বাঁশি
আমার মেয়েটার নাম বাঁশি। ক্লাস টু’তে পড়ে। ওর ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। সাধারণত ও ঘুম থেকে ওঠে সকাল ৭টায়। রেডি হয়। আমি ওকে খাওয়াই, রেডি করি। বাঁশি সকালে খেতে চায় না। টালবাহানা করে। আমি জোর করে খাওয়াই। ওর মা নেই। দালালকে ৬লাখ টাকা দিয়ে গৃহকর্মী হিসাবে সৌদিআরব গিয়েছিল। একসময় কফিন ভর্তি হয়ে ওর লাশ আসে।
আমাদের ছোট্ট বাড়ির জানালা দিয়ে সরিষাক্ষেত দেখা যায়। হলুদ সরিষাফুল বাতাসে দোলে। ক্ষেতের পাশেই আমার স্ত্রীর কবর। বাঁশিকে স্কুলের জন্য রেডি করতে করতে ওদিকে তাকিয়ে থাকি। অভাবের ফাঁক ফোকড় দেখি,
মেয়েটার মুখের দিকে আগামী স্বপ্ন বাঁধি।
মেয়ে আমার আজ মহাখুশি যে ওরই স্কুলে আমার চাকরি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষক। পকেট থেকে যোগদান পত্র বের করে তাকিয়ে থাকি। যেন সোনার হরিণ।
নাম: মো: বেদারউদ্দিন মৃধা
পিতা: মৃত ছালু মৃধা
সাং: ডাসার
থানা: কালকিনি
জেলা: মাদারীপুর
১৫তম গ্রেড (পিটিআই প্রশিক্ষণবিহীন) ৯৭০০-২৩, ৪৯০/ স্কেলে নলিয়াকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে সংযুক্ত করা হইল। এই আদেশ জনস্বার্থে জারী করা হইল।
যোগদান পত্রের দিকে তাকাতে তাকাতে হিসাব করি টাকার ঘ্রাণ।
মূলবেতন: ৯৭০০/ টাকা
বাড়িভাড়া ৫০%: ৪,৮৫০/
চিকিৎসাভাতা : ১,৫০০/
টিফিন : ২০০/
মোট: ১৬,২৫০টাকা
কল্যাণ ভাতা ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যয় বাদে ১৬,০৫০ টাকা থাকবে। সন্তান পড়াশোনারত
থাকলে ১ সন্তান মাসিক ৫০০/-টাকা। সর্বমোট ১৬,৫৫০ টাকা।
বাঁশির ডাকে বাস্তবে ফিরে আসি। আমারও রেডি হতে হবে। প্রথম স্কুলের দিন দেরি করা যাবে না। মন আরো ভালো যে বাঁশির স্কুলেই আমি পড়াব।
বাঁশির হাত ধরে যাত্রা শুরু করি। স্কুলটা দূরে না। বাঁশি আমার হাত ধরেই লাফাচ্ছে। ওকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। সরিষার ক্ষেতের পাশ ধরে সরু আলপথ রাস্তা। আজ মনে হচ্ছে সমস্ত গ্রাম রোদের টাঙ্গাইল সূতি পরেছে। কলাপাতা কেমনে হচ্ছে পল্লি কবি জসীমউদ্দিন।
বাঁশির মা কি টের পাচ্ছে কিছু?
ক্লাস শুরু হলো। কী অবাক কাণ্ড আমার জীবনের প্রথম ক্লাস বাঁশিদের সাথেই। ক্লাসে ঢুকেই সারি সারি ছেলেমেয়েদের মাঝে আমার মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। ওকে আবিস্কার করতে বেশি সময় লাগে না। কী আনন্দ ওর চোখে মুখে…
মা-হারা এই মেয়ের আনন্দে আমি কোন কথা খুঁজে পাই না। টিনের চালের গরমে আমি ঘামতে থাকি।
হাজিরাখাতা ধরে আমি ক্লাসরুমে দাঁড়িয়েই থাকি…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন