শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা


ও জীবন রে / জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে





(৬৭)


উত্তরবাংলার প্রাণবন্ত লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। উত্তরবাংলার শ্রেষ্ঠতম লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের জায়মানতায় যুগ যুগ ধরে লোকপরম্পরায় নির্মিত হয়েছে ভাওয়াইয়া। উত্তরবাংলার আদি বাসিন্দা ভূমিপুত্র রাজবংশী জনগোষ্ঠী লালন পালন করেছে কৌম সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এই গান। জীবনযাপনের দিনযাপনের সমগ্রটুকুই ধরা পড়েছে এই গানে। হাতি মহিষ গাড়িয়াল গরুর রাখাল পূজাচার উৎসবাদি বিরহব্যথা নারীজীবনকথা বারমাস্যা সবই ধরা পড়ে ভাওয়াইয়ায়। সুরেন বসুনিয়া প্রথম ভাওয়াইয়ার রেকর্ড করেন। ক্রমে আব্বাসউদ্দিন নায়েব আলি টেপু কেদার চক্রবর্তী প্যারিমোহন দাস কেশব বর্মণ প্রতিমা বড়ুয়া প্রমুখের দক্ষতায় ভাওয়াইয়া আজ সার্বজনীনতা অর্জন করেছে। পৌঁছে গেছে বিশ্বের দরবারে। সময়ের দুঃসহ যাত্রায় কালের অভিঘাতে বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্যের ভোগবাদ ও পণ্যসর্বস্বতায় নগরায়ণের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় অন্যান্য লোকসংস্কৃতির মতো ভাওয়াইয়াও আজ কোণঠাসা। অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন।

একবার হরি বল মন রসনা / মানব দেহাটার গৈরব কৈর না





(৬৮)


ভাওয়াইয়া লোকজনপ্রবাহের অনিবার্য অঙ্গ। লোকমানুষের জীবন নিংড়ে উঠে আসা। বিশিষ্ট খ্যাতিমান শিল্পীগণ নিজস্বতা নিয়ে নিবিড় চর্চা করে চলেছেন। সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খ্যাতমান ও স্বীকৃত ভাওয়াইয়া শিল্পীদের নিয়ে লেখা নয়। একথা বাস্তব সত্যি চ্যালেঞ্জ আসবে, সংকট তীব্রতর হবে, বারবার ধুকতে থাকবে আমাদের লোকসংস্কৃতি। বিভ্রান্তি তৈরী করা হবে বারবার। কিন্তু পৃথিবীর কোন লোকভাষা লোকশিল্প লোকসংস্কৃতিকে ধ্বংশ করা যায় না। যাবে না। কারণ যতদিন লোকমানুষ থাকবেন, মাঠ খেত প্রান্তর ও হাওয়াবাতাস থাকবে ততদিন লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি তুমুল প্রোথিত থাকবে ভূমিতে,আবহমান ও আশ্চর্য চিরন্তনতায়

ও তুই কিসত গোঁসা হলু রে / লালবাজারের চ্যাংড়া বন্ধু রে





(৬৯)


ভাওয়াইয়া বাঁচবে। এটাই অনিবার্য। এখন,এই ২০১ তে আমরা দেখি ধান কাটতে কাটতে সমবেত লোকগান গাইছে মানুষেরা। এখনো মফঃস্বল শহরে সারাদিনরাতের অনেকটাই ভ্যান, রিক্সা চালিয়ে যখন রিক্সাভ্যানচালক গ্রামের বাড়িতে ফেরেন তখন তাদের কন্ঠে বাজে গান—

    ‘ও নয়া বিয়ানী / তোর সাথে মোর
    মনগোঁসা / এল্যাও রে আছে’

কিংবা

    ‘ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে / ও জীবন ছাড়িয়া
    কাটে নাড়া / সেই মতন মানুষের জীবন
    কখন টলিয়া পড়ে / জীবন রে’

অথবা

     ‘বড় লজ্জা দিলু মোক / বড় শরম দিলু মোক
     আপন মানুষ বলি এল্যা / ক্যামনে মানু তোক’

এখনো ভোটপট্টি রাজারহাটের সব্জিবিক্রেতার গলায় শোনা যায়—

      ‘মুই আর যাবার নং/সন্ধাবেলাত
      আর একেলা মুই/জলত যাবার নং’

রাঙ্গালীবাজনায় হাটবাজার করতে আসা দীনবালা রায় ডাকুয়া সহসঙ্গীনিদের সাথে রসিকতা করে এই ভাবে—

      ‘আলসিয়া রে আলসিয়া
      মারিলু বিলাই কুন বেলা’

আবার,

 খাগড়াবাড়ি গার্লসের ছাত্রীরা টিফিনের সময় মাঠে দাঁড়িয়ে যখন গেয়ে ওঠে—

      ‘আমতলী নদীতে/ঝামপলী খেলাইতে
      আজি খসিয়া বা পড়িল/বালির শিষের
      সেন্দুর রে...’

যে বাসে চড়ে আমি চাকরি করতে যাই সেই গাড়ির খালাসী যখন সাবলীল গেয়ে ওঠে-

      ‘ও কি ও মোর কাঁটল খুটার ওরে দোতরা/তুই
       করিলু মোকে জনমের/বাউদিয়া রে’

নদীতে মাছ ধরতে ধরতে এখনো জালুয়ারা ভাওয়াইয়া গায়, বিকেলের মজলিসে আজও মেয়েবউদের কন্ঠে খোঁপা বাঁধবার গান-

       ‘তারপরে বান্ধিলুং খোপা/নাম দিনু তার উনি
       তার উপুরা বসত করে/দেড় কুড়ি বাজারী’

রান্নাঘরের কাজ করতে করতে,উঠোনের ধান ঝাড়তে ঝাড়তে অনায়াস ভাওয়াইয়া গেয়ে ওঠে এখনো প্রান্তিক জনমানুষেরা।










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন