সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮

অচিন্ত্য দাস




যাবার জায়গা, নামার জায়গা


শনিবার বলে প্যাসেঞ্জারে ভীড় কম, বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। যাত্রীরা প্রায়  সকলেই এ অঞ্চলের  আদিবাসী লোকজন। এর মধ্যে একজনকে চোখে পড়ল, এ আদিবাসী নয়। বয়স তিরিশ মত হবে, মুখটায় কেমন একটা ছেলেমানুষি ভাব আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের পরদায় কিছু একটা পড়ছে। দু-একটা লোক নামাতে পাশে জায়গা হয়েছিল, ডেকে বললাম – তুমি বসতে পারো। বসল, তবে দেখলাম সে পড়েই যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম – কোনো বই ডাউনলোড করেছে কি না! একটু সংকোচের সঙ্গে বলল – না, না। আমার নিজের লেখাগুলো  দেখছিলাম আর কী 
-তুমি লেখ?
-হ্যাঁ, যখন যা মনে হয় লিখে রাখি। কবিতাই বেশি। পড়বেন?
-আমি হিন্দী তো ভাল জানি না!
-দু-একটা ইংরেজিতেও লিখেছি
একটা পড়লাম। লিখেছে – ঈশ্বরকে জানি না, তাই ভক্ত বলে অহঙ্কার নেই। গাছপালা দেশবিদেশ পশুপাখি কিছুই তেমন জানি না, তাই অনেক জানি বলে অহঙ্কার নেই। একটু অহঙ্কার ছিল যে লিখতে পারি। তোমাকে দেখে যখন একটা লাইনও মাথায় এলো না, তখন তাও গেল।

ভালবাসার কবিতা, তা মোটামুটি লিখেছে। অকপট সোজা-সাপটা স্টাইল। আলাপ হয়ে গেল। ছেলেটা শহরে একটা দোকানে হিসেবপত্রের কাজ করে। সেখানেই ফিরছে। বলল, সে নাকি লেখা ছাড়া থাকতে পারে না। একলা একলা  ঘুরে বেড়াতে তার নাকি সব থেকে ভাল লাগে। চাকরি তো একটা করতেই হয়,  তাই করছে। আমিও ছেলেটার স্টেশনেই নামব তবে তা আসতে এখনো কম করে ঘণ্টাখানেক। ওদিকে একটা জানালার ধার খালি হতে ওখানে গিয়ে বসলাম
এইসব জায়গায় বর্ষাকালটা বড় সুন্দর। লতাপাতা গাছ-গাছরা সব তরতাজা সবুজ। ন্যাড়া পাহাড়ের গায়েও সবুজের ছোপ দেখা যায়বর্ষার মহিষ-কালো মেঘের নিচে ধানক্ষেত এমনকি সাধারণ গরুচড়া ঘেসো মাঠও চোখ টেনে রাখে। ছোট ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছে, আবার ছাড়ছে। সিগন্যাল নেই বলে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল – এসব ট্রেন বড় খেয়ালি। নিজের মর্জি মত চলে আবার জিরিয়ে নেয় এই রে, বৃষ্টি এল! ছাট আসছে। আমি জানালার কাচটা কোনোরকমে নামালাম, ভিজে যাচ্ছিলাম। গাড়ি ছাড়ল – তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে ‘মহালিমারুপ’ নামের একটা ছোট স্টেশনে থামল। কাঁকড় বেছানো কালচিটে লাল প্ল্যাটফর্ম। দুটো-একটা লোক ফাটাফুটো ছাতা নিয়ে চলাচল করছে। শেডের তলায় চা, বিড়ি-সিগারেট, পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে। শাল পাতায় চারভাগ করে ঝালনুন মাখিয়ে দেয়। লালমাটির দেশ, গাছের মধ্যে শাল-মহুলই বেশি। স্টেশন পেরিয়ে মাটির রাস্তা ঢালু হয়ে সরু পিচের রাস্তায় মিলেছে -- সাইকেলের পেছনে বসে একটা মেয়ে খুব হাসছে, বৃষ্টিতে খানাখন্দ বাঁচিয়ে প্যাডেল করছে লোকটা

এমন সময় দেখি কবিতা-লেখা ছেলেটা প্ল্যাটফর্মে। বলেছিল তো টাটায় নামবে,  এখানে নেমে গেল? আমার সঙ্গে চোখেচোখি হতে ছেলেটা হাসল। পাকাপাকি অভিধান না থাকলেও মানুষের হাসির একটা ভাষা আছে মনে হল ছেলেটা বলছে – আমার যাবার জায়গা এখনো আসেনি, কিন্তু বর্ষার এই ভিজে-হাওয়ার বিকেলে এটাই যে আমার নেমে পড়ার জায়গা...


1 টি মন্তব্য: