শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

শিবাংশু দে


জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি - ৬








‘...পুরাতন বইগুলি রেখেছো কি ঘরে
আজো কি আমাকে মনে পড়ে
নির্দ্বিধায়?
হেমন্ত-সন্ধ্যায়
গাছের শিথিল পাতা ওড়ে ঘূর্ণিঝড়ে
আজো কি আমাকে মনে পড়ে?
তোমার সমস্ত গান ভোরবেলাকার রেলওয়ে-বিলে মাছরাঙা
তোমার সমস্ত ছবি পাগল-ঝোরার...’

দোল পূর্ণিমায় আমাদের  ছুটি নেই। সারাদিন যাচ্ছেতাই রকম সরকারি কাজকম্মো সারা হলো। শীতলধারা জলে সারাগায়ের পাপ ধুয়ে গেস্টহাউসের লাউঞ্জে এসে বসেছি, পার্থ হাজির। কুন্তলবাবুর বাড়িটি কাছেই, মেঘা অতিথশালা থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে নেমে চলে যাচ্ছে, তার পাশে। অন্য সব বাড়ির মতো-ই সবুজ, সবুজ-ঘেরা পরিকীর্ণ বাগান পেরিয়ে। বাগানে দাঁড়িয়ে আছে একটি আকাশছোঁয়া প্রাংশু শালবৃক্ষ। ঘাসজমি আর সাজানো ফুলের বিছানা। সন্ধে নামার একটু আগেই দোল পূর্ণিমার চাঁদ থেকে তখন পাতলা সরের মতো জ্যোৎস্নার স্বাদ মাটিতে নেমে আসছিলো। পার্থ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই একটি শাদারং কাঠের গেটের কাছে। নাহ, ওঁর বাড়িতে কোনও কুকুর নেই। ভিতরে গৃহস্বামী শাদা লখনউয়ে সেজে আদর্শ মেহমান নওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওঁর বাড়িটি বেশ সাজানো। রুচির আঙ্গিকটি স্পষ্ট ও অভিরাম। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় পিলু বাজাচ্ছিলেন, তাঁর গান্ধর্বী আঙুলের স্পর্শে ঘর ও বাহিরে বসন্ত থৈ থৈ সুরে ভেসে যাচ্ছিলো। এটি তাঁর স্টকহোমে বাজানো ১৯৭৫ সালের রেকর্ডিংটি। বেশ দীর্ঘ, ঘোর জাগানো কোলোন ভেজা রেশমি কাপড়ের মতো মায়া তার সুরসঞ্চারে। এদেশে তখনও পাওয়া যেতো না রেকর্ডটি। নিশ্চয় কেউ বিদেশ থেকে এনে দিয়েছেন। কুন্তল কিছু বলে স্বাগত জানাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার মুখ দেখে মৌনতায় স্থির। তারপরেও বাজনাটি বেজেছিলো অনেকক্ষণ, আমি নিমীল আশ্লেষে ডুবে শুনে যাচ্ছিলুম তার সব প্ররোচনা। চোখ খুলে দেখি সামনে রিমা বসে আছে। বলে, আমি তো ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। আমি হাসি,
-হ্যাঁরে, না ঘুমিয়ে এসব কি আর শোনা যায়...?
গৃহকর্তা বিকল্প দেন, কালো কুকুর নাশিবের শৃগাল। পার্থ বলে, শেয়াল থাকতে কুকুর কেন ?
-বেশ...


নিবিড় চুমুকের সঙ্গে নিবিড়তর জীবনচর্যার গল্প চলে, চলতে থাকে প্রত্যাশিত শব্দকথার আলাপ আমাদের। কিন্তু সবার চেয়ে প্রগাঢ় যে নেশা সুরের হাত ধরে আসে, তার কাছে বাকি সব কিছু তো ছেলেখেলা। কুন্তল কলকাতায় উত্তম গুরু'র কাছে তবলা বাজাতে শিখেছিলেন। যন্ত্রটি এখন আর ততো প্রশ্রয়ে নেই, কিন্তু নেশাটি রয়েছে। দম্পতির আত্মজ, দশ বছরের বালক একটি, দার্জিলিঙে হস্টেলে থাকে। ফ্রেমের ভিতর থেকে উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে সে সবার দিকে। কথায় কথায় কথামালা। পার্থ বলে, যাবে নাকি আরেকবার থলকোবাদ? আমার প্রথম দেখা থলকোবাদ তো আর নেই। শুনেছি সেই জঙ্গল এখন ধু ধু মাঠ। যাবে? শুনলে 'না' বলতে পারি না। বলি, হাতের কাজকম্মো শেষ হোক। পার্থ বলে, তোমার কাজকম্মো মানে আমার বাঁশ, যাও তো, একদিন আমাকে ফুরসত দাও। কুন্তল সাগ্রহে বলেন, আমরা ওঁকে নিয়ে যাবো। দেখছি, ডাকবাংলাটার বুকিং কবে পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে আর থাকছে না।

-রাত হলো, আজ উঠি…
-শিবাজিদা, ওঠার আগে 'চিরসখা' একবার শোনাবে?
-দ্যাখ, সুরা পান করে গীতবিতান গাই না, তবে অন্যকিছু গাওয়া যেতে পারে, হয়তো...
- তবে ‘আমি নিরালায় বসে’, তোমার পেটেন্ট...
-মনে আছে ? বেশ...

"...বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি..."

-----------------------------------

"বড় দীর্ঘতম বৃক্ষের সে আছো, দেবতা আমার়
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনেপড়ে?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কতদূরে আজ!
স্মারক বাগানখানি গাছ হ'য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁজা-বাসা শূন্য ক'রে পলাতক হলো়
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো? বুঝি ভুলে গেলে
নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে।।



শক্তি'র কবিতা পড়ার অনেক আগে থেকেই শক্তি'র নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিলো, বাবার দৌলতে। শৈশব স্মৃতিতে মনে পড়ে কোনও এক শারদীয় দেশ বা আবাপ'তে প্রকাশিত হয়েছিলো, অবনীর পদ্য। বাংলা ভাষায় যেসব কবিতা কালো অক্ষরের শরীর পেরিয়ে মানুষের সার্বিক অবচেতনায় সংক্রমিত হয়ে গেছে, অবনীর পদ্যতার একটি। সেই বয়সে "বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে'এর ঝাপসা ছবিটিই স্পষ্ট লেগে ছিলো, বাকি পাওয়াটা পরে এসেছে। হিজলিতে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শক্তি এই পদ্যটি শব্দে বেঁধেছিলেন। কখনও ভাবেননি এই পদ্যটি তাঁর পাঞ্জার ছাপ হয়ে যাবে।

চার বছর বয়সে পিতৃহীন শিশু দাদামশায়ের সংসারে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠছিলেন। কমার্স পড়তেন, মামার ব্যবসায়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। হলো না। প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্স, তাও হলো না। যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর স্নেহ চ্ছায়ায় 'তুলনামূলক', তাও না। অসহ্য বস্তিবাস, এদিক ওদিক কেরানিগিরি থেকে গুদাম সামলানো। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডধারী সদস্য, আবার ১৯৬১তে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হাংগ্রিদলের অগ্রণী সহযোগী। কোনও কিছুই করা হয়ে উঠলো না তাঁর। লিখতেন শুধু গদ্য। কিন্তু প্রেমে পড়ে কবি হয়ে উঠলেন, এই চাইবাসাতেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য'এর কবিতা চাইবাসাতে বসেই লেখা হয়েছিলো। থাকতেন সমীর রায়চৌধুরির বাড়ি। প্রেম করতেন তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে। এই সম্পর্কটি শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি, কিন্তু অনেক গবেষকের চিরন্তন খোরাক হয়ে থেকে গেলো। সম্প্রতি বেলা রায়চৌধুরি একটি কাগজে এই ইতিকথাটি তাঁর স্মৃতি থেকে লিখে রেখেছেন। শক্তির হলেও হতে পারতেন শ্যালকের সঙ্গে আমার চাইবাসা থাকাকালীন সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিলো।
বুদ্ধদেবের 'কবিতা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম পদ্যপ্রকাশ, 'যম"। তৃতীয় প্রকাশিত কবিতা, 'জরাসন্ধ', "আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে", তারপর থেকে সেই যাত্রা, যেখানে মৃত্যুর পরেও মাথা উঁচু হেঁটে যাওয়া, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া রুটমার্চ।

যাঁদের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক নেই, তাঁরা শক্তিকে চেনেন তাঁর অবিরাম, অনশ্বর উৎকেন্দ্রিকতার নিরিখে। বাংলা কবিতার সঙ্গে সুরাপানকে অতো প্রবলমাত্রায় তিনিই জুড়ে দিয়েছিলেন। পদ্য'কে মদ্যের অপর পিঠ করে তোলার যে নিমসাধনা, তার ভগীরথ না হলেও পরশুরাম ছিলেন শক্তি। পরবর্তী প্রজন্মের কবিযশোপ্রার্থীদের 'কবি' হয়ে ওঠার কিছু মেড-ইজি তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি, হয়তো অসচেতনভাবেই। আবার সীমাহীন যশোপ্রার্থীদের গড্ডালিকার বাহুল্যে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, "এতো কবি কেন?" আর কোনও বাংলাশব্দশিল্পী জীবৎকালে এতো অধিক উপকথার নায়ক হতে পারেননি। উৎকেন্দ্রিকতা না অপ্রকৃতিস্থতা, তাঁর চালিকাশক্তি কী ছিলো তাই নিয়ে আজ অনেক গবেষণা হয়ে থাকে। অলোকরঞ্জন যা'কে বলেছেন "অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা", শক্তি তাকেই নিজের বর্ম করে তুলেছিলেন। পাগলামি'কে এমত একটি স্বীকৃত অবস্থান করে তুলতে তখনও পর্যন্ত কোনও কবি'কে আমরা দেখিনি। অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলেন, শক্তি পাগলামি ভাঙিয়েই খেলো। চ্যাপলিন যেমন বলেছিলেন ডিল্যান টমাস প্রসঙ্গে, "সে একজন পাগলের থেকেও অনেক বেশি পাগলামি করে থাকে।" শেষে কি এ তাঁর মুদ্রাদোষ হয়ে পড়েছিলো? আমি শক্তি, এই আমার প্রকৃত মুদ্রা, আমি একেই ভাঙিয়ে খাবো। এতো বৃহৎমাত্রার অস্বভাবধর্মপালন করেও কিন্তু তিনি একাধিক প্রজন্মের কবিতাপ্রেমীদের কাছে হিরোর ঊর্দ্ধে, আইকন। অনেক রসিক আক্ষেপ করেন, এখন আমারও মনে হয়, শক্তি যদি জীবদ্দশায় এতো লোকপ্রিয়তা, এমত খ্যাতি না পেতেন, তবে হয়তো তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক শ্রেয়তর সৃষ্টি আমাদের নসিব হতে পারতো। সাহিত্য অকাদেমি পেতে পেতে তিনি ফুরিয়ে গিয়েছিলেন। রাইনের মারিয়া রিলকে তাঁর এলিজি'র গুরু ছিলেন। শক্তি সারাজীবনে অসংখ্য এলিজি লিখেছেন। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ এলিজি'টি ছিলো তাঁর অকাদেমি পাওয়া বইয়ের নাম কবিতা। নেহাৎ সংযোগ, না নিয়তি নিবিষ্ট উপসংহার।


"সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই -
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই -
ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।"

(ক্রমশ)


(সৌজন্য - গুরুচণ্ডালি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন