ফুটকি
বিশাল হলঘর। সবাই খুব সিরিয়াস। শুধু অট্টহাসি
হাসছে নিত্যানন্দ। কেউ শুনতে পারছে না তার
হাসি। অথচ হাসির গমকে চমকে উঠছে সিস্টেম। ফুটকির পর ফুটকি দিচ্ছে শত শত তরুণ
তরুণী। তারা সবাই দুর্দান্ত ক্লার্ক হতে চায়। নিত্যানন্দর বাবা বড্ড সেকেলে,
নিত্যানন্দের নাম বড় সেকেলে। নিত্যানন্দ বহুদিন ধরে ফুটকি দিতে দিতে ক্রমাগত যে
ছোট হয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারটা কেউ দেখতে
পাচ্ছে না। কতবছর ধরে সে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে আসছে, নিজেই ভুলে গেছে। পৃথিবীর সব বৃহত্তম ক্ষুদ্রতম পাহাড়,
হ্রদ, নদী আর নানা দেশের কারেন্সি তাকে বলে - পাসপোর্ট
আছে? আছে পাসপোর্ট? আছে কি গোপন পাসওয়ার্ড?
অভ্যস্ত হাতে নিত্যানন্দ ফুটকি দেয় । পরীক্ষা শেষ।
কুঁজোপিঠ, ফর্সা চেহারার এক প্রাগৈতিহাসিক একজামিনার তার আটত্রিশ বছরের কিছু ফুটকি
নিয়ে যায় নম্বর গুণে গুণে।
হলের বাইরে দুর্দান্ত নিস্তব্ধতা, কিন্তু হাজার হাজার
তরুণ প্রচুর কথা বলছে, কী বলছে তারা জানে
না। তাদের হতাশাগুলো এই মুহূর্তে বসন্তের পাখির মতো হাসিখুশি, তাদের
দীর্ঘশ্বাসগুলো ঝরে যাওয়া ফুল মতো হয়তো। তারা কেউ কেউ এখন সিগারেট কিংবা চা খেয়ে
পরীক্ষা প্রস্তুতির জমা বাষ্পকে গরম গরম এনজয় করবে। ভেতর থেকে লাথির পর লাথি আসবে।
কিন্ত ঠোঁট শান্ত, চুক চুক...। আরো নলেজ চাই, আরো নলেজ। দূর শালা, ছোটবেলা থেকে
কী পড়লাম, কী শিখলাম জানি না, শেষপর্যন্ত তো এই দীর্ঘ অন্ধকার গুহা। গুহার মধ্যে ঢুকে গেলে চারপাশ থেকে চেপে ধরে সেই
সিস্টেম। নিত্যানন্দ গুহার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তাকে এখানেই মরতে হবে। সে এখন একটি
এলিমেন্ট। তার মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই। টেনশনের সময় পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। ক্ষয়ে
যাওয়া এই জীবনের আর কিছু নেই ভবিষ্যৎ।
প্রত্যেকটি আশা তাকে ছেড়ে গিয়েছে কবেই। আছে কেবল বলপেন ও এম আর শিট। তার ইচ্ছে করে
কোদাল চালাতে, কিন্তু পিঠ ভেঙে দিয়েছে
কবেই একটি সিস্টেম, সোজা হতে পারে না। কোমরে জোর নেই, হাঁপরের মতো শ্বাস ওঠে নামে।
হঠাৎ নিত্যানন্দ ভাবে, আরে মৃত্যু আছে তো! সেখানে গেলেই তো সে বেরিয়ে আসতে পারবে
সবকিছু থেকে। কীভাবে মরা যায় ভাবতে শুরু
করে। তারপর হঠাৎ মনে হয়, নিরাশ হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে এক অসম্ভব আত্মবৈভব আছে। পৃথিবীর
সব দুঃখে সে সম্রাট, ব্যর্থতার কারবার তার, আকাশ দেখার ফুরসত আছে। তার কাছে আছে
অসংখ্য জানা অজানা ফুটকি। এইসব ফুটকি দিয়ে আস্তে আস্তে সে সিস্টেমে ঢুকে যাবে। গুহাটাকে
আরো জটিল বানালে কেমন হয় !
আরো রাস্তা, সব পথের শেষেই নিত্যানন্দের বাড়ি।
হলুদ জামা পরে দাঁত কেলিয়ে নিত্যানন্দ বলছে, “আয় আয়, বেচারা আহাম্মকের দল,
জনসংখ্যা কম কর, উড়িয়ে দিতে পারিস না।
কিলবিল কেন করিস? এ্যাঁ! আমি নিত্যানন্দ, জানিস? আজকাল শিশুর হাসি
দেখলেও মনে হয় ফুটকি মেরে চুপ করিয়ে দিই এখনই...”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন