সমুদ্র অভিসারী
পেরুর
উপকূলে ওরা উড়ত ডানা মেলে
রূপোলি
ঝিলিক দেয়া বালির উপরে,
আর
আটলান্টিক সমুদ্রের নীল সমারোহে
আকাশ উঁকি
দিয়ে হেসে উঠত খিলখিল।
পেলিক্যান
আর সিগ্যাল পাখিরা
হাজারে
হাজারে যে বিপুল গরিমা নিয়ে
সারাদিন
উড়ে উড়ে কর্কশ সঙ্গীতে
সমুদ্রের
ঢেউয়ে দোলা খেত আর
সোনালি
রূপোলি মাছের ঝাঁকে দিত হানা ঝাঁপিয়ে!
তখন সেই
কর্কশ সামুদ্রিক সুরে হার মানতো
জুলিয়েটের
বারান্দার শেকসপীয়রের সেই
মিস্টি
মধুর সুরেলা নাইটিঙ্গেল।
নোয়ার
আর্ক থেকে উড়ে চলে যাওয়া
সুন্দর
কবুতর —
ওদের
সাহসী ডানার ঝাপটে ম্লান মনে হতো।
আর সেই সব
সোয়ালো পাখির
দ্বিখণ্ডিত
দীর্ঘপুচ্ছ দীঘল ডানার
শোভন
উড়ালও ওদের ডানার ছন্দে হেরে যেতো,
হেরে যেতো
গুস্তাভো আদোলফো বেকোরের
বসন্তবিহারী
পরিযায়ী দীঘল সোয়ালো!
কতকাল
কতযুগ ওরা সমুদ্র অভিসারী
উড়েছিল
নেচেছিল গেয়েছিল
দুরন্ত
উন্মুক্ত জীবনের জয়গান —
ওরা তা
ভুলেছিল, ভুলেছিল পেরুর বাসিন্দা।
সমুদ্রের
তীরে ভারে ভারে স্তুপে স্তুপে
জমেছিল
বিষ্ঠার পাহাড়,
রোদে পুড়ে
স্পর্ধায় আকাশে তুলেছিল মাথা।
পেরুকে
লুণ্ঠন করে নিয়ে এবার
কুচক্রি
সাম্রাজ্যবাদীদের
পাখির
বিষ্ঠা —
এটাও চাই, চাই এই খাঁটি
নাইট্রেট
একটুও
যাবে না ফেলা —
শকুনির
লুব্ধ দৃষ্টি যেমন ভাগাড়ে!
কোন্
বিজ্ঞানী যে বলেছেন
এই বিষ্ঠা
নিখাদ নাইট্রেট,
গম ক্ষেতে
তুলবে ফলনের ভরন্ত তুফান।
ওদিকে
য়ুরোপে শূকর মোরগ
মাছ চায়
নোনা সমুদ্রের, মাছ দরকার!
পেরুর
উপকূল লোভনীয়—
পেলিক্যান
সীগ্যালের বংশ পরম্পরার খাদ্যের ভাণ্ডার।
জাহাজ জাহাজ
নাইট্রেট
নিয়ে গেল
মার্কিনি বণিক,
হাজার
হাজার জাহাজ পাখিদের বঞ্চিত করে
মুখের
গ্রাস নিল কেড়ে —
য়ুরোপে
ভেসে গেলো।
সমুদ্রের
ঢেউয়ে ভেসে
য়ুরোপ
মার্কিন আকাশে আকাশে
শীতের
ঝরাপাতার মতন
উড়তে লাগল
পতপত করে টাকা,
টাকা আর
টাকা, ধনতন্ত্রের পরম
রতন!
সার গেল
মাছ গেল গেল গেল সব গেল
রয়ে গেল
ক্ষুধার্ত মানুষ আর সমুদ্র অভিসারী
হাজারো পেলিক্যান —
কী দুরন্ত
মৃত্যুর মিছিল!
মাছুয়া
নৌকো ঘিরে পেলিক্যান উড়ে যায়
খাদ্যের
টানে সমুদ্র অভিসারে গভীর থেকে গভীরে
ডানা ভারি
হয়ে হায় পড়ে যায়
নিষ্ঠুর
সমুদ্র লেখে মৃত্যু পরোয়ানা।
দলে দলে চলে
তারা সড়ক ধরে শহরে
ফেরে না
তো আর,
লিমার পথে
অসংখ্য পেলিক্যান ঘুরে মরে পড়ে থাকে।
আগ্রাসী
ধনতন্ত্র রুদ্র রূপে হাসে
গড়ে ওঠে
সভ্যতার পতনের ইতিহাস!
পেরুর
ভ্রমণকারীগণ,
দেখেছো কি
মৃত নগরীর সারি?
ঝুলছে
এদিকে ওদিকেও বোবা টেলিফোনের তার,
প্রেতনগরীতে
রাবিশের স্তুপ, মৃত্যুর গহ্বর?
বুজে
যাওয়া নাইট্রেট রেলপথ,
বিস্ফোরণে
বিস্ফোরণে নাইট্রেট জমিনের কঙ্কাল?
সাদা
পাহাড়ের স্তুপীকৃত জঞ্জালে আচ্ছন্ন নগরী?
ভয়াল
শীতের শীতল বাতাসে সেখানে
কবরস্থানে
কেঁপে কেঁপে ওঠে ক্রুশগুলো!
হায়রে সভ্যতা!
মৃত্যুর
ওপার থেকে—
চেয়ে থাকে পাখি আর মানুষের চোখ।
বিবৃতি
সমুদ্র
সৈকতে হাঁটছি পায়ের ছাপে
এঁকেছি
আঁকছি আলপনা বহুদিন
উন্মত্ত
ঢেউ সেসব মুছে দিয়ে যায়
রাতদিন
অবিরাম, কতদিন হলো?
এই আমাকে
ঘিরে কতজন এলো
কতজন
নতমুখে চলে গেল
তার হিসেব
মেলানো ভার।
মাঝে মাঝে
পুরনো তমসুকে তাদের নাম
এলোমেলো
ভেসে উঠে ডুব দেয়
অন্তহীন
সমুদ্রের উত্তাল জলে।
রাত্রিকেও
আরেক সমুদ্র মনে হয়
এ সমুদ্র
এলোমেলো সবকিছু থরে থরে
সাজাতে
মগ্ন ম্লান নক্ষত্রের আবছা আলোয়
কতকিছু
চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মহাকাশে উড়ে যায়
ফেরেনা
কখনো যেন আদি অন্তহীন এক রূপকথা।
প্রাচীন
নক্ষত্রও চূর্ণ হয়ে মায়াবী পৃথিবীর টানে
স্তরে
স্তরে জমা হয় অনুপম মৃত্তিকার নরম বুকে।
গড়ে তুলে
আরেক রূপকথা রূপসী পৃথিবীর বুকে।
কত
বিদ্রোহ হাজারো যন্ত্রণা লিখে চলে দিনরাত
অব্যাখ্যাত
নব নব কাহিনী বিন্যাসে নতুন ইতিকথা।
অনুভূতির
প্রথম প্রভাতে জেনে যাই
প্রতিবাদ
প্রতিরোধ একমাত্র পথ আছে শুধু চলাচলে
সুরক্ষিত
পৃথিবীর পথে চলাকালে অন্য কিছু নেই
আমার
প্রতিটি কবিতা তাই সেই সার সত্যের আনুগত্য
নিয়েছে
মেনে, এও জেনে গেছি এই
সত্য সাধনার পথে
কাল
সমুদ্রের তীরে একদিন গড়ে উঠবে আলোকিত
অপরূপ
শাশ্বত জীবনের মায়াঘেরা কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী!
সেই কবে
থেকে কত বিপ্লব বিদ্রোহ প্রাণের অপচয়
একটি
সোনালি স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষায় সংগঠিত হয়েছে
হেরেছে মানুষ পিছুপা হটেনি, তাই সেই মানুষ
অনাগত
ভবিষ্যতের নিশ্চিত ফলক প্রতিষ্ঠায়
এগিয়ে
চলেছে চলবে সুদৃঢ় প্রত্যাশায়!
শেষ বন্দরের ঠিকানা
শেষ
বিকেলের আবছা ম্লান আলো
ঝাউয়ের
বনে আলপনা আঁকে নিরিবিলি
সমুুদ্র
উথালপাথাল ঢেউ তোলে ভাঙ্গে
একলা
বালুবেলায় বুকের ভেতর হু হু করে
দিগন্তে
তাকিয়ে দেখি হারিয়ে গেছে সবকিছু
আক্রোশে ধেয়ে আসে কাল কেউটে আঁধার
সারি সারি
ঝাউগাছ শুয়েছে দেখো অবলীলায়
সারি সারি
নারী লোধ্ররেণু মুখে কেশদামে জুঁই মালা
নিস্তেজ
দেহে তপ্ত বালু মেখে শুয়েছে বালুকাবেলায়
রাশি রাশি
নষ্ট দেহে মুক্তো বুকে কাতরাচ্ছে ঝিনুক
পা ডোবা
সামুদ্রিক নোনা জলে কতনা অসহায়
শেষবেলায়
অবসাদে আমার দুচোখ মৃত জোনাকি
এমনি এক
আশ্চর্য প্রহরে মৃত কলম্বাসের আত্মা
নড়েচড়ে
জেগে ওঠে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয়
শেষ
দিগন্তে কোন অজানা দেশ দারচিনি গন্ধ নিয়ে
আবারো
ইঙ্গিতে টানে চৌম্বকীয় আকর্ষণ বলয়ে
নবতম এ
উপকূলে পৌঁছে গেলে মহাজাগতিক পথ
মহাবিশ্বের
অন্যপার্শ্বে শেষ বন্দরের ঠিকানায় পৌঁছায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন