হ থেকে রিণ থেকে অন্য পৃথিবী
হরিণ প্যাশান। তানপুরা ভাবলেও হরিণ; নীরবতা ভাবলেও হরিণ। তিন অক্ষর শব্দকে
মাথা থেকে কেটে ফেলে হাতে রইল হ; একফালি কাস্তের প্ররোচনা। রিণ থেকে তোমার চোখ;
চোখের নাম সুচিত্রাও হতে পারে, বার্মুডাও। হরিণপিয়াসি যখন রোদমাত্রায় একটা আস্ত
পূরবী বসিয়ে দিচ্ছে আমি শব্দকান্তারে অন্তর বসাই; দু একটা আঁধারও। আর আলো আলো করা
স্বপ্ন চাহনিতে কার্তুজ মেশায় মিশ্রখাম্বাজে। অচিনের ভাবনা ধরে যায়। অথচ অচিন কোনো
পাখির ভাবনা নয়; ভাবনার পাখি। তো সেই পাখি পাখি ডাকের ভেতর আমি শব্দকল্প নাকি কল্পশব্দ
দ্বন্দ্বে। জিরো ডেসিবেলের নিচে রিয়ার গানোফোনিক বসছে। নিসামাপায় নামা ইশারা যতটা।
আর টলটলে ধ্বনিমুহুর্তে ঝরাপাতার টুল নিয়ে টুটুল। ভুবনডাঙার চলাচল তাই কখনো
ইতিবৃত্ত হল না। সে এক চলমান তরঙ্গ; ত্বরণের গায়ে অঙ্গ ঢলে ঢলে অনঙ্গ হচ্ছে
চিরকাল।
বিচিত্র জীবনসফরকে ধ্বনিবদ্ধ করতে বসে আদ্যন্ত রোমান্টিক
কবি স্বপন রায় নিজের কবি সত্তাকে ‘আমি’ থেকে
পৃথক করেছেন,
“আমি কবি হলে পৃথিবী অন্য। দ্বিতীয়”। হ থেকে রিণ কাব্যগ্রন্থটিতে সেই দ্বিতীয় লেখা, যেখানে কবি বলেন, কবির মতই চেষ্টা করেছি বানাতে, ভেস্তে দিতে, বিপথগামী করতে, সরু রোদের একফালিও আছে কোথাও কোথাও। তারপর কবি ‘আমি’তে মেশে। এক হয়ে
যায়। বার বার ফিরে দেখি কোথাও কি
কোনো চিহ্ন রয়ে গেল আবছা রুমালে, ড্রামসেটে, টায়ারিম মায়ারিম রাস্তায়…
‘ঝরাপাতা সমগ্র’-এ প্রথমেই দেখি ঝরাপাতার টুল নিয়ে কবির ঘোর
শীতান্ত। রঙহীন ক্যানভাসের প্রেক্ষাপটে এ
যেন গূঢ় এক ডাক,
অদৃশ্য হাতছানি। পথের
বাঁকে ঘোর ঘোর সব্জে রঙের মাতাল নেশা গড়িয়ে দেয় সময়ের কাঁটাভাঙা দিগন্তরেখা। টুল নিয়ে এত কিছু ভাবার সত্যিই কি কিছু ছিল? তবু সেই ঝরাপাতার উপনিবেশে ডাক নামের নির্ডাক, টুটুল,
কেন কোনো নামে কোন দূরস্তব্ধ তা ডিম হয়ে হয়ে
পাখি
পাখি হয়ে হয়ে ডিম (‘ঝরাপাতা
সমগ্র’-১)
কবি স্বপন রায় রোমান্টিক হলেও তাঁর কাব্যচর্চায় ফুলেল বিষাদ
আর প্রিয়তম প্রেম থেকে উবে যায় পুরাণের স্যাঁতস্যাঁতে ঘ্রাণ। অক্ষর ছুঁয়ে শব্দ আর শব্দ ছুঁয়ে ধ্বনিতে যখন আরোহণ করেন তখন চয়নের অস্থির কম্পনে
থির থির কেঁপে যায় মননের একাধিক স্তর। অথচ
ছাড়িয়ে যায় না কম্পাঙ্কের বিপদসীমা।
‘ঝরাপাতা সমগ্র’-এ কবির অকপট স্বীকারোক্তি শুনি, “আটবছর আগে কত অস্বাভাবিক ছিল/ছিল পাখিনাশক/এই লেখা”। কবি একটি সংখ্যাকে হাজির করেছেন। আটবছর। হয়তো কোনো বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই। আটবছর আগের ইতিহাস বলে, গাছ
ছিল,
যেখানে পাখি থাকতো
পালক ছুঁয়ে দিত রুয়ে দিত পাতায় পাতায়
চলানিচু
হাই-ঘুম ডানা ঝাড়ার অবিকল আড়মোড়া (‘ঝরাপাতা
সমগ্র’-৩)
পাখিনাশক এই লেখা কি যেন রুয়ে দিয়ে গেল মনতন্ত্রীতে। ওড়াডোড়া আকাশ ঘিরে ছায়ানিসামাপা বাজছে,
অবিরাম বেজেই চলেছে সম্ভাবনার জলঠুংরি। জীবনের চলার পথে মূর্ত অভিজ্ঞতাগুলির বিমূর্ত রূপ দিয়েছেন অভিনব শব্দায়নে। না, কোনো দৃশ্য নেই। ঘটনাও নেই। তাহলে
কী আছে এই পাখিনাশক লেখায়? ধ্বনি। ধ্বনিরেখার টান প্রচন্ড আলোড়ন তোলে বাতাসের বুকে, দফতরছুট
বৃষ্টিতে
ভাবনাফেরত জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোথায় কত দূরে যেন
যাত্রা কবির। চলাপথের প্রতি মুহূর্তে প্রত্যেক বাঁকে স্বপ্নে আবিষ্কারে
ইতিহাসে শব্দের যাত্রাশুরুতে সম্ভাবিত যে ধ্বনি তা নিজের মত করে শুনতে পান কবি। আর সেই ধ্বনিরই রূপায়ণ হয়েছে এই
কাব্যগ্রন্থে।
কবির ভ্রমণের একফালি রোদ রাবাং পাসে, মনস্ক এক সূর্যের টিপসই/দাহ্য আর কিশোরীসুলভ। কবির ভ্রমণেও স্বপ্নসন্ধান,
ইচ্ছে হল প্রণালী খুলে গেল
হল না তো রাস্তার ফালেই গেল গেল ভাব
ঝরার সময় যে রকম
একটি পাতার হয়
দু একটি চোখের পাতারও (‘ঝরাপাতা সমগ্র’-৬)
না, কবি স্বপন রায়ের কবিতায়
নিশ্চিন্তে পা ছড়িয়ে বসার উপায় নেই। পাথুরে
রাবাং পাসের পথে দু একটি চোখের পাতার মধ্যে অচেনা দূরগম্য দ্বীপের
অস্পষ্ট নীল তট ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সাগরের
জলচোঁয়া বালি কোল পেতে দেয় আদিগন্ত। সেই
দিগন্তে চোখ রেখে চলা পাখি যখন নিশ্চিন্ত পা রাখে, অলক্ষ্যে ধ্বনিত হয়, দ্রিম...দ্রিম...দ্রিম... চোরাবালি... খসে পড়ে পাড় সাগরের বুকে। শুধু আকাশের গায়ে জমা হতে থাকে কিছু দাগ। ধীরে ধীরে সমস্ত দিগন্ত হারিয়ে যেতে থাকে সেই দাগের পিছনে। আরো নির্জন থেকে নির্জনতম এক উপলব্ধিতে।
পিছু ফিরে শোষণহীন রাজনীতির উথালপাথাল সময় কবিকে প্ররোচিত
করে,
ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই উত্তাল উন্মাদনায় যেখানে পূর্বাভাষের
অভাবে ডুবন্ত জেলেডিঙি প্রেক্ষাপট মাত্র। তবু
রোদের থেকে থেমে থাকা নদীর থেকে বাষ্প কুড়িয়ে, বেনামী
রাস্তার টুকরো জুড়ে জুড়ে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপকে আশ্রয় দিয়েছে
কবির কলম,
টিপ পরার আগে
তুমি ছাড়া
সূর্য উঠে গেল চমত্কার বিয়োন ভোরে চমত্কার
তুমি ছাড়া
ছাড়া
দাস ক্যাপিটালের কথা মনে হয় শোষণের কথা মনে হয়
আর উল্টে
যাওয়া ক্যান
ঢুকুঢুকু যাচ্ছে ঠিকই দুধভোর এক যুগান্তকারী মহিলার
ঢাকা অবস্থায়
মেশিনে (‘ঝরাপাতা
সমগ্র’-৪)
চেতনাপথের বাঁকে দাঁড়িয়ে কবি বলেন, উত্তরাধুনিকতা
এবং অধুনান্তিকতা যতটা একটা সময়ের মাপকে নির্দিষ্ট করে ততটা মাপই একজন সৃজনশীল
মানুষকে পেরিয়ে যেতে হয়।... সে তখন সম্ভাবিত ঘটনার জায়গায়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে।... যেমন ইলেকট্রনের স্থিতির রুটিনকে নির্দিষ্ট করা যায় না সেভাবেই নতুন চেতনায়
আক্রান্ত কবিতে সীমাবদ্ধ করা যায় না কোন প্রতিষ্ঠিত উপকরণ দিয়ে।
রূপোলী জগতের জনপ্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কবি স্বপন
রায়ের অসামান্য সৃষ্টি ‘সুচিত্রা-বার্মুডা’, গানে মোর ইন্দ্রটুকু হয়ে কীসের যেন অনুরণন ,
ছোট্ট এলাচ থেকে বেরোল সূচিপত্রের
আদুড়
মাদুর
পৃষ্ঠা ১ : লাজুক স্যান্ডেল সাড়ে ৭৪
পৃষ্ঠা ২ : ক্যাটওয়াক সবার উপরে
পৃষ্ঠা ৩ : মোচ বাঙালরা বলে, শাপমোচন?
পৃষ্ঠা ৪ : ইন্দ্রাণী, কোয়ার মা
পৃষ্ঠা ৫ : রাত্রিমাছ দেরী হল, পথ ছিল না রাস্তায়
পৃষ্ঠা ৬ : অবিকল তোমার মুখ
সাগরিকা পর্যন্ত এতটা। আর শেষ পৃষ্ঠায় লিখতে লিখতে ফুরিয়ে গেল
সমাপ্ত’ লেখা হিট্ ছবি [
সুচিত্রা-বার্মুডা’-৭ ]
সুচিত্রার আঁচলে ছড়ানো ছেটানো টুকরো আকাশ। মেঘবৃষ্টির বাসা। অলকগুচ্ছের
কুহক ছাপিয়ে রাতভর বৃষ্টি মাখা। চিরসময়ের
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আজও, এ যেন গানের দিন... পথ থেকে পথে
শুধু ফেলে ফেলে যাওয়া টুকরো স্মৃতির নির্জনতা। গোপন ব্যথায় অলীক সুরে শুধু হারিয়ে যাওয়া অনেক দূরে।
কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে বার্মুডা কেন? কবি কারণ নির্দেশ করেছেন,
এই পৃথিবী একদিন হবে
এই পৃথিবীর হবে একদিন
শাসক-বার্মুডা
শাসিত-বার্মুডা
মেনিফেস্টো-বার্মুডায় অনিশ্চিত হতে হতে... (‘সুচিত্রা-বার্মুডা’-১২)
কবি বলেন, বার্মুডাই কবিতা,
হাউ ইজ দ্যাট, জোর গলায় আম্পায়ারকে গ্যালারিকে চমকে...আমি
চমক দেয়ার জন্য বার্মুডা কিনিনি
আজো বাজার অর্থনীতির এই দিকটা
SENSEX
সুচিত্রা হল যৌনতাও একটু, সবই তো ওঠানামা, সবই তো
বার্মুডা
কেনার সময় খাদ্য আন্দোলনের কথা নয় ১৯৬৬
নয় [সুচিত্রা-বার্মুডা’-১৩]
‘নীলুর পিয়ানো’ কবির দীর্ঘ কবিতা, নদী
হয়ে হয়ে জল হয়ে হয়ে আরো নির্জন আর নিভৃতে কোথায় যেন বাসা বাঁধে এক অচিন সুর, নাম না জানা পাখি। হয়তো কিছু বলার আগে কিছু
বলার পরেও এক অজানা অচেনা শিহরণ তোলে অনুভবের রিখটারে। আজব এক বিমূর্তনের সর্বাঙ্গে লেগে থাকে সমস্ত রকম মানবিক অনুভূতির আণবিক ও
তীক্ষ্ণ প্রকাশ এবং তা বর্ণনা বা বাণী নয়।
গানকে ভুবন ভুবনকে জীবন
ভাবার সময় উদাস তর্কে শোয়া মুরগীর নিভৃত খালাস
নদী হয়ে জল হয়ে
জলোকি
জ্বলো কী নয়? জলজোনাকি। তোমারই
নিছক থেকে নাকের পাটায়
থেকে থেকে
হীরে কবে যে টুকরো হয়ে, কবে যে আমারই খাটিয়ায় বসে
পাটনাকে বলে পটনা
পটে যাওয়ার পরেই বলবে তিল কখন হয় জানো
তালের আগে [
নীলুর পিয়ানো ]
প্রাচীন দিগন্তরেখায় যেখানে আকাশটা নেমে আসে মাটিসম্ভূত
ধ্বনির কাছে,
শব্দের খুব অনায়াস আর নির্ভার চলনের সোঁদা গন্ধ বুকের ভেতর
আকুলিবিকুলি করে, ঠিক সেইখান থেকে যেন এই কাব্যমালার শুরু। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে টান টান অস্পষ্ট দোটানায় বিষয়ের
তানানা,
নিবিড় গেরস্থালির রুটি ও আপেলের লালীমা আর বস্তুবাদী নাগরিক
সীমায় কবির চলাচল। কিন্তু অনাবশ্যক আপাতদৃষ্টি যখন
পেরিয়ে যাই তখন দেখি বস্তুর বাস্তববাদ পেরিয়ে যাওয়ার ঠিকানা আছে এখানে। বিষয়ের ঘোর উপচে বিষয়কে পেরিয়ে যাওয়ার এক অভূতপূর্ব সমীকরণ। ঠিক যাওয়া নয়। যাতায়াত। নতুনের খোঁজে পথে বিপথের এই চলন আর গমন মননের চৌকাঠে ক্রমশ
মিথ হয়ে ওঠে।
যাঁর ‘হ থেকে রিণ’ থেকে আমার
এই অন্য পৃথিবী তাঁর
সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
জন্ম: জামশেদপুর, ১৯৫৬।
স্কুলজীবন: ইস্পাতনগরী রাউরকেলা। কলেজজীবন: খড়গ্পুর, বি.কম। ১৯৯৭ পর্যন্ত বাম
রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারপর রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হলেও জনকল্যাণমুখী
গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রের স্বপ্ন কবি এখনও দেখেন। লেখার শুরু
প্রাইমারি স্কুল থেকেই। কবিতার কাছে আসা হাইস্কুলে। নাটক, পথ-নাটক
লেখা আর অভিনয়ে সক্রিয় বহুদিন। কবিতা লিখতে লিখতে নিজের ৩০/৩২ বছর বয়সে কবির মনে
হয় “কবিতা লিখছি, কিন্তু এর ভাষা তো ধার করা। আমি কোথায়?” খড়গ্পুরে
একা থাকার সময়ে আবার গীতাঞ্জলি পড়তে আরম্ভ করেন। দিনরাত্রি
এক করে কবিতার স্রোত। একেকটি গানের শিরোনামে একেকটি কবিতা, যা ‘ধুপ-শহর’ নামে
‘কবিতা ক্যাম্পাসের’ দীর্ঘ কবিতার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। অতিচেতনার পুরোধা
কবি বারীন ঘোষাল জানান এই কবিতাই অতিচেতনার কবিতা। কবির খড়গ্পুরের
বাড়ি আর জামশেদপুরে বারীনদার ফ্ল্যাটে নিয়মিত কবিতার ওয়ার্কশপ, যা পরে কবিতার
ট্রেকিং-এ রূপ নেয়। পত্রিকা সংপৃক্তি: দ্রিদিম, কবিতা ক্যাম্পাস, নতুন
কবিতা। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: আমি আসছি (সংস্কৃতি খবর, ১৯৮৪), চে
(সংস্কৃতি খবর, ১৯৯০), লেনিন নগরী
(কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯২), কুয়াশা কেবিন (নতুন কবিতা, ১৯৯৫), ডুরে
কমনরুম (কবিতা
ক্যাম্পাস, ১৯৯৭), মেঘান্তারা (নতুন
কবিতা, ২০০৩), হ থেকে রিণ
(নতুন কবিতা, ২০০৯), স্বপনে বানানো একা (সঙ্কলন, কৌরব, ২০১০), দেশরাগ (নতুন কবিতা, ২০১১), সিনেমা সিনেমা (নতুন কবিতা, ২০১৫)। প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ: স্বর্গের ফোকাস (কবিতা
ক্যাম্পাস), রুয়ামের সঙ্গে (কবিতা ক্যাম্পাস), একশো সূর্যে (নতুন কবিতা,
২০০৯), কুঁচবাহার (ঐহিক,
২০১৭)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন