দোকান আর লোকটা আর হলুদ আলো
হলুদ আলো ছাড়া দোকান আর লোকটাকে, দোকান ছাড়া হলুদ আলো আর লোকটাকে, লোকটা
ছাড়া দোকান আর হলুদ আলোকে বেকুব, এতিম ও আত্মাহীন লাগে। যেন
শুরুর দিন থেকেই দোকানটা এমনই তেলচিটে, যেন লোকটাও আজীবন
এরকম পোড় খাওয়া, যেন হলুদ আলোটাও এরকমই ঘোলাটে সৃষ্টির আদি
থেকে। চায়ের গ্লাস হাতে বসে উল্টোদিকের লন্ড্রির দোকানের দিকে চেয়ে বিমল এসবই
ভাবছিল। বিমল নিশ্চিত এ তল্লাটে লোকটার কোনো নাম নেই ‘লন্ড্রিকাকু’ ছাড়া। যে
তল্লাটে নাম আছে, অথবা ছিল, সেই তল্লাটে যদি একদিন বিমলের
সাথে তার দেখা হয়ে যায়, লোকটাকে বিমল চিনতে পারবে? চিনতে পারলেও, লোকটাকে যদি জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন?”
বিমল জানে লোকটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে, বিমল জানে লোকটা এই প্রশ্নের
উত্তর দিতে পারবে না। বিমল এটাও জানে, এই প্রশ্ন তাকে বহুদিন
হলো কেউ করে না।
ঝুঁকে দাঁড়ানো লোকটাকে পাশ থেকে একটা লোহার জংধরা ইস্তিরির
মত দেখাচ্ছে। বিমল মনে করে, বিমল আবারও
নিশ্চিত হয়, যা নিয়ে মানুষ বেশি ঘাঁটাঘাটি করে, একটা সময় পর মানুষকে তার মত দেখতে লাগে। শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, স্কার্ট
থেকে বেরিয়ে আসা গরম কাপড়ের গন্ধ লোকটার গায়ে লেগে লেগে লেগে লেগে লোকটার গায়ের
গন্ধ গায়েব হয়ে গেছে। এখন দোকান আর ইস্তিরি আর হলুদ আলো। লোকটাকে আর আলাদা করে
দেখতে পাচ্ছে না বিমল।
বিমলের মনে হয়, আচ্ছা, লোকটা কখনো টের পেয়েছিল যে সে পুরনো হয়ে
যাচ্ছে? লোকটা কখনো টের পেয়েছিল যে তার লন্ড্রির দোকান তাকে
গাপ করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে? লোকটার কি কিছুই করার ছিল না?
লোকটা কি নিরুপায় ছিল? লোকটা কেন পারেনি দু’পা
হেঁটে দোকানটা থেকে চিরকালের মত বেরিয়ে আসতে? ছোটই তো,
খুবই ঘুপচি মত দোকান, আর তাতে হলুদ আলো আর
লোকটা সেই থেকে লেগে আছে।
বিমল জানে কোনো কোনো দিন এমনও গেছে, লোকটা সারাদিনে কারোর সাথে একটা কথাও বলেনি। অথচ লোকটা দোকানে
এসেছে, দোকান খুলেছে, জামা কাপড়
ইস্তিরি করে ব্যাগে ভরেছে, অবসরে কাঠের কালশিটে ভরা মসৃণতম
টুলে বসে বিবর্ণ খবরের কাগজের পাতা উল্টেছে, খদ্দের এসে
কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে গেছে, ব্যাগ নিয়ে গেছে, অথচ কেউ লোকটাকে কিচ্ছু বলেনি, লোকটাও কাউকে কিছুই
জানায়নি। বিমল অবাক হয়ে দেখে লোকটা কীভাবে টুলে বসে নির্বিকার মুখে খবরের কাগজের
পাতা উল্টেই যাচ্ছে, উল্টেই যাচ্ছে। লোকটার মুখের ভাঁজ একটুও
বদলাচ্ছে না। কোনো খবরই পারছে না লোকটাকে টলাতে। দোকানটাকে খানিকটা উত্তাল করতে।
বা হলুদ আলোটাকে একটু কাঁপাতে।
রতন এক প্লেট অমলেট ট্রে থেকে খট করে নামিয়ে রেখে গেল
বিমলের সামনে টেবিলে। বিমল দেখল, সেই আওয়াজ
শুনে লোকটা খবরের কাগজ নামিয়ে সোজাসাপ্টা বিমলের দিকে তাকিয়েছে। বিমল চোখ সরাতে
পারল না। ইস্তিরি গরম করার উনুনের মত লোকটার চোখ জ্বলে আছে, কবে
থেকে, কেউ জানে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন