নিশ্চিন্দিপুরের গল্প
তারপর কত এঘাট-ওঘাট, রোদ-ঝলসানো বা আঁধার-করা, কত
সমাদর-প্রত্যাখ্যান, চরম নিবিষ্টি বা প্রত্যাহার, জন্মভূমি খুঁজে পেল কই? জন্মের
মাটি বুঝি একটাই হয় যেখানে আদি ছ’বছর কেটেছে। মনে পড়ে একগাদা অগোছ কাগজের ফাঁকে
ঊণিশশো ছাপ্পান্নর বাটার জুতোর বিজ্ঞাপন। পাতলা ড্রইংখাতার পাতায় আঁকাবাঁকা অপটু
অক্ষরসারি,
‘যদুদা আপনি এটা খেয়ে নিন।’
কচি গালের ওপরে ঠাটিয়ে ওঠা চপেটাঘাত। ভাদ্রমাসের মেঘ আর ওই
ছবিটা। কী ফল দেওয়া হয়েছিল আঁকতে – কলা, আম না পেয়ারা মনে নেই আর। যদুদা না মধুদা?
যদুদা’ই ভেবে রাখে। স্যার বলতে শেখানো হত না, দাদা। আর দিদিমনি – ধীরা দিদিমণি,
লায়লী দিদিমণি। উঁচু ক্লাসেরা আড়ালে লাইনিং দিদিমণি ডাকত। স্কুলটা ফাইভ অবধি।
ফাইভে পড়ে থাকত সাত-আট জন।
লাল ইঁটের একতলা বাড়িটা একদম মোড়ের মাথায়। পাঁচিল ঘেঁষে
বকুলগাছ। কোয়ার্টার থেকে হাঁটাপথে তিন মিনিট। ডিউটি যাওয়ার পথে সাইকেলে বসাত বাবা। একমিনিট পরেই নামত আকাশ আর শিখা, ছয় আর নয়। পাড়াতে সে আশু।
‘পচা লাগে’ শুনে তরু কী আর করে? বলত,
-থাকগে বলুক। আসলে তো মস্ত আকাশ – ঠাকুমার, মা’র, বাবার,
দিদির।
-মা যদুমাস্টার শ্বশুরবাড়ি জানো? রেনকাম ঝামঝাম পা পিসলে
আলুদ্দম।
-আইকম বাইকম খেলা হচ্ছিল নাকি?
-লাইনিং দিদিমুনির সঙ্গে যদুদার পেম হচ্ছে। পেম মানে কি মা?
-পাকা ডেঁপো কথা কে শিখিয়েছে? শিখা শুনে যা এদিকে-! কে
শেখাচ্ছে?
-আমি কী জানি?
আঙুলে মাখমাখি তেঁতুলমাখা। একবার চাটা দিয়ে শিখার গলা টকটক,
-ও আজকে ইশকুলে মার খেয়েছে। বলেনি? খুব পেকেছে।
-কেন?
-ড্রইংখাতাতে বাজে কথা লিখেছে। দেখেছ?
-পাজী ছেলে! বখাটে হয়ে যাচ্ছে।
-আমার কর্মশিক্ষার টেবিলক্লথে লেজিডেজি ফোঁড় দেখিয়ে দাও না
মা, হাত ধুয়ে আসছি।
শিখা এখন ভীষণ লক্ষ্মী, মায়ের বাধ্য।
বাংলো ধরনের লাল ইঁটের বাড়ি, উঁচু গেটের মাথায় সাইনবোর্ড। পেছন
বাগানে ছাতা-হওয়া প্রকাণ্ড কৃষ্ণচূড়া আর হিমসাগর আমের ছায়া। খোলা লম্বা বারান্দায় ব্ল্যাকবোর্ড। লাইলী দিদিমনির কালো লম্বা বেণীর তালে মাদুরে
বসে চোখ বুজে এগারো দু’গুণো বা-ইশ, তিন এগারোং তেত্তিরিশ একসঙ্গে। হিল্লী-দিল্লী
করতে গিয়ে কতবার খুঁজে ফিরেছে হাতের
লেখাটা, ‘যদুদা আপনি খেয়ে নিন।’ ‘একখুনি’ শব্দটা ছিল কি! বানান শুদ্ধ হত না
যুক্তাক্ষরের। পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখতে যাওয়া – ফিটফাট হাফপ্যান্ট, ছিটকাপড়ের
শার্ট, নতুন জুতো। ছুটির আগে ইশকুল থেকে পাঠানো একগোছা কাগজের ব্যাজে
‘আকাশনীল দত্তরায়
প্রযত্নে অশোককুমার দত্তরায়
মাতা তরুলতা দত্তরায়
রাণীতলা মোড়’ পেন দিয়ে লিখে সেফটিপিন দিয়ে বাঁদিকে আটকে দিত
বাবা। তখন হারিয়ে যায়নি কোনোদিন।
মা মুখস্থ করিয়েছে, ‘যেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার-’
সে বলেছে, ‘ভাল লাগে আরবার পিতিবীর কোন্টি।’
-পিতিবী বলে না, বল পৃ-থি-বী।
-আচ্ছা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন