বুধবার, ১ মে, ২০১৯

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




দুপুরের অলসতায় নিরামিষ কবিতারা



কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে চলেছেন কবিরা কিন্তু পরীক্ষার বিষয় নিয়ে কী
ভাবনাচিন্তা করছেন মানুষজন, সেটা পরীক্ষার দরকার কবিতা আমার কাছে মুহূর্তের
আবেগের প্রতিলিপি লেখার পর মনেও থাকে না অনেকসময় কেন লিখেছিলাম! কবিতার মধ্যে যাপন থাকা উচিত কেন লিখছি কবিতা? কতগুলি শব্দ যোগ করলেই কবিতা হয় না! কোর্টপ্যান্ট পরা বাবুরা ফটাস ফটাস করে কবিতা আওড়াচ্ছেনএমনটা নয় যে কবি হতে গেলে ধুতি পাঞ্জাবি পরতে হবে কিন্তু একটা যাপন দরকারকবির  মধ্যে সমাজচেতনা থাকবে, এটা তো বলে দেবার নয়! বেশীরভাগ ক্ষেত্রে  মিল পাওয়া যায় না কবিতার সাথে  কবির যাপনের

কবির জীবন যেমন বদলাচ্ছে বর্তমানে, বদলে যাচ্ছে কবিতার অবয়ব এক লাইনেও কবিতা হচ্ছে এক লাইন নিয়ে কবিতাগুলি অসম্ভব ভাবে দাগ কাটছে মানুষের মনে যেমন একটা এক লাইনের কবিতাকে এইভাবে ভাবা যায় -

‘মধ্যরাতে খুলে যাওয়া ব্রয়লারে'র অপর নাম নারী’

অর্থাৎ একটি লাইনে কবিতার সারমর্ম ব্যক্ত করা হচ্ছেবর্তমানে ছবি-কবিতা উঠে এসেছে। একটি কবিতাকে পুরোপুরি ছবির আকারে লিখে ফেলা হচ্ছে কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে, কবিতা বুঝতে গিয়ে যদি মানুষকে অভিধান হাতে নিয়ে বসতে হয় কিংবা মস্তিষ্ক'র উর্বরতা শক্তি বাড়াতে হয়, তাকে কি আমরা  আদৌ কবিতা বলব?

কবিতা হবে আকাশের মত খোলা খাতা, জলের মত স্বচ্ছ কবিতা বুঝতে মানুষকে এত
পরিশ্রম কেন করতে হবে? বর্তমানে কবিতার ভবিষ্যত খুব খারাপ, অনেকেই বলছেন

কিন্তু  উৎসাহ কেউ দেন না বড় বড় বাণিজ্যিক পত্রিকাতে যারা লেখেন তারাই নাকি
বড় কবি! কবিকে কিনে ফেলা হচ্ছে! কেনা হচ্ছে তার ব্রান্ডতাবেদারিত্ব করছেন
কবিসাধারণকোন বড় মাপের কবির আশেপাশে ঘুরলেই একজন কবি আখ্যা পাচ্ছেন
তাঁর ডাক পড়ছে বিভিন্ন কবিতাউৎসব, সাহিত্যসভায়। কর্পোরেট হাউসগুলো অনেক টাকার বিনিময়ে কিনে নিচ্ছে এনাদের যোগ্যতা থাক বা না থাক তাবেদারিত্ব করলেই বড় কবি হওয়া যায়প্রথাটা আজকাল এমনই হয়ে উঠেছে অদ্ভুত একটা ট্রেন্ড কাজ করছে একটা গোষ্ঠী তৈরী করছেন এই কর্পোরেট হাউসগুলো এরাই নাকি বর্তমানে বাংলা কবিতার ভবিষ্যত নির্ধারণ করবেন নামী পত্রিকাগুলোতে ছাপা হচ্ছে এনাদের কবিতাকবিতার গুণ না কবির ক্যারিশমা মুখ্য এখানে। কোন্‌ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে কবিতার চর্চা? কে পড়বে এই কবিতা আর কেনই বা পড়বে?

লিটল ম্যাগাজিন থেকে বড় হওয়া কবির সংখ্যা কম না এদেশে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল ইসলামকে পরিচিতি দিয়েছে ছোট পত্রিকাগুলিকিন্তু তাদেরকে সব সময় তুচ্ছ
তাচ্ছিল্য করা হয়। লিটল ম্যাগাজিনের কোন মর্যাদা নেইএনারা ভুলে যান মহাশ্বেতা
দেবীর কথাএছাড়াও অনেক কবিগণ সে সময় ছিলেন যাদের কয়েকটি লাইন ছাপার
অক্ষরে ছাপাতে বহু মূল্য চোকাতে হয়েছিল বর্তমানে সবটাই অনেক সহজ হয়ে গেছে
সবাই কবি আর সবার কবিতাই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হচ্ছে, এমনটা যদি না হত তাহলে হয়ত বাংলা কবিতার ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হত

কোনটা কবিতা আর কোনটা নয় এ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যাবেবাংলা কবিতায় প্রবেশ করেছে অনেক ইংরাজী শব্দ তা বেশ কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মনে হয়বাংলা কবিতায় কতগুলি ইংরাজী শব্দ বসালেই পোর্স্ট মডার্ণ  যুগের কবিতা হয়ে ওঠে নাকবিতার মধ্যে একটা আধুনিকতা থাকা চাই কবিকে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে অনেক যত্নবান হতে হবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না

এখন আসি কবিতার বিষয়ভাবনা নিয়ে যেমন বহুবার ভেবেছি  ‘প্রেম’ নিয়ে কিছু
কবিতার সিরিজ লিখবো, কিন্তু আজও হয়নি তবে কি  জীবনে প্রেম আসেনি? নাকি
এটা  লেখার সীমাবদ্ধতা? প্রেম যে আসেনি তা নয়, আসলে প্রেম টেকেনি বলা যেতে পারে
আসলে একা থাকার মধ্যে যে বিশেষত্ব থাকে তাকে প্রকাশ করা যায় না একা বলতে এখানে প্রেমহীনতা বোঝাতে চাওয়া হয়নি! একা বলতে নিজের সাথে নিজের সহবাসকে বোঝাতে চাওয়া হয়েছেলিখতে ভালোবাসিতা অনেকে ভালোবাসেকী লিখি কেন লিখি, অর্থ থাকেও না স্বভাবতই একজন কবিকে সহবাস করতে হয় কবিতার সঙ্গে মিথ্যা কতগুলি শব্দ যা কবির বাস্তব  জীবনের সাথে জড়িত না তা কখনই সার্থক কবিতা হয়ে ওঠে না। 
একজন কবিকে একাত্ম হতে হয় কবিতার আত্মার সাথে জীবনে যা কিছু ঘটে তা সবটাই প্রকাশ পায় না কিংবা প্রকাশ করা যায় নাকিন্তু যা প্রকাশিত তার সাথে তঞ্চকতা করা উচিত নয়একজন কবিকে সর্বদা সৎ থাকতে হয় নিজের প্রতি, নিজের সৃষ্টির প্রতি
যা সৃষ্ট তা সর্বদাই নদীর মত তরঙ্গায়িত হওয়া উচিত নদী যেমন আপন বেগে ছুটে চলে, কবিতাও তেমনি আপন বেগে ছুটে চলে যখন যে পাত্রে থাকে তখন সেই আকার
ধারণ করে জীবন যতটা কঠিন কবিতা লেখা তার থেকেও কঠিন একটা সাধনা
সারাজীবন ধরে দর্শনকে আগলে যেমন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, পারে না তেমন
ভাবেই কবিতা লিখতে সাধনায় যে সিদ্ধি লাভ করে, সেই হয় কবি  ব্যাকরণ মেনে
কি কবিতা লেখা হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, হয় না কেউ কি বলে দিতে পারে
এই ভাবে কবিতা লিখতে হয়? এটাই কবিতা লেখার নিয়ম? বোধহয় নয়! সবটাই একটা পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক কাজযেমন এভাবে ভাবা যায়-

‘দেখি এ পথের শেষে ঘুরে বেড়ায় কত পথ দোয়েল, ফিঙে, মুনিয়া দাঁড়িয়ে থাকে
আকাশের সন্ধ্যাতারা বলে কয়েক মিনিট আর কয়েক মিনিট
বড়ো অসময়ে এলি...
দ্যাখো অগ্নিসাক্ষী করা খই কেমন চোখ বুজে আছে
কিছুটা সাবান মেখে নিলে কপালের লালচে রঙ ঘোলাটে হয়ে যায়
পদ্মকলির চোখের জল শুধু জল
আর জলটুকু নিয়ে বাঁচে
তবু পথ আর বেড়ে চলে’

একে কবিতা / অকবিতা / মন্দ কবিতা বলা চলে, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ধরনের লেখার
বিষয়বস্তু কী এবং কেন?

অন্তহীনতা বা শূন্যতাকে বপন করে অনেকেকিন্তু তাকে রক্ষণ করতে পারে ক’জন?
সিলভিয়া প্লাথের কবিতা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যনিতান্ত বিষাদ নিয়ে তিনি লিখেছেন
একজন কবি কতটা কবিতার সাথে একাত্ম হলে এমন লিখতে পারেন!

Blackberrying

Nobody in the lane, and nothing, nothing but blackberries,
Blackberries on either side, though on the right mainly,
A blackberry alley, going down in hooks, and a sea
Somewhere at the end of it, heaving. Blackberries
Big as the ball of my thumb, and dumb as eyes
Ebon in the hedges, fat
With blue-red juices. These they squander on my fingers.
I had not asked for such a blood sisterhood; they must love me.
They accommodate themselves to my milkbottle, flattening their sides.

Overhead go the choughs in black, cacophonous flocks—
Bits of burnt paper wheeling in a blown sky.
Theirs is the only voice, protesting, protesting.
I do not think the sea will appear at all.
The high, green meadows are glowing, as if lit from within.
I come to one bush of berries so ripe it is a bush of flies,
Hanging their blue green bellies and their wing panes in a Chinese screen.
The honey-feast of the berries has stunned them; they believe in heaven.
One more hook, and the berries and bushes end.

The only thing to come now is the sea.
From between two hills a sudden wind funnels at me,
Slapping its phantom laundry in my face.
These hills are too green and sweet to have tasted salt.
I follow the sheep path between them. A last hook brings me
To the hills’ northern face, and the face is orange rock
That looks out on nothing, nothing but a great space
Of white and pewter lights, and a din like silversmiths
Beating and beating at an intractable metal.

আলো আঁধারি মাঝেই শব্দরা জাল বোনে অনেক কবি লিখতে ভয় পান
অনেকের প্রকাশে ভয়  আমি ভয় পাই নিজেকেলিখতে লিখতে একটা কবিতা  এক
খাত থেকে অন্য খাতে গড়ায়তা অনেক ক্ষেত্রে পছন্দ হয় নাহিজিবিজি দিয়ে কাগজ
ভরাইতার সীমানা জানা নেই কারোরএমন অন্ধকারে কবিতার গায়ে জ্যোৎস্না লাগে
ভেঙে যায় ঘুম তীব্র অহংকারে বিদীর্ণ হয়অন্ধকার থেকে অন্ধকার আলাদা করে  বুনে চলে,  প্রাচুর্যের ইস্তাহার ৷ crisis না থাকলে লেখা হয় নালেখালেখি বলতে যতটুকু তার সব  ঋণ বিনয় মজুমদার ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়।      এত শব্দ বৈচিত্র্য এত গভীর ভাবনা । মাঝে মাঝে ভাবি আমি ভাবতে পারি না কেন? এত সহজ ভাবে কী ওরে ওনারা বলতে পেরেছেন...

‘বুঝতে ও বোঝাতে আমি চিরকালই অক্ষম তাই তো লিখি-
মনখারাপি শব্দগুলো ভেসে বেড়ায় মেঘেদের উঠান জুড়ে
এক পা দু’ পা করে শূন্য হয় রাতের চোয়াল
আলাপি আলনায় রাখা জামাকাপড় একটা
একটা করে নিশ্চিহ্ন হয়

তারাদের গ্রামাফোনে বাজে
এক মোহব্বত মে কুরবান হাজারো সাল
দুসরি মেরি ইমতিহান’

আসলে  কোন নির্দিষ্ট বিষয়ভাবনা নিয়ে লেখা হয় না আমার তাই জোর করে কোন
বিষয় চাপিয়ে দিলে লিখতে পারি না এমনই এক সকালে এই চার লাইন লেখা
বড় একান্ত লাইনগুলি

‘বুকের ভাঁজে হাত দিলে অর্ধেক জীব
পুরুষ হয়ে ওঠে’

কখনও লিখে ফেলি ভূতেদের কবিতাকখনও একলা ঘরে যখন সব অন্ধকার মনে হয় কথা বলিহ্যাঁ দু’ চার কথা বলতে ইচ্ছা করে অশরীরীদের সাথে তারা কী করে কোথায় থাকে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় ভাবনা আসে কিন্তু লেখাগুলো পুরোপুরি হয়ে ওঠে না। সম্প্রতি আগুন নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছেতাই এই সিরিজের জন্ম

আগুন সিরিজের কবিতা

(১)

শূন্যকে ব্যস্তানুপাতে রাখলে
একই উপাদান বারে বারে আসে
রোদ্দুরের কালিমুখে তার একটাই
পরিচয়
‘আগুন’

(২)

আলো
আরও অপরিচিত হও
একটু নিষেকের প্রয়োজন গুহার
কালো মুখে'
আকর্ষণ টেনে টেনে নেয় যতটুকু
তার থেকে তীব্র অনীহার লেশমাত্র বিস্ফারিত হয় না

(৩)

তুমি অনুভব করো পিটুইটারি
আর অভ্যন্তরে স্পষ্টবোধ্য উভগতি
পুনরায় ‘আগুন’ জ্বলবে
আলোর বিপরীতে
প্রদীপের নীচে

৪)

মরচের দাগে লেগে থাকাটাই
‘আগুনে’র অসুখ

1 টি মন্তব্য: