কিংবদন্তি পুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়া
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে কিংবদন্তি পুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়। অসমের গৌরীপুরের জমিদার বাড়ির ছেলে ছিলেন তিনি। তবে সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে যায় তাঁর অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক রূপে পরিচয়। শোনা যায় তিনি নাকি ১৩ বছর বয়সে বাঘ শিকার করেছিলেন। পরবর্তী কালে সেই সত্যতা অনেকেরই জানা ৷ তিনি প্রায় ৫০টির মত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, ২৩টি চিতা, একটি গন্ডার শিকার করেছিলেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, রাজ পরিবারে সবথেকে কম বাঘ শিকার তিনি করেছিলেন তিনি। প্রথম বাঘশিকার করেন ১৯১৫ সালে। প্রমথেশবাবু যে পবিবারের ছেলে, সেখানে খুব অল্প বয়সে ছেলেদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হত। কিন্তু তাঁর শিকার করতে একদমই ভালো লাগত না। মা সরোজবালা ছিলেন বৈষ্ণব। প্রাণীহত্যা করা মহাপাপ এই শিক্ষা প্রমথেশবাবুকে তাঁর মা শিখিয়েছিলেন। মা খুব সুন্দর গানও গাইতেন। যেহেতু তিনি তাঁর মায়ের চোখের মনি ছিলেন, সেইজন্য তার নাম ছিল ‘মনি’।
কিন্তু ভাগ্যের ফেরে মায়ের শ্রাদ্ধের দিন বন্দুক
নিয়ে বেরোতে হয়েছিল প্রমথেশবাবুকে। বাঘ মারতে।
রাজবাড়ির বাইরে তখন প্রজাদের ভয়ার্ত চিৎকার।
লোকালয়ে বাঘ বেরিয়েছে, সেই বাঘের
হাত থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্য বাঘশিকার করতে হয়েছিল। শিকারে যাওয়া
নিয়ে প্রায়ই মতানৈক্য হত বাবা-ছেলের মধ্যে।
শোনা যায়, শিকারে যাওয়ার সময় প্রমথেশের সঙ্গে থাকত ছোট- বড় বিভিন্ন
ধরনের পাথর। সেইসঙ্গে ইজেল, রং, তুলি, প্যালেট, কাগজ।
শিকার করতে গিয়ে ছবি আঁকতেন তিনি। তাঁর
মন চাইত না কোনও ঘুমন্ত জীবকে হত্যা করতে। তাই পাথর ছুঁড়ে ঘুমন্ত শিকারকে জাগিয়ে
দিতেন। আত্মপক্ষ মোকাবিলা করার সুযোগও
দিতেন। এরজন্য অনেক সময় ফসকে যেত শিকার। যদিও পছন্দ না করলেও তিনি ছিলেন বড় শিকারি। কিন্ত একটা প্রাণীকে
তিনি বিস্তর ভয় পেতেন, তা হল আরশোলা। এই নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে।
গৌরীপুর থেকে কলকাতায় আসার ট্রেনে
রাজবাড়ির লোকেদের জন্য একটা আলাদা কামরা থাকত। প্রমথেশবাবু যাত্রা করলে সেই কামরায়
মশারি টাঙানো হত। ট্রেনে উঠে তিনি মশারির মধ্যে ঢুকে পড়তেন। পাছে আরশোলা উড়ে এসে
তাঁর গায়ে বসে!
প্রমথেশবাবু আপাদমস্তক
শৌখিন মানুষ ছিলেন। সব সময় পরিপাটি থাকতেন। ঘোড়া ও গাড়ির শখ
ছিল। ছ’টা রেসের ঘোড়া ছিল তাঁর।
আর যখন যে গাড়ি বাজারে আসত, তিনি
কিনে নিতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক বিদেশি
গাড়ি ছিল। তার মধ্যে অন্যতম স্পোর্টস কার ইসোত্তা ফ্রাসকিনি। মানুষটি শৌখিন হলেও
ভোজনের ব্যাপারে তিনি মোটেই শৌখিন ছিলেন না। স্বল্পাহারী।
অধিকাংশ সময়ে নিরামিষ খেতেন। মাছ ছুঁতেন না। মাঝেমধ্যে মাংস খেতেন। লন্ডনে গিয়ে মুরগি
খাওয়া শিখেছিলেন। নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেসটাও তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মা’র
কাছ থেকে। প্রমথেশবাবু আট
বছর অবধি শুধুমাত্র দুধ খেতেন। ন’বছরে
প্রথম ভাত খেয়েছিলেন। পছন্দ
করতেন কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে ফ্যানভাত, কড়াইশুঁটি আর
বাঁধাকপি সেদ্ধ, শাকভাজা, আলুভাজা এবং
ডাল। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল কুড়মুড়ে গরম জিলিপি।
স্কুল পাশ করার পরেই
প্রমথেশের মা ছেলের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। আসলে তাঁর মা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের
মতিগতি। তিনি জানতেন তাঁর শরীরে জমিদারি রক্ত
বয়ে চলেছে। ফলে ছেলেকে থিতু দেখতে চেয়েছিলেন৷ ছোট বয়সে বিয়ে নিয়ে আপত্তি ছিল প্রমথেশের। কিন্তু মা’র
কথা তিনি অমান্য করতে পারলেন না। প্রমথেশ বড়ুয়ার প্রথম স্ত্রী মাধুরীলতা। তিনি
বাগবাজারের মিত্র পরিবারের মেয়ে। এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ
পরমহংসের আশীর্বাদধন্য মা গৌরীদেবী। ১৯২১ সালে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের।
এর পরে আরও দু’বার বিয়ে করেছিলেন প্রমথেশ।
কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পরেও প্রমথেশ ভাবেননি, তিনি রুপোলি পর্দার সঙ্গে জড়িয়ে যাবেন। চাইতেন ডাক্তার হয়ে গৌরীপুরের গরিব প্রজাদের সেবা করতে।
বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার পরে কলকাতায় হেয়ার স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
পড়াশোনায় মেধাবী, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে
ভর্তি হন। স্নাতক হয়ে বিদেশে গিয়ে আরও পড়বেন, ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মায়ের আপত্তিতে তা আর হল
না। কলেজে পড়ার সময়েই শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রমথেশবাবু। বন্ধুদের
নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘ইয়ং ম্যানস ড্রামাটিক ক্লাব’।
এই ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে করেছিলেন ‘নূরজাহান’, ‘কারাগার’, ‘প্রফুল্ল’, ‘বিবাহবিভ্রাট’ ইত্যাদি নাটক। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছিল চলচিত্র জীবন।
পরিচালনা ও অভিনয় দুটোই সমান তালে করতেন।
‘ষোড়শী’
নাটকটি এগারোবার করেছিলেন। এই নাটকে জীবানন্দের চরিত্রটি খুব প্রিয়
ছিল তাঁর। সেই চরিত্রটি অভিনয় করতেন।
কারণ শিশির ভাদুড়ীও জীবানন্দের চরিত্রই করতেন। শুধু নাটক নয়, ক্লাবের
ছেলেদের নিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। প্রমথেশ নিজে
ভাল ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস ও
বিলিয়ার্ড খেলতেন। কলকাতায় বিলিয়ার্ড টুর্নামেন্টে
সাহেবদের হারিয়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র – প্রমথেশ
বড়ুয়ার বোন নীহারবালার নাতি সুদীপ্ত বড়ুয়া
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন