শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

ঝর্না বিশ্বাস


প্রাক্তন এক ছাত্রীকে, মাস্টারমশাই

প্রথম যেদিন তোদের বাড়ি গেলাম
মোটেই ভালো লাগেনি...
টেনেটুনে পাশ... বাংলায় চরম অনীহা
এগুলো শোনার পরও শুধুমাত্র
তোর বাবার কথা রাখতে চলে এলাম।

তোর বাবা বড় ভালো মানুষ
জানতেন, মেয়েকে শিখিয়ে পড়িয়ে
মানুষ করতে হলে, একজন ঘরোয়া মাস্টার দরকার
নইলে মেয়ে তো যা উড়াল পাখি
ফুরুত হইল বলে...

আপনি আপনি, তুমি তুমিতে
তুই যখন গোঙাচ্ছিস...
বুঝেছিলাম সেদিনই...
কিচ্ছুটি হবে না তোর... কবিতা তো দূরে থাক
ছোট্ট এক চিরকুট... তাও তোর কম্ম নয়...
ভাব সম্প্রসারণে তাই রোজ হোঁচট খেতিস
আর তোর বোন একপাতা লিখে আমায় দেখাত।

পড়াতে যেতে প্রায়ই রাত হতো আমার
একে তো সাইকেল, চেন পড়ত মাঝ রাস্তায়...
তারপর বাকি দিনের ধকল
ছাত্র পড়িয়ে ঘর চলত তখন -
সবে বিয়ে করেছি, শাশুড়ির চরম আবদার
মেনে, রঙীন টিভি চাই

একদিন তাই তোর বাবাকে বললাম,
মাইনে বাড়ান কুন্ডুবাবু...
আমার আমতা আমতা বাক্য-
তোর বাবা খপ করে ধরে ফেলত,
তাই পকেট ভরতে কোনও দিনই অসুবিধে হয়নি

শুধু তোকে সিধে করতে হবে ভাবতেই
তোর বন্ধুকে পড়ানো শুরু করলাম।
জব্দ হলি সেদিনই...
ওর চাইতে ভালো... ওর চাইতে বেশি
আরো বেশি পাবার আশায়
তোর খাতার পাতা ফরফরিয়ে লিখিয়ে নিত সব -
আর আমি মাস্টার হয়ে খুশি হতাম...
ভালো নম্বর আসবে।

এসেওছিল ... তবে প্রত্যাশিত নয়
তোকে আরও ভালো বানানোর চেষ্টায় উপহারে
দেওয়া বইটা যখন নিলি
ততদিনে পর হয়ে গেছিস এ বাড়ির...
তাই একবার তাকিয়েও দেখলি না পুরনো মাস্টার
জিজ্ঞেসও করলি না
কেমন আছি আমি...

এখন বিজ্ঞানের যুগ...
কম্পিউটারে সোলেমন লিপি
ঝরঝরিয়ে বাংলা করে দেয়...
কিন্তু সেই ভাব... ভাব আনবি কোত্থেকে...
তার জন্য চাই বইয়ের নেশা আর
একান্ত অধ্যাবসায়...

আমি বড় প্রাচীন, মানছি
হয়তো দেখলে এখন চিনতেও পারবি না...
তবু দূরে থাকা এই বাংলা মাস্টারের একটা কথা মনে রাখিস
কবিতাকে ভালোবাসতে হলে
অনেকটা সময় ওতেই কাটাতে হবে
একটানা এত ঝক্কি নিতে
পারবি তো!


প্রিয়পাখি

ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান খাতায় তোমায় নিয়ে পেনসিলের সেই প্রথম আঁচড়...  তারপর তোমার চেহারা,
 কাঠামো সব দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে কী নির্মম পরিনতি!   চলছে তো চলছেই... টুঁ শব্দটি
না করে সাদা পাতায় তোমার চুপচাপ বসে থাকা, আমায় ধীরতা শেখালো... শেখালো সবেতে
হুল্লোড় নয়... অভ্যেস হয়ে যাবে।
প্রথম সেদিনই বুঝলাম
 “আমি আছি” – জানান দিতে আওয়াজ করতে হয় না...

সেই তখন থেকেই আমার খাতায় তোমার পা দোলানো শুরু...
বেবিদি দেখে বললেন...
সাব্বাস... এই তো পেরেছিস... এবার একে ওড়া শেখা?
আমিও গাড়ির ছাওনি থেকে তোমায় সোজা টেনে নিয়ে গেলাম অন্দরমহলে... যেখানে এক ছেলে ও এক মেয়ের কবিতা জুড়ে শুধু তুমি... আমার ময়নামতী গল্পের হবু ডাক্তার তখনওস্থিতু হয়নি...
ফাইল নিয়ে দৌঁড়চ্ছে, এক্লাস থেকে বারান্দা... তুমি নিশ্চুপে দেখেছ সবার
ওঠাপড়া... সহ্য করেছ সব...

তোমাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনার সময় এক আশ্চর্য অধিকারবোধ ছিল...
তাই আজ
“ওড়া শেখাও-ওড়া শেখাও”... শুধু তোমাকেই বলা যায়...

আমার জন্য এই নীচেই এক আকাশ করে রেখেছ তুমি... যেখানে কোলাহল নেই,
 তবে ইচ্ছে হলে হাত মেলতে পারো...মেলাতেও পারো...
আশকারা পেয়ে বসল সেদিনই... কথায়-গল্পে,
 ভালো থাকায়  ভালো না লাগায়, তোমাকে নিয়ে আমার গভীর টান...এখনও একইভাবে চলছে।

আমার সকল অবসরে তোমাকে মেলাই... শরীরের ধুসর রঙ,
 গলার চিকচিকি... ডানার ভাঁজ
খুলি পরতে পরতে...
আর তোমার সকল বকম কখন যে মিলে সপ্তসুর হয়ে যায় বুঝতেই পারি না...

সামনের গ্রীল ছুঁয়ে আজও তোমার উপস্থিতি আমাকে ভালো বাঁচতে শেখায়...
ও বলে, এত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হয় না...
আজই পৃথিবীর সেই সুন্দরতম দিন... আবার প্রথম থেকে শুরু করো...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন