যেভাবে নির্মাণ হয় প্রেম
'রাধার কি হৈল অন্তরের ব্যথা।
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ||
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ||
সম্প্রতি মুক্তি
পেলো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নগরকীর্তন’।
অবশ্য মুক্তি পাবে কী পাবে না, এই দোলাচলতায় কেটেছিল অনেকদিন।
আলিপুর আদালতে ছবিটির মুক্তির দিন
নিয়ে শুনানি হল কিছুদিন আগেই। কিন্তু বিতর্কিত এই
ছবিটি কেনই বা বিতর্কিত? আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক এর
প্রেক্ষাপট।
কোটি কোটি মানুষের বাসস্থল এ দেশে সমকামীদের কথা
তাদের মতো করে বলার কোন প্ল্যাটফর্ম সত্যিই কি সেভাবে তৈরি হয় নি, আর তাই বোধহয় সেন্সর বোর্ড এর আগেও বার কয়েক
কাঁচি চালিয়েছিলেন ছবিটির ‘কিছু দৃশ্য আপত্তিকর’ এই মর্মে।
(লিবারাল দেশে এখনও এমন হয় বইকি!)
কিন্তু, সমপ্রেমের গল্প তো
এর আগেও উঠে এসেছে সিনেমায়। ‘ফায়ার’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘আর একটি প্রেমের গল্প’তে, তাহলে ‘নগরকীর্তন’এর দোষটা ঠিক কোথায়? দোষ নয়, বরং এ ছবির অফবিট আঙ্গিকই ‘নগরকীর্তন’কে স্বকীয়তায় চিহ্নিত করেছে।
বেশ কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক জানান, “এ শহর নিজেকে নিয়ে
গর্ব করুক, এমন ছবি আমার শহরেই তৈরি হয়েছে”।
সম্প্রতি এই শহরেই অনুষ্ঠিত হল সমকামী / রূপান্তরকামীদের একদিনের এক কার্নিভাল। সারাদিন ধরে সেদিন চলেছিল গান, কবিতা আর নিখাদ আড্ডার সেশন। নাহ! এখন আর মুখ লুকিয়ে
থাকেন না ওরা, হলেনই বা প্রান্তিক, তবুও সেই প্রান্তিক সম্প্রদায়দের জন্য উদার, খোলা মঞ্চের আয়োজন
করা হয়েছিলো এই আনন্দনগরীতে।
আসলে এল-জি- বি-টি’রাও কিন্তু এই বৃহত্তর সমাজেরই অংশ, সমাজের বাইরের নন, সমাজের ভিতরেরই।
এই সহজ কথাটা বুঝতে অবশ্য আমাদের সময় লেগে গেছে প্রায় দশ-পনেরো বছর, তবুও সংখ্যালঘু হলেও কিছু মানুষ আছেন, থাকছেন এঁদের পাশে।
তাহলে ‘নগরকীর্তন’এর পরিমল ওরফে পুঁটি এবং মধুর পাশে কেন থাকছি না আমরা? কেন মুক্তির আলো
দেখতে এত দেরী করলো এ ছবি? একের পর এক পুরস্কার যে ছবির ঝুলিতে, যে ছবি একমাত্র ভারতীয় ছবি হিসেবে ‘Toronto Film
Critics Association’এ জিতে নিয়েছে অমূল্য পুরস্কার, সে ছবি দেখা থেকে কেন বঞ্চিত ছিলাম আমরা এতদিন?
এমন ‘Urban Love
Story’ তো এর আগেও হয়েছে, কিন্তু আমরা ওভারলুক করে গেছি তৃতীয়
লিঙ্গ বা ‘থার্ড সেক্স’দের। বলা হয়নি তাঁদের কথা, তৈরি হয়নি কোন
শিল্পিত প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বলা হবে তাঁদের গল্প।
‘নগরকীর্তন’ সেটাই করে দেখিয়েছে।
আসলে এ ছবি সমকামীদের নিয়ে নয়, ভুলটা এখানেই। এ ছবি রূপান্তরকামীদের নিয়ে, কারণ পুঁটি আর মধু
দুজনেই পুরুষ (হ্যাঁ, আমরা শরীরকেই
প্রাধান্য দিয়ে আসছি বরাবর)। তাই সোজা ভাষায় এ
ছবি একজন রূপান্তরকামী আর একজন বাঁশিওয়ালার গল্প।
(আধুনিক রাধা-কৃষ্ণের অনুষঙ্গ মনে পড়ছে কি?) একই অঙ্গে রাধা ও
কৃষ্ণপ্রেমভাব কীর্তনের প্রধান আঙ্গিক। পরিমল ওরফে পুঁটির জীবনও আদতে তাই। কৈশোরে যে সুভাষদা তাকে প্রেমের স্বপ্ন দেখায়, একসময় পুঁটির দিদিকে বিয়ে করে সে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করতেও বেশি সময় লাগে না
তার। এই যন্ত্রণা ওভারকাম করতে না করতেই ঝড়ের মতো মধু আসে পুঁটির
জীবনে।
‘নগরকীর্তন’ আসলে জীবনদর্শনের গল্পই বলে।
না দেখলে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
সিনেমার টেকনিক্যাল দিকের কোনও আলোচনা এখানে
অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় এর নেপথ্য সঙ্গীতের কথা, অসামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড
স্কোর।
অভিনয়ের সংজ্ঞা সত্যিই বদলে দেবে এই ছবি, এতটাই শিল্পিত এর ফ্রেম!
ঋত্বিক চক্রবর্তী, ঋদ্ধি সেন এবং
বিদিপ্তা চক্রবর্তীর অভিনয় গায়ে কাঁটা দেয় দর্শকদের। ঋদ্ধিকে অবশ্য একটু বেশিই ভালো লেগেছে পর্দায়। তবে সমাপ্তিতে চমকে দিলেন... (সেটা না হয়
দর্শক দেখেই বলবেন)
এ গল্প এযাবৎকাল এইভাবে অন্তত দেখানো হয়নি, বিশেষত শেষের দিকের ক্লাইম্যাক্সগুলি। যে কোন মানুষকে নাড়া দেবে এই ছবি, আর তাই কি তার গায়ে
বিতর্কের একাধিক তকমা?
আসলে ‘নগরকীর্তন’এর আগুনফুল্কি
কিন্তু চাপা পড়ার নয়, এ ছবি নিজ আয়াসেই আশপাশের সবকিছু থেকে
আকর সংগ্রহ করে স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠা করেছে নিজের স্থান।
২০১৮ তে লোকসভায় পাশ হয়েছিলো Protection Of Rights বিল।
আজ বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হবার পর, আসুন, আমরা আরও একটু আশাবাদী হই, আরও একটু সহমর্মী হই, নিশ্চিন্ত হই। ‘নগরকীর্তন’এর পুঁটির
দমবন্ধ করা কষ্টটার সামিল হই।
আসুন, আমরা আরও একবার ‘মানুষ’
হই!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন