বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>





কালিমাটি অনলাইন / ৭০  
  

অনেকদিন থেকেই একটা দ্বন্দ্বে আছি, সময় কি মানুষকে প্রভাবিত করে, নাকি মানুষ সময়কে প্রভাবিত করে? সমঝদাররা বলেন, সময় তার নিজের নিয়মে চলে, নিজের ছন্দে চলে, সে কারোর ওপর নির্ভরশীল নয়, সোজা কথায় সময় কারও ধার ধারে না। কথাটা আপাতবিচারে ঠিকই। সময়কে তো কেউ সৃষ্টি বা নির্মাণ করেনি, আবার কারও ক্ষমতা নেই তার গতি রুদ্ধ করার এবং তাকে ধ্বংস করার। সময় আদি অন্তহীন। তার কোনো সামগ্রিক মাপজোকও করা যায় না। যদিও আমরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সময়কে মাপি, তাকে ভাগ করি অনেক  অনেক মাপকাঠিতে। অসীম ব্রক্ষ্মান্ডের একটি ক্ষুদ্র গ্রহের বাসিন্দা আমরা নিজেদের বিচারবুদ্ধিতে সুবিধার জন্য আমাদের সীমার অন্তর্গত বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্রহ উপগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত সময়কে নিজেদের বাগে আনার চেষ্টা করি।  সূর্য নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রহ পৃথিবীর ক্লান্তিহীন ঘূর্ণন এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে উপগ্রহ চাঁদের অক্লান্ত ঘূর্ণন, আমাদের সময়ের মাপকাঠি নির্ধারণে সহায়তা করেছে। আমরা নিজেদের প্রয়োজনে সময়কে বাঁধার অভিপ্রায়ে তাই নির্দিষ্ট করেছি কিছু একক, যেমন – দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দ, সহস্রাব্দ... অন্যদিকে ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, পল, অনুপল... নির্দিষ্ট করেছি চান্দ্রমাস, চান্দ্রবছর, সৌরমাস, সৌরবছর...

তা না হয় করলাম, সময়ের তাতে থোড়াই কিছু এলো গেলো কি? কিন্তু আসল  কথাটা হচ্ছে, মানুষ কি আদৌ সময়কে প্রভাবিত করতে পারে, অথবা সময়ই মানুষকে প্রভাবিত করে? উদাহরণ বা নমুনা হিসেবে যেমন কিছু কিছু সময়ের   কথা উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যা মানুষই নির্ধারিত করেছে, যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে আদিযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিকযুগ, উত্তর আধুনিকযুগ, প্রাক ঔপনিবেশিকযুগ, ঔপনিবেশিকযুগ, নয়া ঔপনিবেশিকযুগ ... যেমন চৈতন্য  পূর্ববর্তীযুগ, চৈতন্যযুগ, চৈতন্য পরবর্তীযুগ, ফোর্ট উইলিয়ামযুগ, বঙ্কিমযুগ, রবীন্দ্রযুগ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যদি এইসব যুগের কথা স্বীকার করতে হয়, তাহলে সমকালীন সময়ে এইসব যুগের প্রভাবের কথাও স্বীকার করতে হয়। তা সে সাহিত্যের ক্ষেত্রেই হোক বা সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান,  ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা সব সব ক্ষেত্রেই। অর্থাৎ অনন্ত  সময়ের ক্ষমতার সঙ্গে সীমিত মানুষের ক্ষমতার তুলনার মতো বোকামি না করেও একথা বলা যায় যে, সর্বগ্রাসী সময় যতই শক্তিশালী হোক না কেন মানুষের মস্তিষ্কেও আছে অপরাজেয় দুর্বিনীত সৃষ্টিশীল মনন ও মেধা। আর তাই সে হয়তো সময়কে বাঁধতে পারে, প্রভাবিতও করতে পারে!

সম্পাদকীয় লিখতে বসে সময় সম্পর্কিত এই দ্বন্দ্বের কথা স্বভাবিক কারণেই এসে গেল আমাদের সমকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা সাধারণ মানুষ  মনে করি যে, যে সময়ে আমরা এই পৃথিবীতে বসবাস করছি, তা ক্রমশই থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে। তা সে প্রাকৃতিক সমস্যার কারণেই হোক বা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণেই হোক। পৃথিবীর বাতাস ক্রমশ দূষিত হচ্ছে, জল দূষিত হচ্ছে, মাটি দূষিত হচ্ছে, উৎপাদিত ফসল দূষিত হচ্ছে এবং এই সামগ্রিক দূষণের জন্য মূলত দায়ী মানুষই। অন্যদিকে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে মানবিকদূষণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণকে কেন্দ্র করে হানাহানি; তথাকথিত জাতীয়তাবোধকে কেন্দ্র করে লড়াই, বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজার দখলের জন্য সংঘটিত যুদ্ধ সমকালীন সময়কে কলুষিত করে তুলেছে, নষ্ট করে তুলছে। আর এই নষ্ট সময়ে মানুষ এখন অন্য মানুষের প্রতি প্রেমহীন, আস্থাহীন, বিশ্বাসহীন, নির্ভরতাহীন। এ এক অসহনীয় অস্থিরতার সময়। এবং বলা বাহুল্য, বলা বাহুল্য, এর জন্য একদিকে যেমন দায়ী ঘৃণ্য কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন কিছু মানুষ, গোষ্ঠি, চক্র ও আঁতাত; অন্যদিকে তেমনই দায়ী তাদেরই পদলেহনকারী কিছু জনসাধারণ। যাদের কখনই ক্ষমা করতে পারবে না অনাগত সময়ও। ভাবতে কষ্ট হয়, মূর্খ কালিদাসের যুগের বুদ্ধি ও বিবেচনা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারলাম না!

কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনের সত্তরতম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক এই ব্লগজিনকে আরও সমৃদ্ধ ও মননশীল করে তুলতে। সবারই আন্তরিক সহযোগিতা পাচ্ছি। শুধু একটাই দুঃখ, প্রকাশিত লেখাগুলি সম্পর্কে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের অভিমত লেখাগুলির ইনবক্সে খুবই কম পাচ্ছি। আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনাদের অভিমত অবশ্যই জানাবেন এবং আমাদের যে কোনো ভুলত্রুটি সম্পর্কে অভিত করবেন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




কবিরা আমাদের সম্পত্তি, আগ্রাসনের অস্ত্র নন : রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কের সাম্প্রদায়িকীকরণ

                                               
আমাদের ব্লকের সেক্রেটারিমশায় হপ্তাদুয়েক আগে বললেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ও সুকান্ত, এই তিন কবিকে নিয়ে কিছু অজানা কথা লিখতেদূর! তাই হয় নাকি! এখানে সবাই শিক্ষিত। আর এই অতিজানা কবিদের বিষয়ে কার কী জানা, অজানা, আমি কী করে জানবো? কালিমাটির কথনবিশ্বে তো  ব্যাপারটা আরো ঘোরালো। এখানে সবাই সব জানেন। তাও ওঁদের যা জানালাম তার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক অংশটির অনেকটা অনেক আগে কালিমাটিতে লিখেছিলাম। একটু চর্বিতচর্বণ দিয়ে শুরু করি।

অনেক আধুনিক বাঙালিই হয়তো জানেন না যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পঁচিশ বছর পরেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বাংলা রচনার একটি উপযোগিতাই খুঁজে পেয়েছিলেন। তা হলো বাংলা এম এ পরীক্ষায় শুদ্ধ বঙ্গানুবাদ করতে দেওয়ার জন্য তাঁর অশুদ্ধ বাংলার নমুনা প্যাসেজ হিসেবে? (দ্রঃ E. P. Thompson, Alien Homage: Edward Thompson and Rabindranath Tagore (Delhi: Oxford University Press, 1993, পৃঃ ৫৩-৫৪, ৬৬) আর নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মত ছিল যে রবীন্দ্রজন্মোৎসবের সোচ্চার বাৎসরিকের গণ্ডগোলের মধ্যেই তাঁকে, মানে তাঁর লেখাকে ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়া আরও বীরগতিতে চলবেরবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালের আগের তেরো বছর ধরে নোবেল পাওয়া সবার অনেক উপরে, একদিকে গ্যেটে আর এক দিকে বিত্তর উগো-র মাঝখানে থাকবেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনো তাঁর রসোপলব্ধির প্রাপ্যটা পাবেন না সমস্যাটা কেবল অংশতঃ তাঁকে যে কোনো ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করার কষ্টসাধ্যতা। কিন্তু আরো বড় সমস্যা হলো তিনি বঙ্গদেশেও নিরাপদনন। বঙ্গদেশে তাঁর আসল ব্যক্তিত্বটি দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মৃত হবে না। আর তাঁর সাহিত্যকর্ম এক মাটির নিচে পোঁতা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মত রয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে কেবল এই জড়মোহটা, বাঙালিদের গলার চারদিকে ঝুলে, কোলরিজের কবিতার প্রাচীন নাবিকের গলায় ঝোলা অ্যালব্যাট্রস-টার মতো, পাপের শাস্তি হিসেবেনিজের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ সহ-বাঙালিদের অধিকাংশের দ্বারা প্রায় পরিত্যক্ত হয়েছিলেন, কারণ তিনি যা লিখতেন সেটা তাঁদের মাথার উপর বেরিয়ে যেতো। এমন কি যে অল্পসংখ্যক অনুরাগী তাঁর বিগ্রহায়ন করতেন তাঁরাও সেটা বুঝতেন না। এখন অবস্থাটা আরো খারাপ, কারণ বাঙালি জীবন আর সাহিত্যিক ঐতিহ্য এত আলাদা হয়ে গেছে যে, তাঁর লেখ্যবিষয় আর তার  শৈলী সমসাময়িক বাঙালিদের কাছে অল্পবিস্তর অনধিগম্য হয়ে গেছে।তাঁর প্রবন্ধে একটু পরেই নীরদচন্দ্র বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে যখন  রবীন্দ্রনাথের কাব্যেসাহিত্যে অর্থ ও সম্পদ খুঁজতে পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক খনক লাগাতে হবে (দ্রঃ Nirad C. Chaudhuri,Thy Hand, Great Anarch! : India 1921-1952, London: Chatto &Windus, 1987, পৃঃ ৬৩-৬) তার ফলে পাঠক খুঁজতে রাজশেখর বসুর ভাষায় কাকদন্তগবেষণতথা কাগের দাঁত কটা আছে, তার পথ ধরতে হবে (রাজশেখর বসু, ‘বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি’, রাজশেখর বসু প্রবন্ধাবলী, সঃ দীপঙ্কর বসু, কলকাতা মিত্র ও ঘোষ, ২০১৪, পৃঃ ১৩৯-৪৮, বিঃ ১৪৭)

তাতে ক’রে কি আমাদের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, নজরুলকে নিয়ে মাতামাতি করতে, তাঁদের জাতীয় সম্পত্তি ক’রে নিতে, পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে অসুবিধে হয়েছে? হয়নি, কারণ গ্রন্থের অপঠিত প্রভাব পঠিত প্রভাবের চেয়ে কম নয়। বিশ্ববিখ্যাত, প্রবাদপ্রতিম পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট চিন্তাবিদ জ্যাক দেরিদাকে ১৯৯২ সালে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিগ্রি দেওয়া নিয়ে ঝড় উঠেছিল। The Monist জার্নালের সম্পাদক  Barry Smith-এর সঙ্গে ১৭ জন দার্শনিক বলেছিলেন, ওঁর লেখা দর্শন পদবাচ্যই নয়। José Benardete (১৯২৮- ২০১৬) ২০১৬ সালের ২রা মার্চ তাঁর একটি পোস্টে বলেছিলেন, ‘It is sometimes noted that it is extremely unlikely that most of the signers had read much more of Derrida than I had by the time I left graduate school. What is not noted is that it is extremely unlikely that these signers had read much of each other’ (https://digressionsnimpressions.typepad.com/digressionsimpressions/2016/03/the-letter-against-derridas-honorary-degree.html, অদ্য ৩১শে জুলাই ২০১৯ প্রবিষ্ট) যদিও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাম্মানিক ডিগ্রি প্রদান উপলক্ষে দেওয়া তাঁর ভাষণকে অনেক শ্রোতার মতো Candida Clark  শুনে বলেছিলেন, ‘Cambridge epiphany (‘Jacques Derrida, a Cambridge  Epiphany’, https://www.opendemocracy.net/en/2181/,অদ্য ৩১শে জুলাই ২০১৯ প্রবিষ্ট) তাই দেখে আরেক পোস্টস্ট্রাকচারালিস্টNicholas Royle, বলেছিলেন ‘a writer’s work can be received without being read: texts have without being read’ (After Derrida, Manchester: Manchester University Press, 1995, pp. 2-7, 160)সমসময়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থা সহ-বাঙালিদের কাছে এর থেকেও খারাপ ছিল। নোবেল পেয়েও; না পেলে যে কী হতো তা তাঁর ছবির গল্প থেকেই সবাই জানেন।  

ভুল বকছি? কজন বাঙালি জানেন যে, সেই সময়কার  এক বরেণ্য সাহিত্য-সমালোচক আর বিদ্বান দীনেশচন্দ্র সেন অনামা থাকার শর্তে ই.জে.টি (টমসন)-কে লিখলেন যে, বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপের হাতে তুলে  দেয়নি। বরং ইউরোপই তাঁকে দিয়েছে বাঙালিদের হাতে। ফলে তাঁকে প্রশংসা করেইউরোপীয় পণ্ডিতরা নিজেদের দান’-এরই প্রশংসা করছে। আরো দুঃখের কথা, তিনি ই.জে.টি.কে লিখলেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথের আগ্রাসী ভক্তদের যত ভয় করতেন, ততটা বোধ হয় ইংলণ্ডে টোরিরা হুইগদের বা ক্রমওয়েলের আয়রনসাই্ডসদেরও করতেন না। ভদ্রলোক হিসেবে ই.জে.টি.  তাঁর ১৯২৬ সালে লেখা Tagore বইয়ের প্রথম পরিশিষ্টে চিঠিটির কিয়দংশ  নাম না করেই উদ্ধৃত করেছেন। সেটি আবার ই.পি.টি উদ্ধৃত করেছেন তাঁর বইতে (দ্রঃ Dineshchandra [Sen]to E.J. Thompson, তারিখবিহীন (1922) and 6 November 1922; EJT,Tagore (1926), parts of Sen’s Letter in Appendix A, pp. 307-08; যত্র উদ্ধৃত E. P. Thompson, Alien Homage: Edward Thompson and Rabindranath Tagore, Delhi: Oxford University Press, 1993, পৃঃ ৫৩-৫৪) সব্বাই হয়তো এত লুকোছাপাও করেন নিসুজিতকুমার সেনগুপ্তর লেখা জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল বইতে লিখছেন যে, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তাঁর মিঠেকড়া বইতে বলেছেন, কেবল বাপের টাকার জোরে তাঁর ওইসব লেখা বিকোলো। আর বাংলা গোয়েন্দা গল্পের আদিপুরুষ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তো  বলেই দিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই বিদেশি সাহিত্যের অঋণস্বীকারী  নক্‌লি! ই.জে.টি. বোধহয় জানতেন না এঁদের নাম। জানলে বেচারা দীনেশবাবুকে নিয়ে পড়তেন না।  
                
কিন্তু ওই যে বললাম, গ্রন্থের অপঠিত প্রভাব পঠিত প্রভাবের চেয়ে কম নয় (‘texts have without being read’)রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি করার জন্য আমাদের ক’জনের জানতে হয়েছে যে, যে গীতাঞ্জলি-কে লিয়ে নোবেল  পেরাইজ পেয়েছিলেন (সেটাও তো হারিয়েই ফেললাম!), তার সঙ্গে বাংলা গীতাঞ্জলি-র মিল খুব কম! বাংলা গীতাঞ্জলি-র ১৫৭টি গান/কবিতা থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলি-তে (Song Offerings) মাত্র ৫৩টি রবিন্দরনাথ ঠাঁই দিয়েছিলেন। Song Offerings-এর ১০৩টে কবিতার বাকি পঞ্চাশটা নৈবেদ্য আর খেয়া থেকে নেওয়া। আর সেগুলো গদ্যানুবাদ কেবল নয়, প্রায় আলাদা কবিতাইআম বাঙালিরা শেষ সপ্তক, পরিশেষ, পুনশ্চ-র কটা কবিতা পড়েছেন? উইলিয়াম রাদিচের গীতাঞ্জলি সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের ও গল্পগ্রন্থের অনুবাদ (William Radice, (trans.) Rabindranath Tagore, Selected Poems (Harmondsworth: Penguin Books, 1985; Radice, (trans.) Rabindranath Tagore, Selected Short Stories (Harmondsworth: Penguin Books, 1991); কেতকী কুশারী ডাইসনের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ (Rabindranath Tagore: I Won’t Let You Go, Selected Poems,  New Delhi: UBS Publishers’ Distributors Ltd., 1992); মার্কিন কবি ওয়েন্ডি বার্কার ও শরনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগ্ম সম্পাদনায় শেষ সপ্তকএর কবিতাগুলির অনুবাদ (Wendy Barker and Saranindranath Tagore, Rabindranath Tagore: Final Poems (New York: George Braziller Inc, 2001); দত্ত ও রবিনসন-এর রবীন্দ্রগল্পের অনুবাদ (Krishna Dutta and Andrew Robinson, Rabindranath Tagore: The Myriad Minded Man (London: Bloomsbury, 1995); ইত্যাদির (আরো কয়েকটি আছে) উপর করেভর করেরবীন্দ্রনাথ অবশেষে নোবেলের পরেই তাঁর নিজের এবং তাঁর বেছে নেওয়া চক্রের (coterie)-র জঘন্য অনুবাদের ফলে হারিয়ে যাওয়ার রাহুদশা কাটিয়ে আবার বিদেশে নিখাদ কবি হিসেবে কিছু কল্কে পেলেনআর আমরা সিরিয়ালে, পাড়ার ক্লাবে, ব্লকের অনুষ্ঠানে, ফেসবুকে, কবির সেই সব বালখিল্য কবিতা নিয়ে আদিখ্যেতা করছি, যেগুলোকে নিয়ে তিনিই হয়তো পরে লজ্জিত ছিলেন।

এবার আসি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সম্পর্কের প্রসঙ্গে।





নজরুল

যাঁরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইত্যাদি করেন, তাঁরা জানেন যে কিছুকাল ধরে ওই বাংলায়, এমনকি এই বাংলায় বেশ কিছু মুসলিম উগ্রবাদী একটি পোস্ট ছড়াচ্ছেন। এঁদের একজন আব্দুল হাকিম আবির, ১০ই মে, বিকেল ৪-৪০-এ লিখছেন, আমি  উদ্ধৃত করছি, হুবহু, ভুল বানান, যতিচিহ্নের গণ্ডগোল, বন্ধনীর মধ্যে লিঙ্ক সমেত। তারিখ থেকে বুঝতেই পারছেন রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে--   
“কাজী নজরুল ইসলাম কে পরিকল্পিতভাবে বিয়ে করানো হইছিল এক হিন্দু মেয়ের সাথে। সেই মেয়ে নজরুলের লেখাগুলো চুরি করে রবীন্দ্রনাথকে দিত। ঐসব চুরি করা লেখা দিয়েই ত রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাইলো। আর নজরুল যাতে এসব কথা প্রকাশ করে দিতে পারে তাই তাকে ধুতুরা ফুল খাইয়ে পাগল করে রাখা হল সে হিন্দু মেয়ের সাহায্যেই। এসব সত্য ইতিহাস আজ প্রকাশ করার সময় এসেছে”।   (‘https://www.facebook.com/photo.php?fbid=639425896540836&set=a.148423462307751&type=3&theater)

এক সজ্জন বাংলাদেশি ফেবুবন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে আমি এটা প্রবল হেসে পোস্ট করলাম ফেবুতে। অম্নি কিছু হিন্দু উগ্রবাদী ধেয়ে এলেন। বাংলাদেশ হওয়ার আগে ওখানকার তৎকালীন পাকিস্তানিরা নজরুলের সম্মানে কী করেছিল; নজরুল যে আসলে ভারতের; আর পাকিস্তান আগে ও পরে বাংলাদেশ তাঁকে ডাকাতি করে নিয়ে গেছে; ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে বলতেব্যস! পড়ে গেলো ছাঁচে! কারুর মাথায় এলো না যে ২৫শে মে ১৮৯৯ সালে জন্মানো নজরুল রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার সময় তেরো বছরেরটি ছিলেন। তাঁর কবিখ্যাতি তুঙ্গে ওঠে বিদ্রোহী  প্রকাশ পাওয়ার পর, ১৯২২ সালে। আর তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল ১৮-ই জুন ১৯২১-এ (বা মতান্তরে হয়নি, দেখুন তাঁর নাতনির কথা, https://www.anandabazar.com আনন্দ প্লাস, ১৩ই মার্চ, ২০১৫) দৌলতপুরের নামী প্রকাশক আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিস আসার খানম তথা সায়েদা খাতুন-এর সঙ্গে। নার্গিস নামও নজরুলের দেওয়া। সে যাইহোক, বিয়ের রাত্রেই আলী সাহেব বিয়ের চুক্তিপত্রে তাঁর আজীবন দৌলতপুরে থাকার শর্ত মেনে নিতে প্রকাশ্যে পীড়াপীড়ি করায় নজরুল ওই বাড়ি থেকে চলে আসেনএর পিছনে অবশ্য অন্য কারণও থাকতে পারে। ১৯২১-এ কুমিল্লায় গিয়েই ব্রাহ্ম সমাজের আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দোলোনা সংক্ষেপে দুলী ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় দুখু মিয়াঁর! তাঁর জন্ম ১০ই মে, ১৯০৮প্রমীলা নামও  নজরুলের দেওয়া। পরে ১৯২২-এ কোনও সময় প্রণয়। আর পরিণয় ২৫শে এপ্রিল ১৯২৪এই ‘অসামাজিক’ বিধর্মী বিবাহের ফলে নজরুল এবং প্রমীলা দুজনেই গোঁড়া মুসলিম আর গোঁড়া ব্রাহ্ম সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সামনে পড়েন। ব্রাহ্ম সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে প্রবাসী পত্রিকা অফিস থেকে প্রধানত নজরুল-বিরোধিতার জন্য সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি প্রকাশ করা হয়। নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় এই ঘটনায় দুঃখের প্রকাশ আছে--
গুরু ক, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা।
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি-‌
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক, আড়ি চাচা!
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা।
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর 'মোল-লারা' 'ন হাত নেড়ে,
'দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!'
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
'আম পারা'-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে, 'পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা'ত-নেড়ে!

সেই আক্রোশ এখনও চলছে। বেচারা প্রমীলা! সারাজীবন স্বামীর শুশ্রূষা করে মরার পর এক বয়োজ্যেষ্ঠ কবির নিজের বিয়ের এগারো বছর আগে পাওয়া নোবেলের জন্য মাত্র সাড়ে চার দশক আগে থেকে শুরু হওয়া কবিতা পাচার করার অপবাদ সইতে হচ্ছে। ১৯০৮-এর জাতিকা প্রমীলা নজরুলের ১৯০১ সালের নৈবেদ্য, ১৯০৬ সালের খেয়া, আর ১৯১০ সালের গীতাঞ্জলির কবিতা সাপ্লাই করছেন, যাতে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নজরুলের বারো কি তেরো বছরে নোবেল প্রাইজ পান। বেড়ে নয়?

বরং কিছু অপবাদ পেতেও পারতেন রাণু সোম, নজরুলের আরেক আগেকার প্রেম, প্রসিদ্ধ গায়িকা, পরে প্রতিভা বসু নামে প্রসিদ্ধতর লেখিকা, কবি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী! ঢাকার মেয়ে রাণু সোম, আর ঢাকার তখন আরেক নাম ছিল ‘সোনার গাঁ’ফলে নজরুল তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই গান লিখলেন ‘কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী, এ কোন সোনার গাঁয়’; আর রাত না পোয়াতেই ছটফট করে’ তাঁকে বাড়ি এসে শিখিয়ে গেলেনরাণুর সঙ্গে নজরুলের আদি প্রণয়ের জ্বালা ও মর্মব্যথা আর তার উত্তরণের গল্প আছে বুদ্ধদেব বসুর রাত ভরে বৃষ্টি (১৯৬৭) উপন্যাসে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে সাহিত্য ক্ষেত্রে মর্যাদা দিয়েছিলেন। নজরুল স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দশ বছর পরে ১৯৫২ সালে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধকপ্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘নজরুলের দোষগুলি সুস্পষ্ট, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সমস্ত দোষ ছাপিয়ে ওঠে; সব সত্ত্বেও একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি। নজরুল ইসলাম নিজে জানেননি যে, তিনি নতুন যুগ এগিয়ে  আনছেন; তাঁর রচনায় সামাজিক রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে, কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই”। কিন্তু নজরুল প্রতিভা বসুর গানের প্রতিভাকে বাড়তেও দেন  নি! বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভালো সম্পর্ক ছিল, যদিও কল্লোল যুগের অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের মতোই তিনিও রবীন্দ্রনাথের ‘মায়াজাল’ কেটে বেরোতে চেয়েছিলেন। আর রাণুর স্বামীও ছিলেন। তাহলে রাণুর হাত দিয়েই রবীন্দ্রনাথের কাছে নজরুলের কবিতা পাচার হতে পারতো, আব্দুল হাকিম আবিরবাবু!

কিন্তু সেখানেও তো মুশকিল। ১৯১৩-তে বুদ্ধদেব বসুর বয়স পাঁচ! আর রাণুর বয়স মাইনাস দুই! ১৯০১ সালের নৈবেদ্য, ১৯০৬ সালের খেয়া, আর ১৯১০ সালের গীতাঞ্জলি-র কবিতা পাচার করার পক্ষে বড্ড কম।

বন্ধু, আব্দুল হাকিম আবিরের এই আজব কথাগুলো লিখলাম এই কারণে যে, আমরা কবিকে, তাঁর কবিতাকে না পড়েই নিন্দে প্রশংসা সব করি। আব্দুল হাকিম আবির আমাদের মধ্যেও আছেন, সব দিকেই, উঁচু জায়গাতেই! কেউ বিদ্যাসাগরের সহজ পাঠ-এর কথা বলেন; কেউ মাহেশের রথে রাধারানীর প্রসঙ্গে কপালকুণ্ডলা-কে আনেন। কী আর করা যাবে? একথা বলছি না যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল না। কোন সমসাময়িক মহারথদের মধ্যে না থাকে! তবে সেটা এমন ছিল না যে  ডস্টয়েভস্কি আর টুর্গেনিভের কোনোদিনই পরস্পরের মুখ না দেখার মতো।  যেটুকু সমস্যা ছিল তার কিছুটা তাঁদের কাব্যাদর্শের তফাতের কারণে, আর কিছুটা সমসাময়িক কবিদের চুকলির কারণে। ঠিকই যে বিদ্রোহী-বিপ্লবী কবিতা লিখতে গিয়ে নজরুল ‘তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা শুরু করেছে(ন)’কিন্তু সে তো এই কারণে যে রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না যে, নজরুল তাঁর কবি প্রতিভাকে যথার্থ সৃষ্টি কাজে না লাগিয়ে অন্য বিষয়ে নষ্ট করেন। এজন্যই নজরুলকে তিনি একদিন (সঙ্গে ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচতে নিষেধ করেছিলেন। এই কথায় নজরুল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই অভিযোগে নজরুল লেখেন, ‘গুরু ক, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা’কিন্তু সেই সময়টা নজরুলের দ্বিতীয় বিবাহের পরের পরের সংক্ষুব্ধ সময়, ওই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাতেই তাঁকে লিখতে হচ্ছে, প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, “তুমি হাঁড়িচাঁচা”’কিন্তু সেখানেও তো তিনি বলছেন ‘মাথার উপর রয়েছেন রবি’! যদিও হয়তো কল্লোল গোষ্ঠির কথা ভেবে ‘রয়েছে সোনার শত ছেলে’-ও বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের আরেকবার সমস্যা হলো যখন নজরুলের রক্ত অর্থে খুনশব্দ ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন, এ কথা রটিয়ে দেওয়া হলো, আর তাতে ব্যথিত হয়ে নজরুল বললেন, বড়র পিরিতি বালির বাঁধ তাতে আবার ব্যথিত হলেন রবীন্দ্রনাথকিন্তু পরে যখন রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন যে, তিনি নজরুলকে সে কথা বলেননি, তাঁর মন্তব্য ছিল  কোনো উদীয়মান কবির জন্য, তখন মিটে যায় এই সমস্যা। মনে রাখতে হবে যে শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাস ও মোহিতলাল মজুমদারেরা সেই সময় নজরুলকে অপদস্থ করতে উদ্গ্রীব।সন্জীদা খাতুন বলেন, ‘১৯২০- ১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে এই একটি খুনের মামলাঅভিমান পর্ব ছাড়া আর কোনো ছেদ চোখে পড়ে না’কারণ, অস্বীকার করা যাবে না যে তাঁরা দুজনেই একযোগে ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদ করেছিলেন। নজরুল তাঁর কাণ্ডারি হুঁশিয়ারকবিতায় ‘“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?’ লেখার পর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;/ ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ’ অথবা ১৯২৩ সালে নজরুল যখন জেলে রবীন্দ্রনাথ বসন্ত নাটকটি উৎসর্গ করলেন তাঁকে তাঁর ধামাধরা অনেকের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। তাঁর বক্তব্য ছিল, জাতির জীবনে বসন্ত এনেছেন যে নজরুল, এ নাটকটি তাঁকে  উৎসর্গ করাই সমীচীন। এর পরে জেলারের অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল অনশন শুরু করেন। কলকাতার পত্রিকায় খবর বের হয় যে, ১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু ক’রে ১৪ দিন ধরে তিনি অনশনে আছেন। এ খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করেন নজরুলকে, ‘অনশন ছেড়ে দাও। আমাদের সাহিত্যে তোমাকে দরকার।কিন্তু সে টেলিগ্রাম ইংরেজরা পৌঁছে দেয় নি নজরুলকে।

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর দেশে চলে যান। ব্যথিত নজরুল রবিহারাকবিতাটিতে, ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত-পথের কোলে লেখা ছাড়াও গানে লিখলেন, ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, আর রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী নজরুল স্বকণ্ঠে দিলেন আকাশবাণী কলকাতা থেকে (ঋণস্বীকার — ‘পাঠচক্র, রবীন্দ্র-নজরুল: সম্পর্কের টুকরো গল্প’, https://www.prothomalo.com বাংলাদেশ বিবিধ, ২৯শে আগস্ট ২০১৫, ৩১শে জুলাই ২০১৯ প্রবিষ্ট)।

এর অনেক আগে হাবিবুর রহমান স্বপন যেমন বলছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪০০ সালকবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষের পরের পাঠককে বসন্তের পুষ্পাঞ্জলি পাঠিয়েছেন’ উত্তরে কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ১৪০০ সালকবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি। আজি হতে শতবর্ষ আগে/ কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে/ শত অনুরাগে,/ আজি হতে শতবর্ষ আগে!’ হাবিবুর আরো লিখছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ - রবীন্দ্রনাথ রচিত গোরাউপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধা সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালকের’ ভার দেন।

হাবিবুর রহমান আরো জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায়চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘অগ্নি-বীণাআগমনীকবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’... এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। ১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে দে গরুর গা ধুইয়েগাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন, ‘গুরুদেব আমি এসেছি’। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন  বিদ্রোহীকবিতাটি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহীকবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস ১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ স্মরণসভায় নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন সত্যকবিকবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নজরুলকে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ করায় তখনও কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন’ (‘গুরু-শিষ্য সম্পর্ক : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’, https://www.risingbd.com/travel-news/50763, ২৩শে মে ২০১৪ ৩১শে জুলাই ২০১৯ প্রবিষ্ট)

নজরুল অনেকদিন তাঁর কাছে না গেলে নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন। কতদিন তাঁর তপোবনে (শান্তিনিকেতন) গিয়ে থাকবার কথা বলেছেন। ‘হতভাগা আমি তাঁর  পায়ের তলায় বসে মন্ত্র গ্রহণের অবসর করে উঠতে পারলাম না। বনের মোষ তাড়িয়েই দিন গেল। (‘রবীন্দ্র স্মরণ রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক’, https://www.risingbd.com/travel-news/50763,৭ই মে, ২০১৬, ৩১শে জুলাই ২০১৯ প্রবিষ্ট)।
 
বন্ধু, আব্দুল হাকিম আবির ও তাঁর সহযোগী কিছু ‘হিন্দু’, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের সম্পর্কের প্রশ্ন এলেই পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে লেগে যান, তাঁদের জন্যে এই সম্পর্কের তথ্য বাংলাদেশি কাগজ থেকে দিয়েছি। তাঁরা নিজ নিজ মসজিদে/মন্দিরে চলে যান, আর শতহস্ত দূরে থাকুন এঁদের থেকে। এঁরা আপনার, আমার, আমাদের সম্প্রদায়ের, দেশের, রাষ্ট্রের নন, বসুন্ধরার সম্পত্তি!  


শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি -



(৪)

"...ছেড়ে দিয়েছে বলেই আমি সোনার মাছি জড়িয়ে আছি
দীর্ঘতম জীবন এবার তোমার সঙ্গে ভোগ করেছি
এই রোমাঞ্চকর যামিনী-সোনায় কোনো গ্লানি লাগেনা
খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম..."

টাটানগর স্টেশন থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে যাবো মনোহরপুর। কিরিবুরুর ব্রাঞ্চ  ম্যানেজার পার্থ সেনকে বলেছি  ওখানেই গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। চিরিয়া মাইন্সের   কাছেনদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক  যেতুমসারান্ডার পার। এবার অন্য পথে। 
চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে  প্রথমে ছাড়া 
ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুরবেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে লালমাটি, 
ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ছাগলছানাদের জটলা  আর অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি নিয়ে পথের মোড়ে বসে থাকা শাদা শাড়িতে উজ্জ্বল কৃষ্ণা 
ধরিত্রীকন্যাদের ছায়া দিতে দিতে  ওরা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে 
আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর  সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথেজলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথরচুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা  বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন  পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের 
জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর 
একটু নিচু প্ল্যাটফর্ম, লাফিয়ে নামতে হয়  চারদিকে তাকিয়ে দেখি  গার্ড ততোক্ষণে ঝান্ডা দোলাতে শুরু করে দিয়েছে  একটি রোগা লোক এগিয়ে এসে আমারবাক্স
প্যাঁটরা তুলে নেয় 
ম্যাঞ্জর সাব গাড়ি ভেজা  হ্যাঁয়...
তুম মুঝে পহচানা ক্যায়সে?
একটু দ্বিধা করে,
ম্যাঞ্জর সাব বোলা থা...
ক্যা বোলা থা ? অ্যায়সা দাড়ি হ্যাঁয়...?
এবার হেসে ফেলে,
হাঁ সর...
চলো... 
স্টেশনের পাশের গেট দিয়ে বেরিয়েই একটি কালো অ্যাম্বাসাডর, এক রাশ 
কৃষ্ণচূড়ার  ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে  কয়েকটা ফুল ঝরিয়েও দিয়েছে ততোক্ষণে গাড়িরউপর 
ক্যা নাম হ্যাঁয় তেরা...?
আইগ্যাঁ, জগমোহন...
কেত্তে সময় লাগিব ?
আইগ্যাঁ, অঢ়াই  ঘন্টা...
----------------------------------
" জঙ্গল জংশন থেকে চার মাইল হবে।
কিছুটা পিচের পথ, বাকি মেঠো, বসুন্ধরা তক;
ব্রহ্মডাঙা ভেদ করে জঙ্গল করেছে,
জঙ্গল ডাঙার পর ষাট বিঘা হবে।
চারিদিক সেগুন শাল পিয়াল মেহগিনি,
শিশু  পলাশ আছে আর আছে কাঞ্চন বকুল, আছে বাওবাব বাঁশ হেঁটোকাঁটা কুল,
সর্বত্র সমস্ত আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।...."



মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা  উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছেদক্ষিণে  কোলেবিরাহাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক  এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে  মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েলনদীতে  এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল  উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল  এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনিকোথাও  খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী  হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দাও নিভৃত নীলপদ্মের মতো একা কারো,কোয়েল, কোয়না, সুবর্ণরেখা অতো সহজে ধরা দেয়না। 
 সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙা
পথের রাঙা ধুলোর সড়ক  কোয়না চলেছে পাশে পাশে  ছোটা নাগরা পেরিয়েসোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ  কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি  এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো 
-------------------------------------------------
"বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে....."
এই সব খনি শহরে যাবার জায়গা খুব কম  সন্ধেবেলা টিভির সামনে আবর্জনা 
দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া নয়তো পরিচিতদের বাড়ি গিয়ে রাজাউজির মারা 



অগস্ট মাস থেকে এখানে লোকে গরম জামা পরে  চলে সেইমেজুন এপ্রিলের শেষ  সেতো  মাসেও বৃষ্টি হয়ে জানালা দিয়ে গেলে ঘরের ভিতর মেঘের আনাগোনা। নীল পাহাড় আর দিগন্তসবুজ ক্লোরোফিলমাঝখান চিরে লাল হিমাটাইটের ধুলোয় রঙিন সড়ক দিয়ে সমানে ছুটে যায় টিপাডাম্পারআর্থমুভার   আঁধারঝুঁঝকো হলেই কুয়াশার ভারি ডালপালা ঢেকে ফেলে চরাচর  যাবার জায়গা বলতে সেই অফিসার্স ক্লাব  কিছু তাসকিছু টেনিসকিছু বিলিয়ার্ডবৃথা আড্ডা আরঅভ্যেসবশে সুরাপান  চেনা মুখচেনা অভ্যেসচেনা কথা ; তবু লোকে আর যাবে কোথায়মানুষ তো আসলে মানুষ  নাগরিক বাঙালি অনেক রয়েছেন মাইনিঙের লোকজনের তো কোনও অজুহাত নেই। তাঁরা নিজের পছন্দেই এই সব জায়গাতে চাকরি নিয়ে থাকেন। কিন্তু মেক্যানিক্যালইলেক্ট্রিক্যাল জনগণঅদৃষ্টকে গালাগালি দেন  আসলে এসব জায়গায় সরকারি চাকরির একটা অন্যরকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া যায়না  মাঝেমধ্যে কলকাতা আরজামশেদপুরশহরের শিশুদের লালায়িত মুখ ওতেই শান্তআপোসিত 
পার্থ  আমার অনেকদিনের বন্ধু। এখানে একা থাকে। বৌ-বাচ্চা পাটনায়। পাটনা এখান থেকে বহুদূর  তিন-চার মাসে একবার যাওয়া আর দিন গোনা। কতোদিনেপাপের মেয়াদ চুকবে। গান-বাজনার নেশা আছে ওর। দু'টো বেশ ঈর্ষণীয় মডেলের কর্গের কীবোর্ড আছে ওর বাড়ি  তবলাও বাজায়। এই গ্রামে কখনোসখনো  গানাবজানার প্রোগ্রাম হলে বাজাতে যায়। নয়তো নিজে নিজেই বাদক  শ্রোতাবিষন্ন হিমসন্ধ্যাবেলায় সুরের পর্দায় জীবনের মানে খোঁজে। আমাকে পেয়েপুলকিত  সন্ধেবেলা কাজ শেষ করে আমাকে নিয়ে তাদের মোল্লার দৌড় কেলাবে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য একটু আড্ডাফাড্ডা মেরে পানভোজনান্তে বিছানায়দেহরক্ষা করা 



অফিসার্স ক্লাবে সেদিন একটা প্রাক-হোলি পার্টির আয়োজন হয়েছিলো  পার্থ নিমন্ত্রিতসঙ্গে আমিও রবাহূত। কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়তার পর তুমুল আড্ডা।এর মধ্যে রটে যাওয়া আমি গানটান গেয়ে থাকি। পার্থের বাড়ি থেকে কীবোর্ড এসে 
যায়এক আধজন আরো সুপ্ত প্রতিভাআর কী লাগে ? সুর  সুরার সাধনায় রাতগড়ায় বহুদূর  কিন্তু জনতার ক্লান্তি নেই  তবু শেষ তো করতে হবেই। তাই হলো মাঝরাত পেরিয়ে  বহু মানুষসুস্থপ্রমত্ত শ্রোতার দল এসে শুভেচ্ছা জানিয়েযাচ্ছেন  তাঁদের মধ্যে একজনকে নিয়ে পার্থ আসে আমার কাছে। পরিচয় করিয়ে দেয়ইনি কুন্তল বাসুফিনান্সে আছেন  আমাদের নিত্য দশবার  কথাবাত্তা হয়বুঝতেই পারছো খুব কাছের মানুষ  সেই সুশীলপুষ্ট চেহারার মানুষটি আমাকে স্বাগত জানানপ্রশ্ন করেনআচ্ছা আপনি কি কখনও জামশেদপুরে থাকতেন?
আমি সবিনয়ে জানাইআমি কেনআমার তিন পুরুষের বাস  গ্রামে  কেন বলুন তো?
-ঠিকই ধরেছে...
-কী?...
মানে আমার শ্বশুরবাড়ি জামশেদপুরে। আমার ওয়াইফ বললো আপনাকে চেনে..
-আরেতাই নাকিউনি এসেছেন কি?
-আরে এসেছে বলেই তো দেখেছে আপনাকে...
-কোথায় তিনিদেখলে আমিও চিনতে পারবো নিশ্চয়...
-দাঁড়ান....
একটু পরেই তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এক সুন্দরী মহিলাকে  গণেশ পাইনের রানির মতো দীর্ঘগ্রীবাআয়তলোচনাগঙ্গামাটির রঙ ত্বক ; ভাবিভদ্রলোকেরস্ত্রীভাগ্য বেশ ভালো  আমি আগ বাড়িয়ে বলিনমস্কারশুনলুম আপনি আমাকে চেনেন...
তিনি একটু তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠেন,
-শিবাজিদাআমাকে চিনতে পারছো?



(ক্রমশ)

(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)