সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৮৩)


উড়ে যাওয়া মেঘের নিচে মেঘদলের খন্ড বিখন্ডের নিচে বহু ব্যপ্ত জনপদখিলান। মেঘের ছায়ায় ছায়ায় সে দেখে হেঁটে যেতে থাকা নদীরাম বর্মণকে। শ্যাওলামাখা আস্ত একটা শরীর নিয়ে নদীরাম হেঁটে যেতে থাকে। নদীরাম কখনো কখনো নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। তখন সে হয়ে ওঠে নদীরাম জালুয়া নদীরাম হালুয়া নদীরাম হাটুয়া। কিংবা ‘বাচ্চা বাপই সোনার চাঁন / গরু দুইটা আইলত বান্ধ’ এমনতর  গান কন্ঠে ধারণ করে নদীরাম গীদালই বা যেন।

নদীরাম তার জীবনের ভেতর কেমনতর এক জীবনযাপনই টেনে নিয়ে আসে। জীবনযাপনের খোলের খোপের গহনে কখনো কখনো হরিণের মুখ আঁকা ভাঙা ছাতার বাঁট সহ সে তৎপরতায় ভিন্ন কিসিমের সব দিবারাত্রি রচনা করতে করতে  এগিয়ে যায় আঞ্চলিক নদীর ঘাটে ঘাটে তার পরিক্রমণের বহুমাত্রিক বিন্যাস প্রকল্পের স্থানিক উচ্চারণ রীতির মতো। উড়ে যাওয়া মেঘের নিচে তলদেশের শস্যহীন শস্যময় মাঠপ্রান্তর ভাঙতে ভাঙতে নদীরাম হালের গরুর হালহদিস খুঁজতে খুঁজতে তার সমগ্রতায় লিপ্ত হতে থাকা সমস্ত আঞ্চলিকতাকে যেন ঝেড়ে ফেলতে থাকে সন্নাসী ও সৈনিকের মতো। বিপন্নতা ও বিষাদময়তার অন্ধকার থেকে ধারাবাহিক প্রয়াসে একসময় চাঁদের আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে সে।




(৮৪)


পূর্ণতার সেই লগ্নে উৎসব মুখরতা জাগে অনেক কালের গানের লহরীতে আদ্যিকালের যতেক বাজনার স্বতস্ফূর্ত উল্লাসের মতো; যেন হাওড়ের দিক থেকে ভেসে আসা বাতাসের শো শো টংকার। বহমান জীবনের দিকে বয়ে যেতে যেতে নদীরামকে কি আত্মগত হয়ে উঠতে হয়! আত্মগত হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় কিছু প্রতিপ্রশ্নও তো ধেয়ে আসতে পারে। বিচলনের প্রান্তিকতায় লোকপৃথিবীর ধাঁধাগোলকে একসময় নদীরাম তার আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করে  আর অতিক্রম  করতে থাকে সমস্ত আঞ্চলিক নদী ঝাড় জঙ্গল বাথানবাড়ি ঘাটোয়ালের ঘাটগুমটি পাখিরালয় পূজাবাড়ি বিশালাকায় কত জানা অজানা বিলা কুড়া দহ। নদীরাম তখন ছড়ানো দু-হাতে প্রতিহত করতে থাকে সামগ্রিক শূন্যতার বোধ। মাঠে মাঠে ভোরের বাতাসে কালবৈশাখীর হঠাৎ গোধূলি-বিকেলে নদীরাম শূন্যতার খানাখন্দ খুঁড়ে  বালুকারাশি খুঁড়ে বের করে আনা জলতলের মত নিজেকে সাবলীল করে তোলে যেন সাবলীলতায় জেগে উঠবে বা জাগিয়ে তোলা হবে কবেকার ফকিরগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা ‘কিসসাপুঁথি’, গাইয়া দই মাটির সরা ভোগ আতপের চাল লালশাক ধানডুলি তরলা বাঁশের বাঁশী আরও আরও কত কী! নিজেকে আঞ্চলিকতায় ছড়িয়ে  দিতে চেয়েও পুরোপুরি কি আর সেভাবে ছড়ানো যায়! মোহমায়ার জাগতিকতাকে তুচ্ছতর করে তুলতে না পারলেও সে তার তাবত প্রয়াস জারি রাখে যদিও এত সবের ভিতর বরাবরের মতোই কাছে দূরের সব গঞ্জবাজারে উড়ে যাওয়া মেঘের নিচে কেবলই অলীক লন্ঠন দুলতে থাকে।




(৮৫)


মেঘের আলোয় হেঁটে যেতে যেতে মরা নদীখাতের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হেঁটে যাওয়ার প্রাণান্তকর এক অভ্যাসে অথবা হেঁটে যাওয়াটাকে চিরস্থায়িত্ব দিতে গিয়ে সে কি কখনও হাঁটবার ছন্দটাকেই হারিয়ে ফেলে; না কি মেঘের আলোর অপার্থিবতায় হেঁটে যাওয়াটাকেই অনাবিল এক নিসর্গদৃশ্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। সে তার হাঁটাটাকে অভ্যাসের দাসত্ব থেকে দায়বদ্ধতা থেকে একপ্রকার মুক্তই করতে চায়। সে তো আবহমানের এক মানুষ। আবহমানের এক পদযাত্রী। পরিচয় হারিয়েই বারবার সে তীব্রতার সাথেই নবতর এক আত্মপরিচয়ের অবসাদের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। দেহের যাবতীয় ভঙ্গি নিয়ে সে হেঁটে যেতে থাকে, হেঁটে যেতে চায় যদিও চাওয়া-না চাওয়ার দোলাচল তাকে আলো-অন্ধকারের প্রান্তিক পিলারের কাছে পৌঁছেও দেয়। হাঁটাপথে সে তো সাক্ষী রাখতে চায় ঢোলের বাজনা, বিষুয়া পরব, কাঁদোখেলায় বাজতে থাকা সানাইবাদ্যও। মেঘের আলোয় পথ হাঁটতে হাঁটতে সে তো একধরনের ঘোড়ের তড়াসেই নিয়ে যায় নিজেকে। তাকে জড়িয়ে ধরে মধ্যনিশীথের হাওয়া হাওয়ায় হাওয়ায় শেয়ালের রব ক্রন্দনধ্বনি পাখিদের ডানার পাখসাট এসবই তো এসে মেশে। সে তার শরীরের কাঁপুনিটুকু টের পায়; অনুভূতির সমগ্রতাটুকু নিংড়ে সে তার জীবনদর্শন বিনির্মিত করতে করতে পুনশ্চ কোন নির্মাণের ঢালেই যেন ঢলে পড়তে থাকে। হেঁটে যাবার চিরন্তন নান্দনিকতায় সে জনমানুষের বর্ণিল রংসাজানো জীবনযাপনের অনুপম গাথাকাব্যকেই সঞ্চারিত প্রসারিত করতে গিয়ে জীবনযাপনের নিহিত অর্ন্তলোক থেকে অন্ধকার রাতের মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর জোনাকির আলোর মতো অনায়াসে টেনে আনা অনন্য স্বাদের এক জীবনযাপনের রূপরহস্যের নকসিই যেন বয়ন করে যেতে থাকে









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন