মঞ্চের সার্থক কমেডিয়ান ভিত্তরিও ডি সিকার চলচ্চিত্রের প্রথম হাতেখড়ি হয় ১৯৪০ সালে। বহু সফল চিত্রনাট্যের রচয়িতা জাভাত্তিলিনের সাথে ডি সিকার বন্ধুত্বই বদলে দেয় ইতালির চলচ্চিত্রের ধারাকে। জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের নতুন এক ধারা ‘নিও-রিয়্যালিজম’। সস্তা সেন্টিমেন্টের ভেজাল গল্প বা বাস্তবতার বস্তাপচা গল্পের বদলে এমন ছবি বানানো হলো যেখানে আছে মানবতায় মণ্ডিত বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। ছবির মাধ্যমে ফুটে উঠলো বুর্জোয়া সমাজের আপাত ঝলমলে পর্দার আড়ালে লুকানো জীবনের দুর্বল ক্ষত, অবক্ষয় আর পতনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির প্রতিকুল অর্থনৈতিক এবং নতুন ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে মূলত সৃষ্টি হয় নিও-রিয়্যালিস্টিক চলচ্চিত্র। নিও-রিয়ালিজমের আদর্শ হচ্ছে স্টুডিওর মেকি এবং কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবন যেমন তাকে তেমন করেই তুলে ধরা হয় রুপালি পর্দায়। ডি সিকাও নতুন কিছু সৃষ্টির আশায় স্টুডিওর সাজানো বাগান ছেড়ে নেমে এসেছিলেন পথের ধুলায়। নানারকম ঝড়ঝঞ্ছা পেরিয়ে ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি হলো ডি সিকার জীবনের অদ্বিতীয় সৃষ্টি ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’। কোন প্রযোজকই পয়সা জোগাতে রাজি ছিলেন না এ ছবিতে। এটাই ছিল নিয়তির নির্মম পরিহাস। নিও-রিয়ালিজম নিয়ে সারা পৃথিবী যখন আলোচনায় মুখর, খোদ ইতালিতেই সে তখনও অনাদৃত, অপাংক্তেয়। প্রযোজকরা যে এগিয়ে আসতে গররাজি, তার পিছনে ছিল ইতালীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হুমকি মেশানো নির্দেশ। রোজেলিনি, জাভাত্তিনি এবং ডি সিকার উপর তখন চলছে কড়া সরকারি নজরদারি। কারণ হিসেবে বলা হলো এই পরিচালকদের সিনেমাগুলো হচ্ছে ইম্মরাল বা অনৈতিক। রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর এরই অজুহাতে সু-সাইন সিনেমাটি ১৯৪৬ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হলো না। ডি সিকাকে সে-সময় টাকা জোগাতে রাজি হলেন আমেরিকার পরিচালক ডেভিড ও সেলজোনিক। তবে শর্ত দেওয়া হলো প্রধান চরিত্রে একজন নামডাকওয়ালা অভিনেতাকে নিতে হবে। প্রস্তাব করা হলো ক্যারি গ্রান্টের নাম। ডি সিকা পরিচালকসুলভ আত্মবিশ্বাসে অগ্রাহ্য করলেন সেই প্রস্তাব। অবশেষে তিনি মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জোগাড় করলেন ছবি তৈরির টাকা। এভাবেই একদিন তৈরি হলো ভুবন-বিখ্যাত ছবি ‘বাইসাইকেল থিভস’। চিত্রতারকাহীন ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেন একজন সাধারণ শ্রমিক। আর তার শিশু সন্তান ব্রুনো রিকির ভূমিকায় অভিনয় করলো ফুটপাতে কাগজ বিক্রি করা একটি ছেলে। কিন্তু রিলিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। কান ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হলো ছবিটি।
বাইসাইকেল থিভস কেন অনন্য
ছবিটি দেখলেই যে ব্যাপারটি প্রথমেই মন কেড়ে নেয় সেটা হচ্ছে এর অ্যাডাল্ট অ্যাপ্রোচ বা পরিপক্ক মানসিকতার স্পষ্ট ছাপ। সমস্ত ছবিময় ছড়িয়ে আছে একটা সূক্ষ্ণ প্রাজ্ঞ সংযম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবের যথাযথ জীবনকে পরিণতির কোন স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা বোঝা যায় ছবিটি দেখলে। এর কোথাও নেই এতোটুকু অতিরঞ্জন। পরিমিতি বোধ, গল্পের সহজ প্রবহমানতা, সারল্য, স্বাভাবিকতা সমগ্র ছবিটিতেই ছড়ানো। জীবনের একটা খণ্ড ঘটনা তার মুহূর্তগত খুঁটিনাটি সমেত চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এটি যেন কোন সিনেমা নয়, বাস্তব কোন ঘটনার রূপায়ণ। এখানেই ডি সিকার মুন্সিয়ানা। নান্দনিক অভিজ্ঞানে নির্মিত এই ছবি।
ছবিটি দেখলেই যে ব্যাপারটি প্রথমেই মন কেড়ে নেয় সেটা হচ্ছে এর অ্যাডাল্ট অ্যাপ্রোচ বা পরিপক্ক মানসিকতার স্পষ্ট ছাপ। সমস্ত ছবিময় ছড়িয়ে আছে একটা সূক্ষ্ণ প্রাজ্ঞ সংযম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবের যথাযথ জীবনকে পরিণতির কোন স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা বোঝা যায় ছবিটি দেখলে। এর কোথাও নেই এতোটুকু অতিরঞ্জন। পরিমিতি বোধ, গল্পের সহজ প্রবহমানতা, সারল্য, স্বাভাবিকতা সমগ্র ছবিটিতেই ছড়ানো। জীবনের একটা খণ্ড ঘটনা তার মুহূর্তগত খুঁটিনাটি সমেত চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এটি যেন কোন সিনেমা নয়, বাস্তব কোন ঘটনার রূপায়ণ। এখানেই ডি সিকার মুন্সিয়ানা। নান্দনিক অভিজ্ঞানে নির্মিত এই ছবি।
থিভস-এর পটভূমি ও সমকালীন ইতালি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি শহরের সমস্যাসংকুল নিন্মবিত্ত জীবন ও তার সমগ্র বাস্তবতা নিয়ে তৈরি ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি। এখানে আমরা দেখি একটি মহানগরের জীবন চলছে তার নির্বিকার উদাসীনতা নিয়ে। নিস্তরঙ্গ বিবর্ণ এই শহরে হতাশায় নিমজ্জিত বহু বেকারের মধ্যে আন্তোনিও রিকিও একজন। সৌভাগ্যক্রমে সে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার তোলা ও লাগানোর একটি চাকরি পেয়ে যায়। তবে এই চাকরি পাওয়ার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে তার নিজের একটা সাইকেল থাকতে হবে। কিন্তু সাইকেল কোথায় পাবে দরিদ্র রিকি? এরকম বিপদের মুহূর্তে তার স্ত্রী মারিয়া সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বিয়েতে পাওয়া ছয়টি চাদর সে বিক্রি করে স্বামীকে সাইকেল কিনতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি শহরের সমস্যাসংকুল নিন্মবিত্ত জীবন ও তার সমগ্র বাস্তবতা নিয়ে তৈরি ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি। এখানে আমরা দেখি একটি মহানগরের জীবন চলছে তার নির্বিকার উদাসীনতা নিয়ে। নিস্তরঙ্গ বিবর্ণ এই শহরে হতাশায় নিমজ্জিত বহু বেকারের মধ্যে আন্তোনিও রিকিও একজন। সৌভাগ্যক্রমে সে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার তোলা ও লাগানোর একটি চাকরি পেয়ে যায়। তবে এই চাকরি পাওয়ার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে তার নিজের একটা সাইকেল থাকতে হবে। কিন্তু সাইকেল কোথায় পাবে দরিদ্র রিকি? এরকম বিপদের মুহূর্তে তার স্ত্রী মারিয়া সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বিয়েতে পাওয়া ছয়টি চাদর সে বিক্রি করে স্বামীকে সাইকেল কিনতে সাহায্য করে।
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকি প্রথম দিন কাজে বেরোয়। সাইকেলটি পাশে রেখে
সে নিশ্চিন্তে দেয়ালে পোস্টার লাগাতে থাকে। ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, তার চোখের সামনেই এক চোর দৌড়ে
এসে সাইকেলটি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। এরপর ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হতে
থাকে সাইকেলটি খুঁজে পাওয়া অথবা না পাওয়ার দোলাচলের মধ্য দিয়ে।
দুঃখভারাক্রান্ত মনে রিকি ছেলেকে নিয়ে বের হয় সাইকেলটির অনুসন্ধানে।
শেষাবধি সেটি খুঁজে না পেয়ে ভীষণ অসহায়ত্ব
নিয়ে, অনেকটা নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত
নেয় আরেকজনের সাইকেল চুরি করার। ছেলেকে বাসে করে ফিরে যেতে বলে সে একটি রাস্তার
পাশে রাখা সাইকেল চুরি করে পালাতে যায়। কিন্তু সফল হলো না তার সেই চৌর্রকর্ম।
এভাবেই নিষ্ফল একটা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার করুণ পরিণতি সমস্ত অসহায়ত্ব নিয়ে ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ
ছবিটিতে।
বোঝাই যায়, গল্পটি
একটি উপলক্ষ মাত্র। বিরাট জীবনের স্রোতোধারাকে তার তরঙ্গের পর তরঙ্গের ভিতর দিয়ে
স্বাভাবিক গতিসহ ধরে ফেলা হয়েছে ছবিটিতে। একটি ভাবনারই যেন পল্লবিত সম্প্রসারণ
ঘটেছে এতে। রিকির প্রথম দিনের চাকরির স্থলে দেখি পোস্টার লাগানো লোকটি রাস্তার
অ্যাকরডিয়ানবাদক ভিখারিকে পেছন থেকে লাথি দিচ্ছে। ডি সিকার ক্যামেরাও যেন এই সহজ
সরলতার খাতিরেই অকৃত্রিম ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। দৃশ্যটির সরলতা এতোটাই
মনোমুগ্ধকর যে মনে হয় আমাদের চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটছে। ছয়টি বিছানার চাদর বাঁধা
দিয়ে যখন বন্ধক রাখা সাইকেলটি রিকি ছাড়িয়ে আনলো, সাইকেল
ডেলিভারি নেওয়ার সময় একজন কর্মচারি চাদরগুলো নিয়ে চলে গেল। গল্পের নায়ক রিকি মাত্র
একবার সেই দৃশ্য দেখে নিয়ে নিজের কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু আমরা দর্শকরা থেমে
থাকলাম মাঝপথে। গুদামঘরের ছাদের উঁচু তাকে সেই চাদরগুলো না রাখা পর্যন্ত আমাদের
দৃষ্টি সেই কর্মচারিকেই অনুসরণ করে চলল। এই যে উঁচুতে ওঠার দৃশ্যরূপ তা কি কিছুটা
হলেও প্রতীকের আভাস দেয় না? নিজের জীবনের নীচু অবস্থান থেকে
রিকি কি ওই উচ্চতারই আকাঙ্ক্ষা লালন করছে না? দর্শক হিসেবে
জীবনের আরেক অবধারিত বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম আমরা যখন রিকি সাইকেল হারানোর জন্য
পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করল আর পুলিসটি বললো, “একটা তুচ্ছ সাইকেল খোঁজার জন্য
এতো খরচ করে পুলিশ পোষা হয় না।” সাইকেলটা যেন রিকি নিজেই
খুঁজে নেয়। আর সাইকেলটা খুঁজে পেলে যেন পুলিশকে জানায় যাতে তারা ঘটনাটা ডাইরিতে
টুকে রাখতে পারে। এর পরমুহূর্তেই আবার দারোগা হুকুম দেয়, মজুরদের
মিছিল দমনের জন্য ট্রাক বোঝাই পুলিশ পাঠাতে। একইভাবে বৃদ্ধা গণৎকার যখন
নিরাসক্তভাবে বলতে থাকে, “সাইকেলটি পেতে পারো আবার নাও পেতে
পারো!” ব্যাপারটার মধ্যে এতটাই স্বাভাবিকতা ছিল যে মনেই হয়নি
গণৎকার অতিরঞ্জিত কিছু বলছে। এদিকে সাইকেল খুঁজতে খুঁজতে এক বৃদ্ধলোকের পিছু পিছু
গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে রিকি। ভান করে উপাসনায় অংশ নেওয়ার। তখনই চোরের বন্ধুকে
চেপে ধরা, তার পাশে জোর করে বসা ও নায়কের কথা বলার স্বাভাবিক
উত্তেজনা – এর সবই সম্পূর্ণ ছবি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সহজ
ভঙ্গির দৃশ্যরূপ। এইসব টুকরো টুকরা ঘটনা, বুঝতে অসুবিধা হয়
না যে সর্বহারা মানুষের জীবনের সহজ সরল গল্প। ডি সিকা এই গল্প বলার জন্যই ছবিটি
নির্মাণ করেছিলেন।
ডি সিকা ও তাঁর নন্দনশৈলী
কম্পোজিশন যে ডি সিকার সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল, তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ছবির একের পর এক সিকোয়েন্সে। আমরা দেখতে পাই প্রতিটি খণ্ড কাহিনি যেন তার নিজস্ব সহজতায় একের পর এক চোখের সামনে ঘটে চলেছে। মন্তাজরীতির অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে পরপর ছয়টি শটে, বৃষ্টিভেজা পথ দিয়ে বাপ-ছেলের দৌড়ানো থেকে শুরু করে খটখটে পথে তাদের দাঁড়ানো অব্দি। কখনই চোখে পড়ে না কোন কৃত্রিমতা অথবা জোর করে বাড়তি রঙচং মাখিয়ে অভিনয় করানো বা সাজানো ভঙ্গি। এই ছবির পরতে পরতে কী অপরূপ সংযম আর সংহতি। গল্পের নায়ক হতদরিদ্র রিকি যখন রিটা হেওয়ার্থের পীনোদ্ধত আবক্ষ ছবির পোস্টার দেয়ালে লাগাচ্ছিলেন, ডি সিকা এমনভাবে ক্যামারা ব্যবহার করলেন যাতে পোস্টারটি হয়ে পড়লো অনুল্লেখযোগ্য আর পোস্টার লাগানোর কাজটি হয়ে উঠলো উল্লেখযোগ্য। ক্যামেরার এই যে ফোকাস, নিঃসন্দেহে ডি সিকার সৃজনশীল নান্দনিকতারই অনবদ্য প্রকাশ। এরকমই সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ আবেগ আর ঘটনার অতিসাধারণ প্রকাশ দিয়েই ডি সিকা চমকে দেন দর্শকের। জয় করে নেন তাদের মন। এক অপরূপ মাধুর্যে উদ্ভাসিত হয় তাদের সত্তা।
কম্পোজিশন যে ডি সিকার সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল, তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ছবির একের পর এক সিকোয়েন্সে। আমরা দেখতে পাই প্রতিটি খণ্ড কাহিনি যেন তার নিজস্ব সহজতায় একের পর এক চোখের সামনে ঘটে চলেছে। মন্তাজরীতির অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে পরপর ছয়টি শটে, বৃষ্টিভেজা পথ দিয়ে বাপ-ছেলের দৌড়ানো থেকে শুরু করে খটখটে পথে তাদের দাঁড়ানো অব্দি। কখনই চোখে পড়ে না কোন কৃত্রিমতা অথবা জোর করে বাড়তি রঙচং মাখিয়ে অভিনয় করানো বা সাজানো ভঙ্গি। এই ছবির পরতে পরতে কী অপরূপ সংযম আর সংহতি। গল্পের নায়ক হতদরিদ্র রিকি যখন রিটা হেওয়ার্থের পীনোদ্ধত আবক্ষ ছবির পোস্টার দেয়ালে লাগাচ্ছিলেন, ডি সিকা এমনভাবে ক্যামারা ব্যবহার করলেন যাতে পোস্টারটি হয়ে পড়লো অনুল্লেখযোগ্য আর পোস্টার লাগানোর কাজটি হয়ে উঠলো উল্লেখযোগ্য। ক্যামেরার এই যে ফোকাস, নিঃসন্দেহে ডি সিকার সৃজনশীল নান্দনিকতারই অনবদ্য প্রকাশ। এরকমই সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ আবেগ আর ঘটনার অতিসাধারণ প্রকাশ দিয়েই ডি সিকা চমকে দেন দর্শকের। জয় করে নেন তাদের মন। এক অপরূপ মাধুর্যে উদ্ভাসিত হয় তাদের সত্তা।
আরেকটা দৃশ্যের কথা বলি। রিকি ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে সাইকেল খুঁজতে
খুঁজতে চলেছে ক্লান্ত পায়ে। ছেলে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত। বাবার কর্মকাণ্ডে কিছুটা বিরক্ত। এদিকে
বাবাও হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে ছেলের উপর কিছুটা ক্ষিপ্ত। চড়াও হয় হয় এমন অবস্থা।
এতে ছেলে গেল রেগে। মাকে গিয়ে নালিশ করবে বলে বাবাকে হুমকি দিল। এরপর বাবা-ছেলে
দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, মাঝখানে অনেকটা ফাঁক। ছেলেকে পিছনে
ফেলে বাবা একাই নদীর ধারে সাইকেল খুঁজতে চললো। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো কোলাহল।
একটি ছোটছেলে নাকি পানিতে ডুবে গেছে। বাবার মন বলে কথা। অজানা আশঙ্কায় আঁতকে উঠলো।
ব্রুনো ব্রুনো করে বাবার সেকি চিৎকার! কিন্তু পরমুহূর্তেই নদীর ঘাটের উপর ছেলেকে
গালে হাত দিয়ে বিজ্ঞের মতো বসে থাকতে দেখে
বাবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। ব্রুনো তখন চুপ করে বসে আছে সিঁড়ির উপর। তার মাথার
উপর দিয়ে আমরা দেখতে পাই এক বিরাট উদার আকাশ, ধীরমন্থর গতিতে
পরম উদাসীন কিছু মেঘ ভেসে চলেছে। একদিকে সহজ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অন্যদিকে মধুরতা।
এও কি কিছুটা প্রতীকি নয়? তবে এই দৃশ্য কখনই প্রকৃতিকে ছাপিয়ে প্রতীকি প্রকটতায়
আমাদের দেখার আনন্দকে নষ্ট করে না।
বাবা-ছেলে এবার সব ভুলে ঢুকে পড়লো একটা রেস্তোরাঁয়। খাওয়া দাওয়া চলছে।
চলছে মিউজিক। কিন্তু বাবার মনে শান্তি নেই। ঘুরে ফিরে তার চাকরির কথা মনে হয়ে যায়।
মনে পড়ে সাইকেলের কথাও। এভাবেই চলে আসি ছবির শেষের দিকে। সারাদিনের ক্লান্ত
পরিশ্রান্ত রিকি অন্য এক যুবককে চোর ভেবে নানাভাবে জেরা করতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই
চোরটিকে ধরতে পারে না। শেষে নিজেই চোর হয়ে অপরের সাইকেল চুরি করার মতলব আঁটে।
কিন্তু পালাতে গিয়ে লোকজনের হাতে ধরা পড়ে বেদম মার খায়। ব্রুনো ভিড়ের বাইরে থেকে
বাবার জন্য বৃথা আহাজারি করতে থাকে আর ছবির দর্শকদেরকে এক চরম হতাশার মধ্যে ঠেলে
দেয়। একসময় লোকের হাত থেকে মুক্ত রিকি ছেলের হাত ধরে পথ চলতে থাকে। পিছন থেকে ভেসে
আসতে থাকে লোকজনের বিদ্রূপ। আমাদের কানেও সেসব পৌঁছায়। নাকে মুখে প্রহারের চিহ্ন
নিয়ে ছেলের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না গল্পের নায়ক
রিকি। শহরের দূরের আকাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। অক্ষম ক্ষোভের কান্না আর একাকী জীবন
সংগ্রামের ধিক্কারসহ ছেলের হাত ধরে রিকি পথ চলতে থাকে। তার গন্তব্য যেন এক
অনিশ্চিত আগামীর দিকে। জীবন হয়তো এরকমই প্রসারিত, অনন্ত।
অভিনয় ও অন্যান্য
ছবিতে সবার অভিনয় এতটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব যে বিশেষ কিছু বলার নেই। ডি সিকার কাছে ছোট্ট একটা চরিত্রও খুবই গুরুত্ব পায়। চরিত্রের প্রত্যেকটি মানুষই যেন আমাদের চিরচেনা চারপাশের আপন মানুষ। দেশকালের গণ্ডিতে তাদের বাঁধা যায় না। চরিত্রগুলি যেন ইতালীয় নয়, আমাদের এই ঢাকা শহরেরই। ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর বারবার করে বাবার দিকে তাকানোর মধ্যে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছে, অথবা সাইকেলটি পেয়ে তার যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তার কোনো তুলনা হয় না। সাইকেল হারানোর পর বাবাকে বারবার করে সাইকেলটির কী হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাওয়ার চিরচেনা ভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিশুদের স্বাভাবিক আচরণের কথা। শিশু মনস্তত্ত্বের এও আরেক দিক। সব চরিত্রই এই ছবিতে সহজ অনাড়ম্বরভাবে অনবদ্য অভিনয় করে গেছে। অতিরঞ্জনের ছিটেফোঁটাও আমাদের বিব্রত করে না। সম্পূর্ণ সিনেমা জুড়ে যে এক অনাড়ম্বর সংযত কথন আমরা দেখতে পাই, সেই রসটিই হচ্ছে এই ছবির প্রাণবস্তু। বলা বাহুল্য, শুধু এই লেখা পড়ে ছবিটি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া এককথায় অসম্ভব। ডি সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই ছবিটি দেখতে হবে। একবার দেখতে বসলে যে কোনো দর্শক তার আসন ছেড়ে উঠে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
ছবিতে সবার অভিনয় এতটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব যে বিশেষ কিছু বলার নেই। ডি সিকার কাছে ছোট্ট একটা চরিত্রও খুবই গুরুত্ব পায়। চরিত্রের প্রত্যেকটি মানুষই যেন আমাদের চিরচেনা চারপাশের আপন মানুষ। দেশকালের গণ্ডিতে তাদের বাঁধা যায় না। চরিত্রগুলি যেন ইতালীয় নয়, আমাদের এই ঢাকা শহরেরই। ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর বারবার করে বাবার দিকে তাকানোর মধ্যে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছে, অথবা সাইকেলটি পেয়ে তার যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তার কোনো তুলনা হয় না। সাইকেল হারানোর পর বাবাকে বারবার করে সাইকেলটির কী হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাওয়ার চিরচেনা ভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিশুদের স্বাভাবিক আচরণের কথা। শিশু মনস্তত্ত্বের এও আরেক দিক। সব চরিত্রই এই ছবিতে সহজ অনাড়ম্বরভাবে অনবদ্য অভিনয় করে গেছে। অতিরঞ্জনের ছিটেফোঁটাও আমাদের বিব্রত করে না। সম্পূর্ণ সিনেমা জুড়ে যে এক অনাড়ম্বর সংযত কথন আমরা দেখতে পাই, সেই রসটিই হচ্ছে এই ছবির প্রাণবস্তু। বলা বাহুল্য, শুধু এই লেখা পড়ে ছবিটি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া এককথায় অসম্ভব। ডি সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই ছবিটি দেখতে হবে। একবার দেখতে বসলে যে কোনো দর্শক তার আসন ছেড়ে উঠে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ ও ডি সিকা
মনে পড়ছে সত্যজিৎই কথাটা বলেছিলেন, ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’ সহ এই পর্বের ইতালীয় ছবিই ভবিষ্যতের বিশ্ব-চলচ্চিত্রের গতিপথ তৈরি করে দিয়েছিল, “ইতালীয় ফিল্মের এই বহুখ্যাত বাস্তবিকতা (নিও-রিয়্যালিজম), সারল্য আর মানবতাই এ যুগের চলচ্চিত্র-শিল্পের যথার্থ সুরের সন্ধান দিয়েছে।” অভিনয়ের জন্য বড় কোনো তারকার প্রয়োজন হয়, জাঁক করে হৈ চৈ ফেলে দিলেই ছবি করা হয়ে যায় না। ইতালীয়রাই সবার আগে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ডি সিকা ছিলেন যাদের পুরোভাগে। পথের পাঁচালী-খ্যাত সত্যজিৎ রায়েরও যে গুরু ছিলেন ডি সিকা, তাও অকপটে বলেছেন সত্যজিৎ। আমি এখানে তাঁর কথা পুনরুল্লেখ করে আমার বাইসাইকেল থিভস দর্শনের মহিমার কথা শেষ করছি, “ইতালীয় ফিল্ম এত আলোড়ন তুলেছে কেন ভেবে দেখতে গেলে কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। হলিউড এতকাল ধরে তিলে তিলে যে সমস্ত অবাস্তব রীতির প্রতিষ্ঠা করেছে, একমাত্র ইতালি পেরেছে সেই আজগুবি রীতিকে ফুঁ দিয়ে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে। অভিনয়ের জন্য তারকারাজি সম্মেলন করার রীতি যে কত বড় বিরাট মূর্খতা, ইতালীয়রা তা হাতে হাতে প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে ছবি তুলতে কুবের ভাণ্ডার উজাড় করার, কিংবা চটুল চাকচিক্যের জৌলুস দেওয়ার এবং সেই ছবি কাটতির জন্য বিশ্বব্যাপী হই হই রই রই আওয়াজ তোলার কোনওই প্রয়োজন নেই। বলতে গেলে প্রায় সূচনা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়েছে বলে ইতালীয়রা চলচ্চিত্রের মূল ভিত্তির সন্ধান রাখেন। ব্যাপারটা বড় সহজ হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতিটাই তো জটিল, কিন্তু তার মধ্যেই ইতালীয়রা সারল্যে, সততায়, বাস্তবিকতায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে এসেছেন। নতুন পদ্ধতির এই নতুন পাঠশালায় রসেলিনি, ডি সিকা, ভিসকন্তি, লাতুয়াদা – এরাই হচ্ছেন গুরু।” (সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ)
মনে পড়ছে সত্যজিৎই কথাটা বলেছিলেন, ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’ সহ এই পর্বের ইতালীয় ছবিই ভবিষ্যতের বিশ্ব-চলচ্চিত্রের গতিপথ তৈরি করে দিয়েছিল, “ইতালীয় ফিল্মের এই বহুখ্যাত বাস্তবিকতা (নিও-রিয়্যালিজম), সারল্য আর মানবতাই এ যুগের চলচ্চিত্র-শিল্পের যথার্থ সুরের সন্ধান দিয়েছে।” অভিনয়ের জন্য বড় কোনো তারকার প্রয়োজন হয়, জাঁক করে হৈ চৈ ফেলে দিলেই ছবি করা হয়ে যায় না। ইতালীয়রাই সবার আগে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ডি সিকা ছিলেন যাদের পুরোভাগে। পথের পাঁচালী-খ্যাত সত্যজিৎ রায়েরও যে গুরু ছিলেন ডি সিকা, তাও অকপটে বলেছেন সত্যজিৎ। আমি এখানে তাঁর কথা পুনরুল্লেখ করে আমার বাইসাইকেল থিভস দর্শনের মহিমার কথা শেষ করছি, “ইতালীয় ফিল্ম এত আলোড়ন তুলেছে কেন ভেবে দেখতে গেলে কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। হলিউড এতকাল ধরে তিলে তিলে যে সমস্ত অবাস্তব রীতির প্রতিষ্ঠা করেছে, একমাত্র ইতালি পেরেছে সেই আজগুবি রীতিকে ফুঁ দিয়ে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে। অভিনয়ের জন্য তারকারাজি সম্মেলন করার রীতি যে কত বড় বিরাট মূর্খতা, ইতালীয়রা তা হাতে হাতে প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে ছবি তুলতে কুবের ভাণ্ডার উজাড় করার, কিংবা চটুল চাকচিক্যের জৌলুস দেওয়ার এবং সেই ছবি কাটতির জন্য বিশ্বব্যাপী হই হই রই রই আওয়াজ তোলার কোনওই প্রয়োজন নেই। বলতে গেলে প্রায় সূচনা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়েছে বলে ইতালীয়রা চলচ্চিত্রের মূল ভিত্তির সন্ধান রাখেন। ব্যাপারটা বড় সহজ হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতিটাই তো জটিল, কিন্তু তার মধ্যেই ইতালীয়রা সারল্যে, সততায়, বাস্তবিকতায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে এসেছেন। নতুন পদ্ধতির এই নতুন পাঠশালায় রসেলিনি, ডি সিকা, ভিসকন্তি, লাতুয়াদা – এরাই হচ্ছেন গুরু।” (সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন