জানালার
ওদিকে
প্যারালিসিসে
পা দুটো পড়ে যাওয়ার পর থেকে সরমার দিনগুলো দোতলার জানালার ধারে কাটে। দক্ষিণের
জানালা, খুলে রাখলে ঠান্ডা হাওয়া ঘরের ভিতর ঘুরপাক খায়। জানালার
নিচে একফালি সরু রাস্তা, দু’ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা পুরনো সব বাড়ি, রায়চৌধুরীদের শান বাঁধানো উঠোন, মুখার্জীদের ঠাকুরদালান, ঘোষবাড়ির ছাদে ওঠার ঘোরানো সিঁড়ি, চিলেকোঠা, ফাটল দিয়ে গজিয়ে ওঠা বটগাছ... সরমার ভারি ভালো লাগে এসব।
উল্টোদিকের বাড়ির ব্যানার্জীবাবু’র স্ত্রী গা ধুয়ে সন্ধ্যেবেলায়
রোজ বারান্দায় এসে দাঁড়ান। সরমা দেখেন, দু-চারটে কথা হয়। প্রায়
সমবয়সি, রোগ-বিরোগের বালাই নেই, টানা বারান্দাটায় অনেকক্ষণ পায়চারি করেন, গাছে জল দেন,
বেতের দোলনাখানায় বসে গুনগুন করেন। সরমার ওই সময়টায় বড় অসহ্য লাগে, মনের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
গুমরে ওঠে,
কষ্ট পান। সাড়হীন পা দুটোকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে জানালাখানা ভেজিয়ে দেন প্রায় দিন। ভ্যাপসা গরমে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘরের ভিতর হাঁসফাঁস করতে থাকেন। সন্ধ্যে
গড়িয়ে রাত্তির নামে, জানালা আর খোলা হয় না...
দিন যায়। বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাস
পড়ে। গরমের দাপট বাড়তে থাকে ক্রমশ। এমন এক সন্ধ্যেবেলা বাইরে সোরগোলের
আওয়াজ শুনে সরমা জানালার কপাটখানা খুলে উঁকি দিলেন।
রাস্তায় লোকজনের ভিড়… গাড়ি… উল্টোদিকে ব্যানার্জীদের বারান্দায় অনেকগুলো নতুন মুখ,
ধূপের গন্ধ, কান্নার রোল! কথায় কথায় বুঝতে পারেন বাস্তবিকই অঘটন একটা ঘটেছে।
ব্যানার্জীবাবুর স্ত্রী আর নেই। দুপুরের দিকে হঠাৎ করে বুকে ব্যথা… মিনিট পনেরোর মধ্যে
সব শেষ। এর খানিক পর গরদের কাপড় জড়িয়ে, আলতা-সিন্দুর-চন্দনমাখা অমন সুস্থ সবল ব্যানার্জীবাবুর
স্ত্রী, নিজের ভরা সংসারখানা পিছনে ফেলে রওয়ানা হলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাড়া ফাঁকা
হয়ে গেল।
জ্যৈষ্ঠ মাস। গুমোট গরম।
বহুকাল
পর সন্ধ্যে লাগতে না লাগতেই সরমা জানালাখানা হাট করে খুলে বাইরে তাকালেন। উল্টোদিকে
ব্যানার্জীদের অন্ধকার বারান্দা, শুকনো গাছের টব,
কাপড় মেলার দড়ি, ফাঁকা বেতের দোলনা... কেবল যে জন্য এত হাপিত্যেস, সেই দক্ষিণের বুক ভরা ঠান্ডা হাওয়াটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও সরমা আজ আর কোথাও
খুঁজে পেলেন না...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন