সম্পর্ক
এমন
একটি বিষয় নিয়ে কিছু ধারণা, কিছু চিন্তা, কিছু অভিমত ব্যক্ত করার জন্য আজ কলম
ধরেছি, যা সত্যি সত্যি খুবই স্পর্শকাতর। হয়ত
আমার সম্যক ধ্যান ধারণা নেই বা আমার অনুভব সত্য থেকে দূরে, তবুও আমার এক বন্ধুর
উস্কানিতে কিছু লিখতে উদ্যত হ’লাম। বিষয় হ’ল ‘সম্পর্ক’। প্রাথমিক ভাবে আমার মনে হয়, যেভাবে
দু’জন বা ততোধিক মানুষ, দল, সমাজ অথবা দেশ নিজেদের মধ্যে কথা বলে, পরস্পরকে
বিশ্বাস করে বা নিজেদের মধ্যে ভাবের ও কর্মের আদান প্রদান করে এবং যেভাবে দুই বা
ততোধিক মানুষ নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত থাকে, তাই হ’ল সম্পর্ক। এই সম্পর্ক নামক জিনিষটা এমনই
ঠুনকো, এমনই এই আছে, এই নেই যে তাকে ধরে রাখতে হলে মানুষকেও আবশ্যিক ভাবে অনেক
বেশী সংবেদনশীল, সহ্যশক্তি সম্পন্ন এবং যত্নবান হ’তে হ’বে। তিল তিল করে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বা গড়ে
তুলতে হয়, কিন্তু সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে এক মুহূর্তও সময় লাগে না। এটা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা। যদি মানুষে মানুষে সম্পর্কই না থাকে
তা’হলে মানুষকে সামাজিক জীব বলাই বা কেন ? আসলে
মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হ’বে, এটাই প্রাথমিক শর্ত। একটা বোঝাপড়া, অন্যের অভিমতকে
মান্যতা এবং মর্যাদা দেওয়া, ছোট বড় বয়সের সীমারেখা না টেনে প্রতি মানুষের
বক্তব্যকে সম্মান জানানো, নিজেকে সবজান্তা ভেবে অন্যকে হেয়জ্ঞান না করে তার প্রতিও
সহনশীলতা দেখানো, মানুষের উপকারের বা সাহায্যের বদলে প্রতিদান দেওয়ার কথা বলছি না,
উপকারির উপকারের স্বীকৃতি দেওয়া, এই সমস্ত প্রাথমিক এবং আবশ্যিক শর্ত মেনে চললে সব
কিছুই সুন্দর ও মসৃণ হয়ে উঠতে পারে। এবং
সম্পর্কও অটুট থাকে। সম্পর্কের
প্রকারভেদ আছে, যেমন পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক, ভাইবোনদের সম্পর্ক, স্বামী
স্ত্রীর সম্পর্ক, প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক, বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক, সহপাঠী এবং
সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক, এক কথায় বলতে গেলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক – সব সম্পর্কের
মূলাধার এবং পূর্ব সর্তই হ’ল বোঝাপড়া, পারস্পরিক সম্মান, স্বার্থহীনতা, মূল্যবোধ,
সন্দেহহীনতা, সম্পর্ক রক্ষা করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ভালবাসা।
আমার
এই জীবনটাও তো কম দিনের নয়। পঁচাত্তর
বছরের দীর্ঘ পথ অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে কম
অভিজ্ঞতা তো লাভ হয়নি। কত
উত্থান পতন, কত ভাঙাগড়া, কত হাসি-কান্না, কত মিলন বিচ্ছেদ, কত সুখ দুঃখ, আরও অনেক
অনেক কিছু খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানুষে
মানুষে গভীর ভালবাসা এবং অন্তরঙ্গতা, সুন্দর সম্পর্কও যেমন দেখেছি, আবার সে
সম্পর্ক ভেঙে খানখান হয়ে যেতেও দেখেছি। অনেক
সময় দু’জন মানুষের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ
থেকে এর কারণ জানতে চেয়ে যা উত্তর পেয়েছি, তাতে সন্তুষ্ট হ’তে পারিনি। মনে হয়েছে বিনা কারণে বা তুচ্ছ
কারণে বা যুক্তিগ্রাহ্য কোন কারণ ছাড়াই তা’দের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। বোঝাবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। কেউই এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতে রাজী
হয়নি। কিন্তু যাদের ভাব ভালবাসা
দেখে মনে হ’ত তাদের এই গভীর সম্পর্কে চিড় ধরতেই পারে না, তারা কিন্তু চেষ্টা করলে
এই সম্পর্কটাকে জিইয়ে রাখতে পারতো। অতি
সামান্য কারণে বা ভুল বোঝাবুঝিতে যদি সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় সে ক্ষেত্রেও
সম্পর্কটাকে পুনরীজ্জিবিত করা যায় যদি অন্তত একপক্ষ নমনীয় হ’তে পারে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে কোন কোন বন্ধুর সাথে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেলে মনে মনে ভীষণ কষ্ট
পেতাম। সম্পর্ককে সহজ করার জন্য
বারবার সেই বন্ধুর সামনে গেলেও মুখ ফিরিয়ে থাকতো আর আমার সেটা ভীষণ মনঃকষ্টের কারণ
হয়ে উঠত। দ্বিধা, দ্বন্দ, লজ্জা সব
কিছুকে বিসর্জন দিয়ে দোষ গুণের বিচার না করে বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি কোন কোন
সম্পর্কের বাঁধন এতটাই আলগা হয়, মনে হয় ঐ
রকম সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার কোন মানেই হয় না, ঝেড়ে
ফেলাই উচিৎ এই রকমের সম্পর্ক। কত
ছোট ছোট কারণ কত বৃহৎ আকার ধারণ করে দীর্ঘ দিনের গভীর সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দিতে
পারে, শুধু চিড় ধরানো কেন, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিতে পারে। নিছক সন্দেহের বশে পরস্পরের মধ্যে
তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্পর্ক তাসের ঘরের
মত ভেঙ্গে যেতে দেখেছি। আবার
যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে মানুষ তা শুধরে নেবার চেষ্টা করে, তখন অনেক সময় এতটাই
দেরী হয়ে যায় যে সে সম্পর্ক আর জোড়াই লাগে না। আসল কথা হ’ল, এই সব ক্ষেত্রে মানুষ
নিজের মস্তিষ্ক প্রয়োগ না করে আবেগে গা ভাসিয়ে দেয়। সুতরাং বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা সব
হারিয়ে যায়। যদি একটু সচেতনভাবে যত্ন
সহকারে ভাবা হয়, তা’হলে সম্পর্ককে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আরও একটা অনুধাবনযোগ্য ব্যাপার আছে
যা অনেক সময় মানুষে মানুষে সম্পর্কে চিড়
ধরায় এমনকি সম্পর্ক ভেঙ্গেই দেয়। আর
তা হল, চলতি কথায় যাকে বলে পরের মূখে ঝাল খাওয়া। এই সব ক্ষেত্রে মানুষ অনেক সময়
এতটাই অবিবেচক ও বিচারবুদ্ধিহীণ হয়ে পড়ে যে সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনও
অনুভব করতে পারে না। যার
অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হ’ল সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া। অন্য কারও কথায় পুরোপুরি ভরসা না
করে যদি সরাসরি উল্লিখিত ব্যক্তির সাথে সামনা সামনি কথা বলা যায়, তাহ’লে সত্যটা
উদ্ঘাটিত হ’তে পারে – হয় ঠিক না হয় ভুল। কিন্তু
মানুষ তা না করে অন্যের কথায় বিশ্বাস করে সত্যটা জানবার চেষ্টাই করে না। যার ফলে সত্যটা আর উদ্ঘাটিতই হয় না
এবং ফলস্বরূপ সম্পর্কের অবনতি ঘটে বা সম্পর্ক ছিন্নই হয়ে যায়। যুক্তি তর্কের কষ্টিপাথরে যাচাই
করার মানসিকতা মানুষ হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র পরের কথায় বিশ্বাস করে বহুদিনের সম্পর্ককেও
নষ্ট করে ফেলে। এ ছাড়াও হিংসা বা ঈর্ষা
মানুষে মানুষে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেয়। আমি
নিজের জীবনে দেখেছি দুই বন্ধুর নিবিড় বন্ধুত্বের অপমৃত্যু। এই দুই বন্ধু এবং তাদের দুই
পরিবারের মধ্যে এত মধুর সম্পর্ক দেখেছি অনেক দীর্ঘ দিন ধরে, মনে হ’ত বন্ধুত্ব একেই
বলে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক এই রকমই হওয়া উচিৎ। এত গভীর আর এত মধুর সম্পর্ক যে
ভেঙ্গে যেতে পারে, কোনদিন ভাবতেও পারিনি। অতি
তুচ্ছ কারণ কিন্তু সেই তুচ্ছ কারণই যথেষ্ট ছিল সেই মধুর সম্পর্ক কে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে
দিতে। এই দুই বন্ধুর মধ্যে একজনের
ছেলেমেয়েরা অনেক বড় কোম্পানি তে চাকরি করে, তাদের গাড়ি আছে, নিজেরা বাড়ি কিনেছে,
জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত আর অন্যজনের ছেলেমেয়েরা সেরকম ভাবে প্রতিষ্ঠিত হ’তে না পারায়
সে বন্ধুর সাথে সম্পর্কই ত্যাগ করে দিয়েছে। এ কী
রকম মানসিকতা!
তাই আমি মনে করি, সম্পর্ক স্থাপন করা যতটা না কষ্টের,
তার চেয়ে বেশী কষ্টের সম্পর্ক রক্ষা করে চলা। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে বহু দিনের
পুরনো এবং গভীর সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্ক
রক্ষা করতে হ’লে মানুষকে অনেক বেশী সংবেদনশীল, সহিষ্ণু, সহনশীল হ’তে হ’বে। আগে যা বলেছি, শেষ করার আগে আবার
বলছি, সব সম্পর্কের মূলাধার এবং পূর্ব সর্তই হ’ল বোঝাপড়া, পারস্পরিক সম্মান ও
শ্রদ্ধা, স্বার্থহীনতা, মূল্যবোধ, সন্দেহহীনতা, সম্পর্ক রক্ষা করার ঐকান্তিক
প্রচেষ্টা ও ভালবাসা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন