বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়




বসন্ত যে রঙিন বেশে ধরায় সেদিন অবতীর্ণ




বইমেলায় এবার আমি মাত্র একদিন গিয়েছি। তাও যে খুব মন চেয়েছিল তা নয়। কিছুটা জোর করে, বন্ধুর আন্তরিক আমন্ত্রণেই গিয়েছিলাম। কবি বন্ধুদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি সম্মানিত। ব্যাস, এই পর্যন্তই। 

না, বইমেলা নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই নেতি নেতি কথা দিয়ে শুরু করে দিলাম। অনেকেরই ভালো লাগবে না ‌। কথাও নয়। কিন্তু কী করি? আমি নাচার।
আমার সত্যি বইমেলায় যেতে ভালো লাগে না। অশিক্ষিত, বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন মনে হলে হোক। বইমেলায় চেয়ে আরো সারা বছর ধরে যেসব মেলা হয়, সে বরং ঢের ভালো। দূর দূর থেকে শিল্পীরা তাদের হাতে তৈরি সামগ্রী নিয়ে আসে, মুগ্ধ হয়ে কিনি, গ্রামের দিকে মেলায় বনবন করে নাগরদোলা চড়ি, আচার খাই, একনাগাড়ে ভেঁপুর আওয়াজ শুনতে শুনতে ফিরি। এর এক নিজস্বতা আছে। যা ভিতরে তাই বাইরে। 

আমরা যে পথ ধরেছি সেখানে মন আর মুখ এক থাকছে না। অনেকটাই দূরত্ব মন আর মুখের মধ্যে। সত্যি বলতে কি, ইদানিং বইমেলায় গেলে এই অনুভূতিটাই বেশি করে হয়। আর যত এটা হয়, আরও বেশি করে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। না, ভৌগলিক স্মৃতিচারণ নয়। ময়দানে কি ছিল, মিলন মেলা কেমন ছিল, সল্টলেক কতটা আলাদা, কিচ্ছু এসে যায় না তাতে। আসল হল অন্তরে তুমি কত বদলেছো বইমেলা! অনেকটাই। বদলে গেছে বই ? না। বদলে গেছে শুধু মানুষ। মেলার মানুষ আর মেলা মানুষের যেখানে তফাৎ সেখানেই হঠাৎ করে মনে হয়, কিছু নেই, সব কেমন ফাঁকা, অন্তঃসারশূন্য। 

অনেকে দেখি বলছেন, বইমেলায় বই কেনার চেয়ে খাবার কেনার বেশি হুজুগ। 
আমি মনে করি, বেশ করবে খাবে। কেন খাবে না? মেলার মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে এটা ওটা মুখে চালান করতে করতে কলেজ বেলার অকারণ তর্কগুলো খুব মনে পড়ে। আজ যেগুলো অকারণ মনে হচ্ছে, তখন সেগুলো নিয়ে কী ভয়ানক সিরিয়াস। হাওয়ায় ধুলো মাখা। সন্ধ্যের পর চোখ ঝাপসা। মেলায় ফিরতি ভিড়ের টান। তখনো মনে হায় হায়। এটা কেনা হল না, ঐ স্টলে যাওয়া হল না। পকেট ঢু ঢু। মনে মনে প্রতিজ্ঞা, কাল আরও তাড়াতাড়ি আসবো। মাত্র ক’টাদিন। দেখতে দেখতে চলে যাবে। গান বাজে, আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা। পায়ে পায়ে ধুলো পথে হাঁটছেন শংকর, ঐ যে নীললোহিত, জয় গোস্বামী, বুদ্ধদেব গুহ। 

বইমেলায় বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার এক মজা, বাবার সঙ্গে যাওয়ার আরেক মজা।  বাবা সঙ্গে থাকলে আবার কিনা পকেটের চিন্তা নেই। একবাক্স রবীন্দ্র রচনাবলী কিনে শিয়ালদায় লোকাল ট্রেনে উঠেছি। দুজন মিলে হাঁস ফাঁস করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। বইগুলোর গায়ে বাবার গন্ধ এখনো লেগে আছে। কলেজের প্রফেসর ভয়ঙ্কর পড়ুয়া  মাসীর সঙ্গে আবার মেলায় গেলে ‘বোরে’র একশেষ। সে  সব মাথাভারি স্টলে ঢুকবে আর ধ্যানস্থ হয়ে যাবে। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পা যায় যায়। কিছু খাওয়াবেও না।  শুধু কঠিন কঠিন কথা বলে যাবে। 

হিংসুটেমি, খুনসুটিও কি কম? 
ওমাআআআ! এই বইটা তুই কোথায় পেলি?
বন্ধুবর মুখ টিপে বসে থাকে। কিছুতেই ফাঁস করবে না। 
একবার দে না! পড়েই ফেরত।
তারপর সে সেই যে গেল, গেল তো গেল। 
তৌহিদ আমার ‘ন হন্যতে’ আজো ফেরত দেয়নি। 

না বাবা, আমার মেলার আনন্দ চাই। গোল করে ভিড় করে প্রতুলদা গেয়ে ওঠেন, আমি বাংলায় গান গাই। সবাই হাততালি দিয়ে সঙ্গত করি। সামনে একুশে। বসন্ত যে রঙিন বেশে ধরায় সেদিন অবতীর্ণ! লিটল ম্যাগাজিন স্টল  ঘুরে, বড় বড় নামকরা স্টল দেখে তারপর আনাচকানাচ। একটা  অলিখিত কম্পিটিশন চলত। কে কত রেয়ার বই খুঁজে বের করবে। তারপর শুধু বিস্ময় বিস্ময় আর বিস্ময়...


একবার মমার্ত থেকে লেখা পাঠ করার ডাক এলো। তখন আবার বিয়ে হয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠান। আমি সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন  লাইব্রেরির সঙ্গে বহুদিন যুক্ত। এমফিল-এর পড়াশোনা চলছে। কল্লোলদা বললেন, তোমার লেখা পড়ো। নতুন বর চলেছে সঙ্গে। কী লজ্জার কথা। কোনোমতে ঝরঝর করে পড়ে নিয়েই স্টেজ থেকে ঝাঁপ। 

একটাও ছবি নেই সেসব দিনের। মোবাইল ফোন ছিল? ছিল না। ক্যামেরা তো  ছিলই। একেবারের জন্য মনে হয়নি নীললোহিতকে পাকড়াও করে একখানা ছবি তুলি। মমার্তের স্টেজে দাঁড়িয়ে কিছু পোজ দিই। নীললোহিত একটা বুকলিস্ট-এর পিছনে লিখে দিলেন, "প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাকে..." অটোগ্রাফ তো চেয়ে  ফেলেছি। সঙ্গে না কাগজ না কলম। 
এমনই ছিলাম আমরা। এক একটা খাঁটি আবেগ। আমার বইমেলা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যুগের হিসেব নিয়ে। বইমেলা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে এখনো চোখে ভাসে ধুলো ধুলো সন্ধ্যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গান। 

এখন বইমেলায় বই আছে। আর কিছু নেই। শুনে হয়তো বলবেন, বইমেলা তো বই-এরই! হ্যাঁ, বই তো থাকবেই। সে তো কলেজ স্ট্রিট-এও আছে। আমাদের  একজন স্যার শিখিয়েছিলেন, বইমেলা ঘুরে ঘুরে যত পারবে বুকলিস্ট যোগাড় করবে। আজও যতটুকু যাই, বই-এর খবর পেতেই যাই। খুঁজে খুঁজে তেলচিটে  পোকা ধরা পুরনো বই বের করি, যার ঐ একটি মাত্র কপি। 

কিন্তু বাদবাকি পরিবেশ কোথায়? এত আত্মকেন্দ্রিক বইমেলা আগে কখনও দেখিনি। সবাই বলছে, আমায় দেখো, আমার বই কেনো, আমার সঙ্গে ছবি তোলো, আমার প্রচার করো... আমি আমি আমি...
‘আমি’ আছে কিন্তু ‘তুমি’ নেই। পারস্পরিক সম্মান নেই। সবাই সবাইকে দেখছে  আড়চোখে। কে কতটা এগোলো, কতটা পিছোলো, কে কোন পথ অবলম্বন করল, কার ডাকে কতজন সেলেব এলেন, তারসঙ্গে বুটিকের শাড়ি, ব্যাগ, গয়নার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি... 
‘আজি’ নয়, ‘আমি’ই এই আনন্দসন্ধ্যা। 

সেলিব্রিটি শিকারে যান কেউ কেউ। একমাত্র উদ্দেশ্য তাঁদের সঙ্গে সেলফি নেওয়া। কে কার লেখা পড়ছে তার চেয়ে কে কত কিনছে, তার হিসেব বেশি।  আমি সত্যি ভয়ে ভয়ে থাকি।  পকেট তো চিরকালই ঢু ঢু। তারপর যখন লেখক কাম বিক্রেতারা আক্রমণ করেন, ভারি বিপন্ন বোধ করি। 

বইমেলায় বই আছে, মেলা নেই।  মেলা মানে ডানা মেলবার স্বাধীনতা। আমার সেই স্বাধীনতাই অবর্ষিত। ভয়ে ভয়ে চলি। এই বুঝি কেউ খপ করে পাকড়াও করেন। আমার আর সেই শেষ কপির বইগুলোর খোঁজ নেওয়া হয় না। নানা কাজের ফাঁকে কোনোমতে সময় বের করে বইমেলার জন্য রাখি। উদ্বৃত্ত তেমন নেই। তাই আর ভালো লাগে না। যেতে হয়।  যেতে পারি। কিন্তু কেন যাব, বুঝতে পারি না আজকাল।

সেদিন সন্ধে উৎরে ফিরছি। এক যুগল হুস হুস করে ঝালমুড়ি খেয়ে ভারি  বেকায়দায়। চারপাশের জগত সংসার তখন কিছু নেই। এক অদৃশ্য আলোর বৃত্ত তাদের ঘিরে। 
এ বরং বেশ। বই তো খোলা আকাশের নাম। মেলাও তাই। প্রেমও...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন