শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




কিংবদন্তি পুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়া




(২)

শুরু অভিনয় জীবন ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের ছবি টাকায় কী না হয়এই ছবিতে  প্রমথেশবাবু ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দৃশ্য মানে নায়িকা সবিতা দেবী ওরফে আইরিশ গ্যাসপারের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে অন্তরঙ্গ হওয়ার  মুহূর্ত। ড্রাইভারের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশের বন্ধু নির্মল বরকাকতি। কিন্তু ওই ছোট্ট একটা দৃশ্য সাত দিনেও পারফেক্ট হল না! পরিচালক পড়লেন ফাঁপরে। কিন্তু কেন যে হচ্ছে না, তা ড্রাইভারের সিটে বসেই বুঝে ফেলেছিলেন নির্মলবাবু।  অন্তরঙ্গতা বেড়ে চলেছে আইরিশ ও প্রমথেশের মধ্যে।

১৯৩০-এ  যকৃতে পাথর ধরা পড়ে প্রমথেশবাবুর। চিকিৎসা করাতে যান ইউরোপে। ওখানে গিয়েই একটা স্বপ্ন দেখলেন। তৈরি করতে হবে ফিল্ম কোম্পানি। উঠেপড়ে লাগলেন ফিল্ম মেকিং শিখতে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ইউরোপে। প্রমথেশ গিয়ে ধরলেন তাঁকে। ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে প্রমথেশ দেখা করলেন সেই সময়ের নামী ক্যামেরাম্যান রোজার্সের সঙ্গে। হাতেকলমে শিখলেন সিনেমায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার, যা তখন ভারতীয় সিনেমায় অজানা। প্রমথেশ কলকাতায় ফিরলেন শুটিংয়ের জন্য বিস্তর আলো ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে। তখন দিনের বেলাতেই শুটিং হত। ইউরোপ থেকে ফিরে প্রমথেশ বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিটতৈরি করেন। সঙ্গে নিলেন পরিচালক দেবকী বসু ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপালকে। প্রথম ছবিটি নির্বাক, ‘অপরাধীকাহিনি ও পরিচালনায় দেবকী বসু। অভিনয়ে প্রমথেশ, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়  এবং সেই আইরিশ গ্যাসপার৷ বাংলা চলচ্চিত্রে সেই প্রথম কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। চিত্রা টকিজে ২৮ নভেম্বর, ১৯৩১ সালে মুক্তি। বসুমতী পত্রিকা প্রশংসা করে  অপরাধীর। এর পরে আরও দুটি নির্বাক ছবিএকদাএবং নিশির ডাককাহিনি প্রমথেশের। কলকাতার গৌরীপুর হাউজের একটা অংশ নিয়ে শুরু  করলেন বড়ুয়া স্টুডিয়োর কাজ। সেখানে একদার কিছু অংশ শুটিংও হয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পরে বাংলার অবস্থা ভেবে লেখা নিজস্ব কল্পকাহিনী নিয়ে ছবি  করলেন বেঙ্গল নাইন্টিন এইট্টি থ্রিসুপারফ্লপ হল সেটি। সিনেমার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করছিলেন তিনি। টাকা আসত গৌরীপুর রাজবাড়ির এসেস্ট থেকে। কিন্তু সেটাও বন্ধ হল। এস্টেটের দেওয়ান  প্রমথেশের বাবাকে সাবধান করেছিলেন ছেলের এভাবে টাকা ওড়ানোর ব্যাপারে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে দেওয়ানের কথামত টাকা পাঠান বন্ধ হয়৷ কারণ বাবা ততদিনে বুঝে গিয়েছেন, ছেলের দ্বারা আর যা-ই হোক, ব্যবসা হবে না। ফলে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় বড়ুয়া ফিল্ম কোম্পানি। এতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।




সুসময় এল ১৯৩৩ সালে। নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিলেন তিনি। সেখানে তাঁর প্রথম সবাক ছবি রূপলেখা।নায়িকা যমুনা দেবী। সেটি ছিল যমুনার ডেবিউ ছবি। যে ছবি থেকে প্রমথেশ-যমুনার প্রেমপর্ব শুরু। ১৯৩৫ সালে বাংলা ও  হিন্দিতে পরিচালনা করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাসবাংলায় দেবদাসের চরিত্রে তিনি আর পার্বতীর চরিত্রে যমুনা। হিন্দিতে দেবদাস হলেন কে এল সায়গল। শুধু মাত্র টেকনোলজি নয়, শট নিয়েও বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন এই ছবিতে।  ক্যামেরায় শট নেওয়ার ধরনধারণে, অনুপুঙ্খে দেবদাসতখন নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক। চলন্ত ট্রেনের কামরায় উদ্‌ভ্রান্ত দেবদাস। মন্তাজ,  ইন্টারকাটিং,  ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে নাটকীয়তা তৈরি করতেন ছবির পরতে পরতে। দেবদাসইতিহাস তৈরি করল। শোনা যায়, উত্তমকুমার দেবদাসের চরিত্রটি পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্রেফ বড়ুয়া সাহেবের ইমেজটা ভাঙতে পারবেন না বলে। উত্তমকুমার মনে করতেন, ‘দেবদাসমানেই প্রমথেশ বড়ুয়া। ১৯৩৬ সালে প্রমথেশবাবুর গৃহদাহমায়াও বেশ হিট করেছিল । এর পরে আর এক ঐতিহাসিক ছবি মুক্তিএক বোহেমিয়ান শিল্পীর জীবন। এই ছবিটেও শট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। মুক্তিই প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। এর জন্য সানন্দ অনুমতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবির নামকরণও তিনিই করেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিক প্লেব্যাক করেছিলেন। আউটডোর হয়েছিল গৌরীপুরের জঙ্গলে। যেখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রিয় হাতি জঙ্গবাহাদুরকে। মুক্তিপ্রমথেশ ও কাননদেবীর জুটিকেও হিট করে। সুপারহিট হয় ছবিটি। এর পরে পরিচালনা করেন অধিকারতারপর মাত্র ২১ দিনে শুটিং শেষ করেছিলেন কমেডি ছবি রজত জয়ন্তীর, যা সেই সময়ে অকল্পনীয়এত সাফল্যের পরেও ১৯৩৯ সালে নিউ  থিয়েটার্স থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। চুক্তিবদ্ধ হন কে মুভিটোনের সঙ্গে। এই ব্যানারে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি শাপমুক্তিরবীন মজুমদার ও পদ্মাদেবী নায়ক নায়িকা। প্রমথেশ বড়ুয়ার হাত ধরে এই জুটিও বিখ্যাত হয়েছিল।

প্রমথেশবাবুর স্ত্রী মাধুরীলতা কিন্তু বন্ধুর মতো সারা জীবন পাশে থেকেছেন। সব রকম বিপর্যয়ে উদারতা দেখিয়েছেন। মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর একাধিক পরকীয়া। অর্থাভাবে যখন প্রমথেশের শখের স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে গেল,  মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে তাঁর জীবনে এসেছিলেন অসমের লক্ষ্মীপুরের জমিদারবাড়ির মেয়ে অমলাবালা। অমলাবালার পরিবারের সঙ্গে গৌরীপুর রাজবাড়ির যোগাযোগ পুরনো। ওঁরা পরস্পরকে চিনতেন। অমলাবালাকে তিনি আদর করে ক্ষিতিডাকতেন। কিন্তু সেই ক্ষিতির সঙ্গে বিয়ে প্রমথেশের বাবা মেনে নেননি। কারণ মাধুরীলতা ছিলেন রাজবাড়ির সেরা বধূ। তা ছাড়া সে সময় প্রমথেশ দুই পুত্রের জনক। ক্ষিতিকে বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটে, যা জোড়া লাগেনি আর কখনও। পরবর্তী কালে ক্ষিতি  অসুস্থ হলে তাঁকে গৌরীপুরে রেখে গিয়েছিলেন প্রমথেশবাবু। নিজে যেতেন কম। ক্ষিতি মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে অরূপকুমারকে মাধুরীই বড় করেছিলেন৷ প্রমথেশের তৃতীয় স্ত্রী যমুনা বড়ুয়া। যাঁকে কোনও দিনই গৌরীপুরের রাজ পরিবার স্বীকৃতি দেয়নি। প্রমথেশের সঙ্গে পরিচয় ছিল যমুনার দিদির। যিনি প্রমথেশের দুটি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু একদিন দিদির সঙ্গে বোনকে দেখে প্রমথেশ ঠিক করেন, এঁকেই অভিনেত্রী হিসেবে গড়েপিটে নেবেন। শুরু হল আর এক প্রেমের  অধ্যায়। প্রমথেশ বড়ুয়ার মৃত্যুর অনেক পরে  কলকাতার বাড়িতে যমুনাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন আমি কলেজে পড়ি। বাড়ির অজান্তেই গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘গৌরীপুর থেকে আমাকে কেউ দেখতে আসবে ভাবতেই পারিনি!’ সেই সময়ে তাঁর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ওঁদের তিন ছেলে  দেবকুমার, রজত ও প্রসূন”। স্মৃতি রোমন্থন করেছেন প্রমথেশের ভাগ্নি অনিতা  বড়ুয়ার ছেলে বিক্রম গ্রেওয়াল। একাধিক প্রেমের প্রসঙ্গে ভাইকে প্রমথেশ বলেছিলেন, “আমি তো এক-দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। বাকিরা হুমড়ি খেয়ে  আমার উপর পড়লে আমার কী দোষ?”




স্বপ্নভঙ্গ হলেও তিনি দমে যেতেন না। এই ছিল তাঁর স্বভাব৷ প্রেমিক মনটার সাথে ছিলেন দৃঢ়চেতাও৷ ১৯৪০ সালে মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে এম পি প্রোডাকশন তৈরি করেন। এই ব্যানারে প্রথম ছবি মায়ের প্রাণএরপরে উত্তরায়ণনায়িকা যমুনা দেবী। তারপর শেষ উত্তরনায়িকা কানন দেবী। ছবিটি সুপারহিট হওয়ায় একই গল্প নিয়ে হিন্দিতে করেন জবাবকিন্তু এম পি প্রোডাকশনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক টিকল না।

পরিচালকঅভিনেতা হিসেবে সফল হলেও ব্যবসায় তিনি টিকে থাকতে  পারছিলেন না। অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত তাঁর মেজাজ। রাজরক্ত রয়েছে তাঁর শরীরে৷ এম পি থেকে বেরিয়ে দুবছর তিনি কোনও ছবি করেননি। আবার পরিচালনায় ফিরলেন ১৯৪৪-এ। করলেন চাঁদের কলঙ্কহিন্দি ভার্সন সুবহ সামইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় শুটিং হল। এ ছাড়াও প্রমথেশ আমীরীএবং রানী দুটি হিন্দি ছবি করেছিলেন। বাংলা ছবি অগ্রগামীর পরে তিনি হাত দিয়েছিলেন মায়াকানন’-এ। ওটাই শেষ ছবি। মায়াকাননএর শুটিং শেষ হওয়ার আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রমথেশ। ১৯৪৮ সালে আবার চিকিৎসার জন্য যমুনা দেবীকে নিয়ে সুইৎজ়ারল্যান্ড গিয়েছিলেন। জানা গেল চরম রক্তাল্পতায় ভুগছেন তিনি। চিকিৎসার দরকার। সেখান থেকে ফেরার পথে গেলেন লন্ডন। তখনও তাঁর মাথায় রুপোলি পর্দা।

এবার এ জে আর্থার র‌্যাঙ্ক সংস্থার সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন ইন্দো-ব্রিটিশ ছবি পরিচালনার। ১৯৫১ সালে চিকিৎসা করাতে তিনি আবার ইংল্যান্ড গেলেন। লাভ হল না তাতেসেই বছরেই ২৯ নভেম্বর লাইট, ক্যামেরা, সেট সব ফেলে চলে  গেলেন প্রমথেশ। গৌরীপুর নয়, আরও দূরে। সেখানে প্রেম, কুয়াশা, প্রজাপতি আর নৈঃশব্দ্য একাকার হয়ে যায়। পরবর্তী অধ্যায় থেকে গেল অন্তরালে৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন