ইতিহাসের জেরোনিমো
(৬)
জেরোনিমো
অ্যাপাচে
বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্বে শুধুমাত্র তরোয়াল ও বর্শা
সম্বল করেই গোয়াথালে বন্দুকধারী সৈন্যদের
বিরুদ্ধে সাংঘাতিক লড়াই শুরু করেন। এই ধরনের একাধিক হামলায় শত্রুপক্ষের অসংখ্য
সৈনিক হতাহত হয়। অক্ষত অবস্থায় প্রতিবারই বিজয়ী হতে থাকেন জেরোনিমো অ্যাপাচে।
শত্রুপক্ষ তাঁর কেশ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। শত্রুপক্ষের এহেন রক্তক্ষয়ে
আনন্দিত অ্যাপাচেগোষ্ঠী জেরোনিমের মধ্যে
এই ঐশ্বরিক শক্তি আবিষ্কার করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ঐশ্বরীয় ক্ষমতার
বলেই তিনি প্রত্যেকবার শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় দলপতি
মেংগাস কোলোরাডসের নেতৃত্বে যোদ্ধারা মেক্সিকান সৈন্যদলের সাথে আমৃত্যু যুদ্ধের
শপথ নেন।
জেরোনিমো অ্যাপাচের বক্তব্য – ‘আমি আর কখনই সেই
নিস্তব্ধ কুঁড়েঘরে ফিরে যাইনি। একথাও সত্য যে আমি আমার পিতার কবরে কোনোদিন
পুষ্পার্ঘ নিবেদন করিনি; কিন্তু আমি মেক্সিকান সৈন্যদের সাথে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস
পর্যন্ত যুদ্ধ করার শপথ করেছি আমার পিতার নাম স্মরণ করে এবং যতক্ষণ না আমি আমার
প্রিয়জনদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারছি ততক্ষণ শান্ত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না’।
যাইহোক এবার তিনি যান তাঁর জন্মভিটে অরিজোনায়। উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে বেছে
বেছে যোদ্ধাদের একত্রিত করেন। তিনি অ্যাপাচে উপজাতির অন্যান্য গোষ্ঠীর যোদ্ধাদেরও
এই লড়াইতে সামিল করেন। যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য - ‘ভাই আপনারা সকলেই জানেন
যে মেক্সিকান সৈন্যদল কী অমানুষিক
বর্বরতার সঙ্গে আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে আমাদের গোষ্ঠীর বয়োবৃদ্ধ, শিশু ও মহিলাদের
হত্যা করেছে। আমরাও এই মেক্সিকানদের মতোই
রক্ত মাংসের মানুষ। তারা আমাদের সাথে যেরকম ব্যবহার করেছে আমাদের উচিৎ তাদেরও
এভাবেই আক্রমণ করে শিক্ষা দেওয়া। আসুন
আমরা সবাই একত্রিত হয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ি’। তিনি আরও বলেন – ‘এই লড়াইয়ে সবার আগে থাকব আমি। আমরা তাদের শহর আক্রমণ করব,
তাদের ঘরে আক্রমণ করব এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধে মাতব। আপনারা আমাকে সহযোগিতা করুন।
মনে রাখবেন, যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচেও ফিরতে পারে অথবা
মৃত্যুবরণ করে শহীদও হতে পারে। লড়াইয়ের ময়দানে কোনো যোদ্ধার মৃত্যু হলে তাঁর নিকট
আত্মীয়রা আমাকে যেন দোষী না ভাবেন, কারণ যোদ্ধাকুল স্বেচ্ছায় এই পথ গ্রহণ করেছেন।
আমার মৃত্যু ঘটলেও শোক প্রকাশের প্রয়োজন নেই’। পরিশেষে
বলেন – ‘শত্রুপক্ষ যেহেতু আমাদের সৈন্যদের হত্যা করেছে বা হত্যা করতে দ্বিধা করবে না, তাই তাদের
হত্যা করতেও আমার আপনাদের দুঃখ পাওয়া উচিৎ নয়’।
শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন সহ একের পর এক বিজয়
পাওয়ার পর দলীয় সরদার বা দলপতি মেংগাস কোলোরাডসকে এ সম্পর্কে অবগত করতে থাকেন
গোয়াথালে। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মেছি-অ্যাপাচে সম্প্রদায়ের মানুষকেও নিজ দলের
সঙ্গে যুক্ত করেন।
১৮৫৮ সালে জেরোনিমো খবর পান যে তাঁদের বাসস্থানের
দক্ষিণ দিকে একদল সাদা চামড়ার বিদেশী জমি মাপ-জোকের কাজে ব্যস্ত। জেরোনিমো তাঁর
সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছন। একে অপরের ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে
তাঁদের মধ্যে বাক্য বিনিময় সম্ভব হয়নি কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের ভাব
প্রকাশের জন্য জেরোনিমো তাঁদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর
বিদেশীদের বাসস্থানের নিকটেই নিজেদের তাঁবু খাটিয়ে, তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক
গড়ে তুলেছিলেন অ্যাপাচেরা। অ্যাপাচে গোষ্ঠীর তৈরি কম্বল, টাট্টুঘোড়া ইত্যাদি
বিদেশীদের পছন্দ হয়। বিনিময়ে তারা অ্যাপাচে সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের কাপড়,
অন্যান্য সামগ্রী ও কিছু কাগজের নোট (টাকা) দেয়। সেইসময় কাগজের নোট অর্থাৎ টাকার
মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন অ্যাপাচেরা। পরে
অবশ্য এর মূল্য বুঝতে পারেন তাঁরা।
সাহেব বা সাদা চামড়ার বিদেশী ব্যক্তিদের জমি মাপার
পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে রেড-ইন্ডিয়ানদের কোনো ধারণা ছিল না। জমি মাপার কাজ
শেষ হতেই বিদেশী দল অন্য স্থানে চলে যায়।
এই প্রথম বিদেশীদের সম্পর্কে এসে তাদের সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা তৈরি হয় জেরোনিমো
ও তাঁর সহযোগিদের।
১৮৫৯ সালে অ্যাপাচে উপজাতির তিনটি শাখা মেক্সিকো শহরে
পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি; দ্বিতীয় দিনেই বেলা
দশটা নাগাদ মেক্সিকো সৈন্যদলের চার কোম্পানি দুই কেভেলারী ও দুই ইনফ্যান্ট্রি
তাঁদের বাসস্থানের নিকটে এসে থামে। জেরোনিমো তৎক্ষণাৎ তাদের চিনতে পারেন। কারণ এই
সৈন্যদলই তাঁদের তাঁবুতে আক্রমণ করে তাঁদের সর্বহারা করেছিল। দলপতিকে তিনি একথা
জানালে তিনি জেরোনিমোর ওপরেই লড়াইয়ের নেতৃত্বভার অর্পণ করেন।
দলপতি না হওয়া সত্বেও জেরোনিমোকে নেতৃত্ব দেওয়ার
অধিকার দেওয়া হয়, কারণ মেক্সিকান সৈন্যদলের নৃশংস, বর্বর হত্যাকান্ডে আত্মীয়-পরিজন
হারানো জেরোনিমো প্রচন্ড আঘাতের অনলে দগ্ধ। এমতাবস্থায় তাঁর থেকে যোগ্য নেতৃত্ব
দেবার মতো কেই বা আর থাকতে পারে! দলপতির কাছ থেকে পাওয়া সম্মান ও নির্দেশের
যথাযোগ্য মর্যাদা রেখেছিলেন জেরোনিমো। জেরোনিমো তাঁর সৈন্যদলকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে
দেন এবং নদীর দিকের পথ রাখেন উন্মুক্ত। পাহাড়ের জঙ্গলে কিছু অ্যাপাচে যোদ্ধাকে
তৈরি থাকতে বলা হয়। মেক্সিকান সৈন্যদল বৃত্তের উন্মুক্ত পথ অতিক্রম করে পাহাড়ে
ওঠার চেষ্টা করে এবং প্রায় চারশো গজ দূর থেকে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই
তুমুল ও অসম লড়াইয়ে জেরোনিমো ও তাঁর তিনসঙ্গী কোনোরকমে রক্ষা পান। অপর দিকে অ্যাপাচে
যোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত তীরের ফলা শত্রুশরীরে বিদ্ধ হতেই থাকে। ধনুকের আয়ু ফুরালে
কেবলমাত্র ছুরি ও হাত সম্বল করে তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং এভাবেই তাঁরা বহু মেক্সিকান সৈন্যদের হত্যা
করেন। পরে লাগাতার শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণে
জেরোনিমোর তিন সঙ্গীর মধ্যে দুজন নিহত হলে তিনি ও তাঁর আর এক সঙ্গী দলের অন্যান্য
সঙ্গীদের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করেন। এবার শত্রুপক্ষের ছোঁড়া গুলিতে তৃতীয় সঙ্গীটিও
ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। এমতাবস্থায় জেরোনিমো কোনোক্রমে সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যান
এবং তাঁকে অনুসরণরত দুজন মেক্সিকান সৈন্যর মধ্যে একজনকে হত্যা করেন এবং মৃত
মেক্সিকান সৈন্যটির বন্দুক নিয়ে অপরজনকেও বধ করেন। ওদিকে পাহাড়ে ওঁত পেতে থাকা
অ্যাপাচে সৈন্যরা যখন মেক্সিকান সৈন্যদের খোঁজে নিচে নেমে আসেন তখন তাঁরা দেখেন
শত্রুপক্ষের আর কোনো সৈন্যই জীবিত নেই। বরং রক্তে প্লাবিত গোটা এলাকায় ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মেক্সিকান সৈনিকদের নিথর মৃতদেহ। সেই মৃত সৈনিকদের বন্দুক গুলি
সংগ্রহ করে যুদ্ধ জয়ের আনন্দধ্বনি দিতে দিতে অ্যাপাচে সৈন্যদল তাঁদের দলপতিকে বিজয়
সংবাদ জানালে তাঁর মুখমন্ডলে ফুটে ওঠে এক পরিতৃপ্তির হাসি। বলাই বাহুল্য, অ্যাপাচে
প্রতিটি সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবনিতা এই
দুর্দান্ত প্রতিশোধমূলক জয়ে বিজয়ানন্দে ভেসে যান। এরপর ঠিক হয় পরবর্তী সমস্ত লড়াই বা যুদ্ধেই
নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের নয়নের মণি জেরোনিমো।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন