগ্রন্থে সংকলিতও করেননি।
কিন্তু
এতোদিন ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস করে মনে হয়, বাংলা কবিতায় স্বভাব, মেজাজ, শরীর ও আত্মার
নিরিখে জীবনানন্দের প্রধান উত্তরাধিকারী এক ও অদ্বিতীয়, বিনয় মজুমদার। শক্তি সে অর্থে
উত্তরাধিকারী ন'ন, অধমর্ণ বলা যেতে পারে। অবশ্য তাতে শক্তির কোনও গৌরবহানি হয় না, অথবা
বিনয়ের গরিমার প্রশ্নে কোনও সংশয় নেই।
----------------------------------------------
"...সুখের
বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের
বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক
কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু
ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির।
ঝড়
মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদলা হাওয়া নয়
ক্রন্দন
রঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার..."
রোদ
ক্রমে আসিতেছে। সকালে ঠিক সাতটা নাগাদ ফোন এলো রিসেপশন থেকে। গাড়ি এসে গেছে। নেমে আসি
সামনের গাড়িবারান্দায়। কালো বন্ধ জীপগাড়ি। খোলা জীপে ধুলোয় লাল হয়ে যেতে হয়। ড্রাইভার
গাড়ির দরজাটা খুলে দেয়। উঠতে গিয়ে দেখি রিমা অন্যদিকের জানালার ধারে বসে।
-গুডমর্নিং...
সে
ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো একটা টিপের দিকে, তার কপালে, লাল টুকটুকে। আমি রিমাকে সিঁদুরের
টিপ পরে কখনও দেখিনি। সকালের আলো ধন্য হলো ঐ রংটাকে বিশ্বস্তভাবে ধরতে পেয়ে।
-দারুউউণ...
-কী...
-টিপ...
-মানে?
-কিছু
না...
গাড়ি
ড্রাইভওয়ে ধরে রাস্তায় নেমে এলো।
-
শুনলাম তুমি নাকি আসতে চাইছিলে না!
-না
না, ঠিক তা না; সবচেয়ে উৎসাহী ব্যক্তিটি যদি আটকে যান, তবে… মানে স্ফূর্তিটা একটু নিভে যায় তো...
-ওহ,
আমি ভাবলাম অন্য কোনও কারণ রয়েছে...
-তুই
খুব ভাবিস, না?
-কেন?
আমাদের কি ভাবতেও মানা?
-ঝগড়া
করার মতলব আছে নাকি রে?
-নাহ,
সেটাও তো মানা...
-বোঝো...
তবে বহুবচনটা, মানে 'আমাদের', ইহার ব্যাখ্যা বলহ...
-'আমাদের'
মানে, যাদের পর্ণার মতো এলেম নেই, লেসার মর্ট্যালস...
এবার
আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, রিমা মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
"যাবো
না আর ঘরের মধ্যে
অই
কপালে কী পরেছো
যাবো
না আর ঘরে
সব
শেষের তারা মিলালো
আকাশ
খুঁজে তাকে পাবে না
ধরে-বেঁধে
নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না
বালক
আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
কখন
যেন পরে?
সবার
বয়স হয়
আমার
বালক-বয়স
বাড়ে না কেন
চতুর্দিক
সহজ শান্ত
হৃদয়
কেন স্রোতসফেন
মুখচ্ছবি
সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
অচেনা,
কিছু
চেনাও চিরতরে।"
(ক্রমশ)
(সৌজন্য
- গুরুচণ্ডালি)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন