ইতিহাসের জেরোনিমো
(৫)
জেরোনিমো
অ্যাপাচে
মেক্সিকান
উপজাতি, অ্যাপাচে গোষ্ঠীর এক দম্পতির তবলিশম ও জুআনা-র সংসারে ১৮২৯ সালে ভূমিষ্ঠ
হয় এক শিশুপুত্র। নিজ সম্প্রদায়ের নির্যাসে তাকে লালন পালন করতে থাকেন তাঁরা গেলা
নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে (বর্তমানে অরিজোনা)। তবলিশম ও জুআনা তাঁদের আদরের সন্তানের
নাম রাখেন গোয়াথালে, যার অর্থ যে সেলাইয়ের কাজ করে। অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়ে মায়ের
স্নেহ-ছায়ায় অন্যান্য ভাইবোনদের সাথেই বেড়ে উঠতে থাকেন গোয়াথালে। ১৭ বছর বয়সে এলোপে
(Alope)
নামের এক যুবতীর সাথে তার (নেদনি চিরিকাহুয়া অ্যাপাচে গোষ্ঠীর
কন্যা) বিবাহ হয়। তাঁদের তিনটি সন্তান ছিল। গোয়াথালে ছিলেন তাঁতি। কাপড় বুনে
মেক্সিকো শহরে বিক্রি করে সংসার চালাতেন।
সেই
দিনগুলি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন – “আমি আমার সম্প্রদায়ের অন্যান্য ব্যক্তিদের মতোই
সূর্যকিরণ থেকে তাপ সংগ্রহ করতাম, শীতল হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতাম ও তরুছায়ায় বিশ্রাম
নিতাম। আমিও চাইতাম শান্তিতে বসবাস করতে; কিন্তু কিছু মানুষ আমাকে বিরক্ত করার
জন্য বদনাম করত। আমি এখন ভালো খাবার খাই, শান্তিতে ঘুমোতে পারি, মন যেদিকে চায়
ছুটে যাই, সর্বোপরি আনন্দের জীবন অতিবাহিত করতে পারি। মেক্সিকান সৈন্যদল সর্বদাই
রেড-ইন্ডিয়ানসদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে নালিশ করেছে। বেছে বেছে নানা অছিলায়
অন্যায় কাজের তালিকা তুলে ধরেছে। কিন্তু কেন বা কী কারণে তারা অন্যায় করতে বাধ্য
হয়েছে তা আলোকপাত করেনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, কখনই অন্যায় আচরণ ও অন্যায়ের
পথে পা বাড়াবো না। আমি ভাবতেই পারি না আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টি নই বা যোগ্য নই। আমরা
সকলেই এক ঈশ্বরের সন্তান এবং তিনি ওপর থেকে আমাদের সকলকেই দেখছেন। সূর্য, বাতাস ও
অন্ধকার সকলেই আমাদের কথা শোনে। বাল্যকালে আমার মা আমাকে নতমস্তকে প্রভুর কাছে
শক্তি, স্বাস্থ্য ও শুভচেতনা প্রদান ও আমাদের রক্ষা করার কামনা করতে শিখিয়েছেন।
আমি কখনো মনে মনে বা উচ্চস্বরে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতাম, কখনো বা বয়স্ক
ব্যক্তিগণ আমাদের জন্য প্রার্থনা করতেন। আমি যেখানে জন্মেছি সেখানে হাওয়া বইত,
সূর্যকিরণ আমাকে তাপ থেকে বঞ্চিত করত না। গোটা বিশ্বপ্রকৃতিই ছিল আমার জন্য
উন্মুক্ত”।
একসময়
মেক্সিকান সৈন্যদল গোয়াথালেকে জেরোনিমোর সঙ্গে তুলনা করে তাঁর নামকরণ করেন
জেরোনিমো। এই নামকরণের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। ব্যবসার
কাজে গোয়াথালে ও তাদের গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের মেক্সিকোতে পদার্পণ ঘটে। শহরের
বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। ১৮৫৮ সালের ৬ই মার্চ শিশু, বৃদ্ধ ও
মহিলাদের তাঁবুতে রেখে সেই দলের সদস্যরা হাতে তৈরি গরম পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী
বিক্রির উদ্দেশ্যে রওনা দেন শহরে। সেই সময়ে মেক্সিকো সৈন্যদলের কর্নেল জোসে মারিয়া
কেরাস্কোর (Cornel Jose Maria Carrasco) নেতৃত্বে অন্তত
চারশোজন সৈন্যের একটি দল তাঁবুর কাছে এসে পৌঁছায় এবং সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাঁবু
লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এই নারকীয় ঘটনায় গোয়াথালের মা, স্ত্রী ও তাঁর
সন্তানদের সাথে অন্যান্য সকলেরই অপমৃত্যু ঘটে। এদিকে শহর থেকে ফিরে লাশের পাহাড়
দেখে ও প্রিয়জনদের বিয়োগব্যথায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন গোয়াথালে। শোকে কার্যত পাগল হয়ে
আহার, নিদ্রা ত্যাগ করেন তিনি এবং এই শোকেই পরবর্তীকালে তাঁর কোমল হৃদয়ে আক্রোশের উন্মেষ
ঘটায়। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিশোধ নেবার সংকল্প করেন তিনি। গোয়াথালে
তাঁর প্রতিশোধকে বাস্তবায়িত করতে দলপতি মেংগাস কোলোরাডস (Mangas Coloradas)-এর অনুরোধে কোচিস সম্প্রদায়ের কাছে যান সাহায্য চাইতে। তারপর থেকেই তিনি
ভয়ঙ্কর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। এরপর প্রতিশোধের আগুনে তেতে পুড়ে পরের পর হামলায় তিনি
মেক্সিকান সৈন্যদের একেবারে নাকানি-চোবানি খাওয়ান এবং সে কারণেই মেক্সিকানরা
গোয়াথালের নামকরণ করেন জেরোনিমো।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন